Advertisement
E-Paper

ডেঙ্গির বিশ্বসফর

আফ্রিকা থেকে আমেরিকা, এশিয়ায় গিয়েছে সে। সঙ্গে এনেছে দাসপ্রথার ইতিহাস। আফ্রিকা থেকে আমেরিকা, এশিয়ায় গিয়েছে সে। সঙ্গে এনেছে দাসপ্রথার ইতিহাস।

শিশির রায়

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৭ ০৮:১০
আক্রান্ত: রূপকথার হাড়মুড়মুড়ি ব্যারাম। ডেঙ্গির তুতো ভাই?

আক্রান্ত: রূপকথার হাড়মুড়মুড়ি ব্যারাম। ডেঙ্গির তুতো ভাই?

রোগের জীবাণুটি বহিরাগত। বাসে লেখা থাকে, ‘মালের দায়িত্ব আরোহীর’, এখন রাজ্য জুড়ে অদৃশ্য দেওয়াল-লিখন, ডেঙ্গির দায় বহিরাগতের। কে কোথা থেকে কী নিয়ে আসছে কে খেয়াল রাখছে। বহিরাগত রোগব্যামোর চিকিৎসা-পরিষেবা সরকার না-ই দিতে পারে। মুখব্যাজার করবেন না।

বহিরাগত তত্ত্ব নিয়ে নাড়াঘাঁটা করলেই দেখছি, ইতিহাসের ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়ছে আফ্রিকার বেড়াল। ‘ডেঙ্গি’ শব্দটাও বহিরাগত। আফ্রিকায় বহু অঞ্চলের মানুষের ভাষা সোয়াহিলি-র ‘ডিঙ্গা’ থেকে এসেছে। মূল শব্দ ‘কিডিঙ্গাপোপো’। শেক্সপিয়রের প্রসপেরো অবাধ্য ক্যালিবানের শায়েস্তায় পাঠাত ভূতপ্রেত, যাদের অস্ত্র ছিল গাঁটে ব্যথা, চিমটি-খামচি, জ্বালাপোড়া। আফ্রিকাতেও চালু ছিল বিশ্বাস, অশুভ আত্মা মানুষের উপর ভর করে, শরীরের পেশি আর গাঁটে যন্ত্রণা দিয়ে দগ্ধে মারে। আক্রান্ত মানুষের হাবভাব পালটে যেত, সেই দশারই নাম ‘কিডিঙ্গাপোপো’।

শব্দের দোহাই দিয়ে কালো মানুষের উপর রোগের দায় চাপালে অন্যায় হবে। ইতিহাস বলছে, আফ্রিকার ‘ডেঙ্গি’-তে মিশেছে স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসনের রংও। নতুন নতুন মুলুক জয়ে (পড়ুন দমন-পীড়নে) স্পেনীয়রা কার্যত পথিকৃৎ, ষোড়শ শতকেই উত্তর আটলান্টিকের অনেকটা তাদের মুঠোয়। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান মেশা স্প্যানিশে পাওয়া গেল ‘dengue’। মানেটা অদ্ভুত— ‘খুঁতখুঁতেপনা, বাড়াবাড়ি’। ডেঙ্গি-রুগিরা কাঠ-কাঠ হাঁটত, শাসকের ভাষা তা সইবে কেন? কৃত্রিম হাবভাবের মানুষকে ইংরিজিতে বলে ‘ড্যান্ডি’। রোগটিরও নাম হল ‘ড্যান্ডি ফিভার’।

সাহেবদের দাস বনে কালো আফ্রিকা পাড়ি দিল সাদা চামড়াদের দেশে। সেই সাহেবরাই গেল আমেরিকা, এশিয়া। সতেরো থেকে উনিশ শতকে নানা রঙের, পেশার, সংস্কৃতির মানুষ ছড়িয়ে পড়ল পালটে যাওয়া বিশ্বমানচিত্র জুড়ে। মানুষের গান, খাবার, পোশাক, উৎসব গেল ভিন ভুঁইয়ে। পৌঁছল জাহাজের দমবন্ধ খোলে সেঁধিয়ে, পায়ে হেঁটে, সাঁতরে।

পাড়ি দিল রোগজীবাণুও। দেখা যাচ্ছে, আঠেরো শতকের শেষে প্রথম স্বীকৃত ডেঙ্গি মহামারী হানা দিচ্ছে এশিয়া, আফ্রিকা আর আমেরিকায়, কাছাকাছি সময়েই! আমেরিকার অন্যতম স্থপতি বেঞ্জামিন রাশ-এর রিপোর্টে আছে প্রথম ‘কনফার্মড’ ডেঙ্গি-রোগীর কথা, ফরাসি বিপ্লবের বছরে! ডেঙ্গিকে তিনি বলেছিলেন ‘ব্রেকবোন ফিভার’। ঠাকুরমার ঝুলি-র ‘হাড়মুড়্‌মুড়ী ব্যারাম’ মনে পড়ে? রাক্ষসী রানির বিছানার তলায় শোলাকাটি, পাশ ফিরতে মড়মড়, রানির ভান যেন গায়ে অসহ্য ব্যথা। বেঞ্জামিন সাহেবের চিকুনগুনিয়ার সঙ্গে মুলাকাত হয়নি (ডেঙ্গির এই তুতো ভাইরাসটির আবিষ্কার ১৯৫২’র আফ্রিকায়, তার এগারো বছরের মাথায়, ’৬৩-তেই দমদম সহ কলকাতার বহু এলাকা এর প্রকোপে কাবু), এর লক্ষণ বরং ব্রেকবোন ফিভারের সঙ্গে মেলে বেশি।

ডেঙ্গি তাই শুধু এক রোগ নয়। দাসপ্রথা, অভিবাসন, মানুষের বিশ্বব্যাপী গতায়াতের উত্তরাধিকার সে। আর বাঙালি তো সব কিছুতেই রবীন্দ্রনাথ খোঁজে। রবীন্দ্রনাথেও ডেঙ্গি আছে। ‘প্রথম যখন আমাদের শহরে ডেঙ্গুজ্বর দেখা দিল, এই ব্যাধি আমার কাছে বেরিয়ে পড়ার মস্ত সুযোগের মতো এল। গঙ্গার ধারে পেনেটির বাগানে আমরা বাস করতে লাগলুম।...’ ১৯২২-এ লিখছেন তিনি। ডেঙ্গির ভয়ে ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা গঙ্গার ধারে লালাবাবুদের বাগানবাড়িতে থাকতে এসেছিলেন। তবে সেই ‘ডেঙ্গুজ্বর’ আজকের ডেঙ্গি ছিল কি না, থাকলেও তাকে ডেঙ্গি বলা যাবে কি না, গবেষকরা বলবেন।

কৃতজ্ঞতা: নীলোৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়

Dengue History ডেঙ্গি
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy