রবিবার দিন এলেন? অন্য দিন আসতে হত, উইকডে’তে। আজ তো ছুটি, বিশ্রাম। মানুষের, দেবতারও।’’ দু’হাত জড়ো করে, বিনয়ী অথচ দৃঢ় গলায় বলছিলেন পল ওয়েন। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে পায়ে পায়ে ঢুকে এসেছি ব্ল্যাকবার্ন লেনে, গলির ভিতর লম্বা লালরঙা বাড়ির কোণে ছোট্ট মন্দিরে। মেঝে থেকে দেওয়াল তকতকে, অন্দরসজ্জা ঝকঝকে। আলো-পিছলানো পিতলের পিলসুজ। দেবতাদের সামনে জ্বলছে ধূপ, এক কণা ছাইও ইতস্তত উড়বে-পড়বে না।
এঁরা দু’জন কে? কীসের দেবতা? কী নাম? সিংহাসনে বসে আছেন বুদ্ধোপম শান্ত সমাহিত, টকটকে লাল চাদরে মুখটুকু বাদে গোটা শরীর ঢাকা। যুগলমূর্তির একেবারে সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেন পল। প্রায় ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘‘নাম... জানি না... বলতে নেই। কিন্তু আপনি ঠিক এই সামনেটা থেকে ওঁদের দিকে তাকান, দেখবেন, আধবোজা চোখগুলো খুলে যাচ্ছে, ওঁরা দেখছেন আপনাকে।’’ প্রতিমার সামনে চাইনিজ-টি ভরা সুদৃশ্য পোর্সেলিনের কাপ ঠিক করে দিতে দিতে গাঢ় হয় ওঁর গলা, ‘‘দেখুন যত খুশি, শুধু ছবি তুলবেন না।’’ কেন? নিয়ম নেই? বাইরে থেকে একটা লং শট অন্তত? তাও না। ‘‘বারোটায় বন্ধ করব মন্দির, তত ক্ষণ ঠায় বসে থাকি এখানে। মন্দিরেই হেঁটেচলে বেড়াই। দেখি, যাতে কেউ ছবি না তোলেন,’’ গম্ভীর গলায় বলে চলেন প্রৌঢ় চিনে মানুষটি।
চিনে মানুষ বলাটা ভুল হল। পল ওয়েন-রা আপাদমস্তক ভারতীয়। ইন্ডিয়ান চাইনিজ। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-বউবাজার ঘেঁষা এই পাড়ায়, ট্যাংরার চায়নাটাউনের গলি-গলতায় ওঁদের চোখে পড়ে বেশি, বাকি শহরে ইতিউতি। দু’শো বছরেরও আগে ওঁদের পূর্বপুরুষ চলে এসেছিলেন চিন থেকে ভারতে, ঘর বসিয়েছিলেন হুগলির তীরে। মানুষ তো একা আসে না, সঙ্গে নিয়ে আসে সংস্কার, বিশ্বাস, কুলুঙ্গি থেকে পেড়ে-আনা ধর্ম। নতুন মাটিতে তারা আঁচল পাতে, শেকড় ছড়ায়। ব্ল্যাকবার্ন লেনে একুশ শতকের রবিবাসরীয় রোদে শর্ট-ক্রিকেট খেলা ছেলের দল, মাংসের দোকানের মেঝেয় ছাড়িয়ে রাখা উৎকট পাঁঠার চামড়া, ভাঁড়ে ফুঁ-দেওয়া অজস্র বলিরেখার পাশেই তাই জেগে থাকে অচিন চিনে-দেবতার মন্দির। নিজস্ব নির্জনতায়।