একতা: ক্যাটালোনিয়া থাকুক সঙ্গেই। উড়ছে স্পেনের পতাকা। ছবি: রয়টার্স।
বার্সেলোনার রাস্তায় বিকেল তিনটের পর গুলির লড়াই শুরু হয়ে গেল। শহরটাকে কয়েক দিন আগেও বিপ্লবের দিশারি মনে হচ্ছিল। ধোপদুরস্ত পোশাক কেউ পাত্তা দিচ্ছিল না, শ্রমিকদের মোটা কাপড়ই সর্বেসর্বা। সবাই সবাইকে ‘কমরেড’ সম্বোধন করে।
আজ সব উলটেপালটে গিয়েছে। সোশালিস্ট পার্টির লোকেরা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ চালাত, সেখানে সকালবেলায় ঢুকে পড়েছে কমিউনিস্ট পার্টির স্বেচ্ছাসেবী সেনা দল: পপুলার আর্মি। রাস্তায় এলোপাথাড়ি বুলেট ছুটছে, লোকজন যে দিকে পারছে পালাচ্ছে।
ঘটনাটা নভেম্বর, ২০১৭-র নয়। ৮০ বছর আগে ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল স্পেনের ফাসিস্ত শাসক ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। রণাঙ্গনের স্যাঁতসেঁতে ঠান্ডা, হাতে-থাকা অকেজো জবড়জং অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি সব অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ‘হোমেজ টু ক্যাটালোনিয়া’ নামে একটি বইও লিখেছিলেন। উপরের দুই অনুচ্ছেদ সেই বই থেকেই।
স্পেনের স্বশাসিত ক্যাটালোনিয়া প্রদেশ তো গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই খবরে। প্রথমে তারা স্বাধীনতার জন্য গণভোট দিল, তার পরই বার্সেলোনার রাস্তা ভরে গেল দুই পক্ষের মিছিলে আর স্লোগানে। কেউ বললেন, এই গণভোট বেআইনি। কেউ বললেন, পুলিশের ধরপাকড় না থাকলে গণভোটে আরও বেশি সাড়া পড়ত। ক্যাটালোনিয়ার পুলিশ সকালে বুথ খুলে দিলেও নাকি রাজধানী মাদ্রিদ থেকে আসা সশস্ত্র ন্যাশনাল পুলিশ ও সিভিল গার্ডরা ভোটারদের যথেচ্ছ পিটিয়েছেন, শেষ অবধি ক্যাটালোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী পুইদমঁ-এর বিরুদ্ধে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহ ও টাকা তছরুপের অভিযোগ এনেছেন। পুইদমঁ বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে চলে গিয়েছেন। সেই শহর এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজধানীও বটে! এই পরিস্থিতিতে ওই বই আর এক বার না পড়ে উপায় আছে?
স্পেনে যাওয়ার সময় অরওয়েল মাত্র ৩৪ বছরের এক উটকো লেখক। কয়েক বছর আগে বর্মায় পুলিশের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে লন্ডনে ফিরে এসেছেন। এ দিক-ও দিক কয়েকটি গল্প বেরিয়েছে, একটি উপন্যাসও। এই সময়েই স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর ক্ষমতা দখলের চেষ্টা, লেখক ঠিক করলেন তিনি সাম্যবাদের সেনানী হয়ে যুদ্ধে যাবেন। ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হ্যারি পলিটের সঙ্গে দেখা করলেন। হ্যারি অবশ্য অরওয়েলকে খুব একটা পাত্তা দেননি, লেখককে তাঁর ‘পলিটিকালি আনরিলায়েবল’ মনে হয়েছিল।
কিন্তু অরওয়েলকে দমায় কে! ১৯৩৬-এর ডিসেম্বরে ঠান্ডায় পৌঁছে গেলেন বার্সেলোনা। সেখানে ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টির জন ম্যাকনায়ারকে বললেন, তিনি ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়তে এসেছেন। ম্যাকনায়ার অরওয়েলকে নিয়ে গেলেন বামপন্থী ‘ওয়ার্কার্স পার্টি অব মার্ক্সিস্ট ইউনিফিকেশন’-এর অফিসে। রাজনৈতিক দলগুলিই তখন স্পেনে গণফৌজ গড়ে তুলেছে। একদা পুলিশ অফিসার অরওয়েল সেখানে হয়ে গেলেন ফৌজের কর্পোরাল। কয়েক দিনের মধ্যে তাঁকে যেতে হল আরাগন ফ্রন্টে।
জর্জ অরওয়েলের বই
ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে স্পেনের পাহাড়ে সেই ফ্রন্ট কী রকম? সৈন্যরা বেশির ভাগই প্রায় ১৭-১৮ বছরের অনভিজ্ঞ তরুণ, উর্দি মানে তাপ্পি মারা জ্যাকেট, রাইফেল মানে প্রায় অর্ধশতকের পুরনো বন্দুক, লক্ষ্য ঠিক থাকে না। গুলি এ দিকের বদলে ও দিকে চলে যায়। গ্রিজের অভাবে বন্দুক কখনও-সখনও প্রাতরাশে দেওয়া শুয়োরের চর্বি দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। কিন্তু উদ্দীপনার খামতি নেই। এক সৈন্য ঊর্ধ্বতন অফিসারকে ‘সেনর’ বলে ডেকেছিল। ঘুরে দাঁড়িয়ে অফিসারের উত্তর, ‘‘কে সেনর? এখানে সবাই কমরেড।’’
কমরেড? ফ্রন্ট থেকে ১১৫ দিন পর ফিরে আহত অরওয়েল বার্সেলোনার রাস্তায় যে যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করলেন, তা আসলে সোশালিস্ট বনাম কমিউনিস্ট পার্টির লড়াই। যে দুই দল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছিল, তাদের মধ্যেই এখন সন্দেহের অঙ্কুর। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেরণায় তখন কমিউনিস্টরা অরওয়েলদের ওয়ার্কার্স পার্টিকে মনে করে নৈরাজ্যবাদী। তারা মনে করে, কমিউনিস্ট পার্টিই বিপ্লবের অগ্রণী সৈনিক। পার্টি নেতৃত্ব না থাকলে গোটাটাই প্রহসন।
আহত অরওয়েল দেখলেন, দেখছেন, তাঁর ওয়ার্কার্স পার্টি নিষিদ্ধ। স্ত্রীকে নিয়ে অচিরে স্পেনের সীমান্ত পেরিয়ে না গেলে বাকি জীবনটা জেলখানায় পচে মরতে হবে। এক দিন তিনি সাম্যবাদের হয়ে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে কমিউনিস্ট নেতা হ্যারি পলিটের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। ক্যাটালোনিয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে আজ এই বইয়েই লিখবেন, ‘দর্শনের দিক থেকে কমিউনিস্ট পার্টি আর নৈরাজ্যবাদীরা দুই মেরুর বাসিন্দা। কমিউনিস্টরা চায় কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা আর দক্ষতা। নৈরাজ্যবাদীরা চায় স্বাধীনতা আর সমতা।’ আরও পরে ক্যাটালোনিয়ার এই অভিজ্ঞতাই স্তালিনবাদের বিরুদ্ধে তাঁকে দেখাবে আলো। লিখবেন ‘পশুখামার’-এর সেই বিখ্যাত লাইন, ‘সব প্রাণীই সমান, কেউ কেউ বেশি সমান।’ আধিপত্যবাদী শাসনে কী ভাবে ‘বিগ ব্রাদার’ প্রভাব ফেলেন, ‘থট পুলিশ’ কী ভাবে ক্ষমতার বয়ানের বাইরে অন্য চিন্তাকে অপরাধ গণ্য করে, সবই সাহিত্যে তুলে ধরবেন। নোম চমস্কিও বলছেন, ‘‘এটাই অরওয়েলের অন্যতম সেরা লেখা। সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ওপর জনতার আধিপত্যের নৈরাজ্যবাদই লক্ষ্য।’’
রুশ বিপ্লবের শতবর্ষে তাই সাম্প্রতিক বার্সেলোনা কাকতালীয় ভাবেই মনে পড়িয়ে দেয় বইটাকে… হোমেজ টু ক্যাটালোনিয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy