Advertisement
E-Paper

হাফ ভূতুড়ে

আগেই বলে রাখি আমি মোটেই ‘ভূততত্ত্ববিদ’ নই। যদিও ভূত নিয়ে প্রশ্ন করে করে আমাকে সেটাই প্রায় বানিয়ে ফেলা হয়েছে। আর পাঁচ জনের মতোই আমিও ভূতের গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। তার বেশি কিছু না। হলফ করে বলতে পারি না যে, আমি ভূত দেখেছি।

অনীক দত্ত

শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
 সুমন চৌধুরী

সুমন চৌধুরী

আগেই বলে রাখি আমি মোটেই ‘ভূততত্ত্ববিদ’ নই। যদিও ভূত নিয়ে প্রশ্ন করে করে আমাকে সেটাই প্রায় বানিয়ে ফেলা হয়েছে। আর পাঁচ জনের মতোই আমিও ভূতের গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। তার বেশি কিছু না। হলফ করে বলতে পারি না যে, আমি ভূত দেখেছি। এক সময় খুব ভূতের ভয় পেতাম। ছোটবেলা থেকেই আমার একটা আলাদা ঘর ছিল। বাবা-মা কখনও সন্ধেবেলা বেরিয়ে গেলে বাড়িতে একাই থাকতাম। ঘরের ঠিক পাশে একটা বারান্দা ছিল। সেখানে একটা বড় লতানো গাছ ছিল। তার ছায়াটা ঘরে এসে পড়ত। হাওয়ায় গাছটা নড়ত, সঙ্গে ছায়াটাও। আর আমি বেদম ভয়ে কুঁকড়ে শুয়ে পড়তাম। এখনও সে রকম পরিস্থিতিতে পড়লে নিশ্চয়ই ভয় পাব। তবে, ছোটবেলায় ভয় পাওয়ার মধ্যে একটা মজা ছিল। একটা বেশ গা ছমছমে ভাব। এখন বয়স বেড়েছে। আর বয়স বাড়লেই মানুষের মধ্যে একটা ‘সিনিক্যাল’ ব্যাপার চলে আসে! ভূত, ভগবান কিছুতেই তখন আর কেউ বিশ্বাস করে না। এরই সঙ্গে ভয়টাও কেমন যেন তরল হয়ে আসে। ভয়ের মধ্যে যে মজাটা থাকে, সেটা পুরোপুরি পাওয়া যায় না।

আমার ব্যারাকপুরের মামাবাড়িটা ছিল ব্রিটিশ আমলের একটা বাংলো। দাদু ছিলেন ব্যারাকপুর জুটমিলের ইঞ্জিনিয়ার। বাংলোর সিঁড়িটা ছিল কাঠের। আর সেই সিঁড়িতে রাখা একটা হ্যাটস্ট্যান্ড। সব সময় একটা টুপি আর বর্ষাতি সেখানে ঝুলত। রাতের অন্ধকারে মনে হত, কেউ যেন ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমার পক্ষে একা সেই সিঁড়ি দিয়ে ওঠা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। কোনও ভাবে হয়তো নেমে পড়েছি। কিন্তু ওঠার সময় তলায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কেউ এলে তার সঙ্গে উঠতাম।

আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজন মুম্বইয়ে থাকেন। মনে আছে, ছোটবেলায় মুম্বই গেলেই আমরা মায়ের কাকার বাড়িতে উঠতাম। মায়ের কাকা যখন মারা যান, আমি খুব ছোট। তাঁর একটা বিশাল সাদা-কালো ছবি বসার ঘরে টাঙানো থাকত। বাড়িটা একটা পুরনো পার্সি বাংলো। জানলায় স্টেন্‌ড গ্লাস বসানো। তাতে একটা সুন্দর আলো-ছায়ার খেলা হত। বারো-তেরোটা বেড়াল যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াত। সব মিলিয়ে আইডিয়াল একটা ভূতুড়ে পরিবেশ। বাইরের অনেকেই বাড়িটাকে ‘ভূত বাংলা’ বলত। আমি মজা করে বলতাম, ‘বেট‌্স মোটেল’ (‘সাইকো’র সেই মোটেলটা)। শেষ বিকেলের মরা আলোয় সিল্যুয়েটটা অবিকল সেই রকম লাগত।

ছোটবেলা থেকেই শুনতাম, ওখানে নাকি চেনা-অচেনা বিভিন্ন ভূত ঘুরে বেড়ায়। সঙ্গে তাদের নিয়ে প্রচুর গল্পও। আমার এক মাসিকে মিডিয়াম করে মাঝেমধ্যেই সে বাড়িতে প্ল্যানচেটের আসর বসত। সে বার কলকাতা থেকে অনেকে মিলে গেছি। এক সন্ধেয় প্ল্যানচেট শুরু হল। আর মাসিও খসখস করে লিখতে শুরু করল। আশ্চর্য, মাসি ছোটবেলায় কলকাতা থেকে চলে গিয়েছে। অথচ ও দেখলাম দিব্যি ঝরঝরে বাংলায় লিখে চলেছে। সেখানে দিব্যি একটা ফ্যামিলি গেট টুগেদার হল। জীবিতরা তো ছিলেনই, যাঁরা জীবিত নন, তাঁদেরও অনেকে এসেছিলেন। আমি ছোটবেলা থেকেই একটু দুষ্টু-টাইপ। কলকাতার ছেলে। কলকাতায় তখন একটা বিজ্ঞানমনস্কতাও ছিল (এখন আর নেই)। ফলে, একটা অবিশ্বাসের ভাব তো ছিলই। তাই আমি মিটিমিটি হাসছি, ইতিউতি দেখছি। অন্য দিকে, প্ল্যানচেটে খোশমেজাজে আড্ডা চলছে। মাঝেমধ্যে পরিবেশ কিছুটা গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। প্ল্যানচেট শেষ হওয়ার মুখে, হঠাৎ একটা ওঁওওওও আওয়াজ। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম, এই রে, এ বার কে এল? অনেক সময় প্ল্যানচেট করে ডাকতে গিয়ে অন্য আত্মা চলে আসে। পরে বোঝা গেল, আমার এক মাসি, লালি, পুরো ঘটনা দেখে ভয় পেয়ে ও রকম গোঙানির মতো আওয়াজ করছিল। এই বাংলোর পাশে একটা ছোট কটেজ ছিল। একটা জঙ্গল জঙ্গল জায়গা। তখনও মুম্বইতে ও রকম অনেক জায়গা ছিল। এখন সব ভেঙেটেঙে মাল্টিস্টোরিড হয়ে গেছে। ওই জঙ্গলের মধ্যে একটা আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে একটা দোলনা টাঙানো। সেটা মাঝেমধ্যেই ক্যাঁচর ক্যাঁচর করে নিজে নিজেই দুলত। প্ল্যানচেট শেষে সেই দোলনার পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে সবারই অবস্থা খুব খারাপ। দল বেঁধে যেতে হল।

পরে, আমার স্ত্রীকে নিয়ে সেই বাংলোয় থাকতে গিয়ে একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যাওয়ার ঠিক আগেই ওর একটা বড় অপারেশন হয়। আমার স্ত্রী খুবই নাস্তিক। ভূতটুতও একেবারেই মানে না। কিন্তু বাংলোয় থাকার সময় একটা রাতে ও অনুভব করে যে কেউ একটা ওর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পরের দিন সকালে আমি খুব হালকা চালেই সবার কাছে ঘটনাটা বললাম। তখন ওঁরা বললেন, আমাদেরই এক গুরুজন ওখানে থাকেন এবং আমার স্ত্রী’র অত বড় অপারেশন হয়েছে বলে সম্ভবত উনি আশীর্বাদ করতে এসেছিলেন। মানে? বুঝলাম, ওঁরা আমাদের এক মৃত গুরুজনের কথা বলছেন। শুনে তো আমি স্তম্ভিত। ব্যাপারটা এত ঠান্ডা গলায় বলা হল, যেন জীবিত ও মৃত মানুষেরা এক বাড়িতে পাশাপাশি থাকবে, এর চেয়ে স্বাভাবিক আর কী!

মুম্বইয়ের এই আত্মীয়দের কাছেই বিভিন্ন সময় অনেক ভূতের গল্প শুনেছি। তাঁদেরই এক পরিচিত খুব বড় এক কোম্পানির সিইও ছিলেন। তিনি এক পাঁচতারা হোটেলের ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে সুইসাইড করেন। ঘটনাটা কাগজে বেরিয়েওছিল। কিছু দিন পর আমাদের অন্য এক আত্মীয়ের কাছে নাকি এই ভদ্রলোকটির আত্মা আসে। এবং তাঁকে অনুরোধ করে, ‘এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার বউ আর ছেলে যেন কোম্পানিকে বেশি না খোঁচায়।’ কেন? আসলে, এই কর্তাটিকে নাকি খুন করা হয়েছিল। তিনি কোম্পানির অনেক সিক্রেট জেনে ফেলেছিলেন বলে তাঁকে ওপর থেকে ফেলে দেওয়া হয়। এখন মৃত্যুর পর তাঁর আত্মার ভয় হয় যে, এই নিয়ে যদি কোম্পানিকে বেশি খোঁচাখুঁচি করা হয়, তা হলে তাঁর বউ আর ছেলেরও ক্ষতি করতে পারে সেই ক্রিমিনালরা। বড় হয়ে যখন অনেক ফিল্ম দেখতে শুরু করলাম, হরর ফিল্মও দেখেছি প্রচুর, তখন কিন্তু ‘দ্য শাইনিং’ ছবিটা দেখে হাত-পা একেবারে সেঁধিয়ে গিয়েছিল। সেই সময় আমার স্ত্রী কনসিভ করেছিল, তাই ওকে আমি এটা দেখতে দিইনি। ও এখনও এই ছবিটা দেখেনি।

কলকাতার বাড়িতে আমার নিজের সঙ্গেই দুটো খুব অদ্ভুত ঘটনা হয়েছিল। এক বার রাতে শুয়ে আছি, হঠাৎ মনে হল একটা ছায়ামূর্তি যেন উঠে চলে গেল।

মনে হল এক জন মহিলা। ভাবলাম, এত রাতে কি মা উঠে কোথাও গেলেন? পাশের ঘরে গিয়ে দেখলাম, মা ঘুমোচ্ছেন। সে দিন আবার লালিও আমাদের সঙ্গে ছিল। দেখলাম ও-ও ঘুমোচ্ছে। পর দিন জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ কি ওই সময় উঠেছিলে? ওরা বলল, না। তার পর জানা গেল, ওই সময় নাগাদ আমার স্ত্রীর এক জন আত্মীয় মারা গেছেন। আমি জানি যে, এটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়। আর রাতে অনেক সময় খুব অন্যমনস্ক থাকলে আলোছায়ার খেলায় অনেক বিচিত্র জিনিস হতে পারে। ছায়ামূর্তি দেখাও মোটেই আশ্চর্য নয়। কিন্তু অন্যদের বদ্ধমূল ধারণা হল যে, আমি ওঁকেই দেখেছি।

আর এক বার আমার ঘরে আমি আর আমার স্ত্রী (তখন বান্ধবী) বসে আছি। হঠাৎ বাইরের ঘর থেকে মনে হল আমার এক মাসি ডাকলেন, ‘এই বুবা’ (আমার ডাকনাম)। মাসি কলকাতাতেই থাকতেন। উঠে দেখতে গেলাম। কেউ নেই। বান্ধবী বলল, ‘কী হল?’ বললাম, মনে হল কেউ ডাকল। ও বলল, হ্যাঁ, আমিও তো শুনলাম। অথচ কেউ নেই। হবি তো হ’ ঠিক সেই সময়ই আমার আর এক মাসি দিল্লিতে মারা যান। আমি এ সবে বিশ্বাস করি না। ওখানে হয়তো কোনও শব্দ হয়েছিল, যেটা শুনে মনে হয়েছিল কেউ যেন ডাকছে। দুজন একই সঙ্গে শুনেছি বলে একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম। তবে, এ রকম সমাপতনও তো হামেশাই ঘটে। আসলে, এ সব আমরা ভাবতে ভালবাসি বলেই হয়তো সবার জীবনেই এ রকম কিছু না কিছু ঘটে। বেশির ভাগ মানুষ এ সব বিশ্বাসও করতে চান। এক বার আমি বাবা-মা’কে লুকিয়ে বারান্দায় সিগারেট খেতে গিয়ে ‘ছায়ামূর্তি দেখেছি’ বলে স্রেফ গুল মেরেছিলাম। ও মা, দেখি সবাই বিশ্বাসও করে নিল। তার পর যত বলি ওটা গুল মেরেছিলাম, অন্যরা বলে, না তুই ভূত-ই দেখেছিস। আগে ভাবতাম, বাঙালিরাই বোধহয় ভূত নিয়ে সবচেয়ে বেশি গুল মারে। পরে দেখেছি, পৃথিবীর সব জায়গায় ভূত নিয়ে গুল মারার লোক আছে।

‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ শুট করতে যখন শ্রীরামপুর গেলাম, তখন লোকের মুখে অনেক ভূতুড়ে গল্প শুনেছিলাম। বাড়িটার মাঝখানের প্রধান চাতালটা নাকি এক সময় একটা পুকুর ছিল। একটা বাচ্চা নাকি সেই পুকুরে ডুবে যায়। তার পর তার আর কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এমনকী বডিটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার পর এক দিন যখন শুটিং চলছে, তখন পিছনের বারান্দা থেকে কে যেন একটা শটের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। ব্যাপার কিছুই না, একটা লোক সেই সময় সেখান দিয়ে হয়তো যাচ্ছিল। তারই ছায়া ওটা। কিন্তু অনেকেরই মনে হয়েছিল কোথা থেকে একটা ভূতপ্রেত-জাতীয় কেউ বোধহয় ঢুকে পড়েছে। আসলে, এই ধরনের বাড়িগুলো জড়িয়ে অনেক গল্প থাকে। মেক-আপ করতে করতে আমাদের টিমের অনেকেই সে সব গল্প শুনেছে। ফলে, ইতিউতি ভূত দেখাও বিচিত্র কিছু না। তবে, আমার মাথায় তখন সিনেমার ভূত চেপে। তাই, অন্য ভূতের গল্প সেখানে বিশেষ জায়গা পায়নি।

তবে, শুটিং শুরুর ঠিক আগে একটা ঘটনার কথা এখনও মনে আছে। গল্পটা অনেক জায়গায় বলেওছি। শ্রীরামপুরে প্রথম দিন শুট করতে যাচ্ছি। দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরিয়ে টোল প্লাজায় আমাদের এসইউভি-টা দাঁড়িয়ে। ভোরবেলা। সবে আলো ফুটছে। গাড়িতে আমি, আমার পাশে ক্যামেরাম্যান অভীক মুখোপাধ্যায়। পিছনের সিটে আরও দুজন অ্যাসিস্ট্যান্ট বসে। তারাই হঠাৎ আমাদের দেখাল ব্যাপারটা। গাড়ির ঠিক পেছনে একটা লরি দাঁড়িয়ে। লরির ওপরে প্রায়ই কিছু নাম লেখা থাকে, চুন্নু-মুন্নু, সানি-হানি জাতীয়। অবাক হয়ে দেখলাম, সেই লরির ওপরে লেখা অনীক আর অভীক। অবশ্য নাম দুটো যে খুব অ-সাধারণ, তা নয়। কিন্তু অবশ্যই লরির ওপর এই নাম লেখা দেখলে একটু অন্য রকম লাগে। তার ওপর, আমি গাড়ির যে দিকটায় বসে, লরির সে দিকেই লেখা অনীক। আর অভীকের দিকে লেখা অভীক। এ রকম কাকতালীয় ব্যাপার বড় একটা দেখা যায় না। অভীক পরে আমাকে বলেছিল, এটা আসলে আমাদের ভবিষ্যৎ। ছবি যদি ফ্লপ করে, আমরা তখন একটা ট্রাকের ব্যবসা করব, আর সেটার সামনে এই নাম দুটো লেখা থাকবে।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy