Advertisement
E-Paper

বাঙ্গালীর ইতিহাস

বৈষ্ণব ব্রাহ্মণের অনুরোধে জমি দিচ্ছেন বৌদ্ধ রাজা। সেখানে কায়স্থ, স্থপতি, বৈদ্য সবাই মিলেমিশে থাকেন। মহাকাল ও জৈমিনির উপাসনা হয়। কিন্তু নেই বুদ্ধ ও বিষ্ণুর পুজো। প্রাচীন বাংলা কখনওই এক ছাঁচে নিজেকে ঢালেনি। বিশ্বাস রেখেছে বহু পরিচিতিতে। চতুর্দশ শতকের আগে বাংলা বলে কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চল ছিল না।ভাষা হিসেবে বাংলার প্রাচীনত্ব মেরেকেটে খ্রিস্টীয় দশম-একাদশ শতকের আগে নিয়ে যাওয়া কঠিন। এই সময়ে বাংলা বলে কোনও এলাকা নেই। অথচ ইতিহাসবিদরা হামেশাই বাংলার ইতিহাস আলোচনা করেন। ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্টের আগে বাংলা বলতে এখনকার পশ্চিমবঙ্গ এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের এলাকা মিলিয়ে একটি অঞ্চল ছিল।

রণবীর চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
ঐতিহাসিক: বাংলাদেশের মহাস্থানে গোকুল মেড় প্রত্নস্থল। ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের ধর্মীয় স্থাপত্য। ছবি: দীপঙ্কর ঘোষ

ঐতিহাসিক: বাংলাদেশের মহাস্থানে গোকুল মেড় প্রত্নস্থল। ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের ধর্মীয় স্থাপত্য। ছবি: দীপঙ্কর ঘোষ

প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের মন মাতানো গান ‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই...’ বহু জনের মুখে মুখে ঘোরে। ‘বাংলা’ শব্দটির সঙ্গে একবার সপ্তমী, আর একবার ষষ্ঠী বিভক্তির হেরফের ঘটিয়ে ‘বাংলা’ কথাটি একাধারে একটি ভাষা এবং একটি ভূখণ্ডের অর্থবহ হয়ে যায়। এর ভিতর দিয়ে বাংলা ভাষা, বাংলা নামক এলাকা, ওই ভাষাটির ব্যবহারকারী হিসেবে বাঙালির পরিচিতি খুঁজে নেওয়া যায়। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে সরল এবং নিরীহ মনে হলেও তার ভিতরে পরতে পরতে জড়িয়ে আছে জটিলতা। সেই জটিলতা বুঝতে গেলে ইতিহাসের ভিতরে ঢুকতে হয়।

ভাষা হিসেবে বাংলার প্রাচীনত্ব মেরেকেটে খ্রিস্টীয় দশম-একাদশ শতকের আগে নিয়ে যাওয়া কঠিন। এই সময়ে বাংলা বলে কোনও এলাকা নেই। অথচ ইতিহাসবিদরা হামেশাই বাংলার ইতিহাস আলোচনা করেন। ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্টের আগে বাংলা বলতে এখনকার পশ্চিমবঙ্গ এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের এলাকা মিলিয়ে একটি অঞ্চল ছিল। এই ভূখণ্ডটি আয়তনে এখনকার ফ্রান্সের চেয়ে বড়। ব্রিটিশ আমলের ‘বাংলা’ নামক প্রদেশটির উদ্ভব মুঘলকালীন বাংলা সুবা থেকে। তার আগেও সুলতানি শাসনের সময় এই ভূখণ্ডটির ঐতিহাসিক পরিচিতি চতুর্দশ শতকের আগে নিয়ে যাওয়া মুশকিল। অথচ ‘বাংলা’ (ইংরেজি ‘বেঙ্গল’, অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় ‘বেঙ্গালা’) শব্দটির উৎপত্তি ‘বঙ্গাল’ থেকে। ‘বঙ্গ’ নামক জনপদের সঙ্গে ‘আল’ শব্দটি জুড়ে ‘বঙ্গাল’ কথাটির উৎপত্তি। ভাটির দেশ এই বঙ্গাল, প্রচুর বৃষ্টির কারণে এলাকাটি বছরের অনেক সময়ে জলমগ্ন। জল আটকানোর তাগিদেই আলের বহুল ব্যবহার সেই জনপদে। ‘বঙ্গ’ নামক জনপদ তথা ওই জনপদের বাসিন্দাদের উল্লেখ আছে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম-সপ্তম শতকের পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে, যদিও ভূখণ্ডটির প্রতি হেয় মনোভাব তাতে প্রকট। ‘বঙ্গ’ নামটির প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ‘বঙ্গ’— যার থেকে বঙ্গাল, তথা বাঙ্গালা শব্দটির উদ্ভব— কি সুপ্রাচীন কালে ১৯৪৭–এর অবিভক্ত বাংলা নামক এলাকাটির সমার্থক? এর স্পষ্ট উত্তর: না। ইতিহাসের নিরিখে আরও একটু তল্লাশি করা যাক।

চৈনিক পরিব্রাজক যুয়ান জাং (হিউয়ান ৎসাং) ৬৩৭ খ্রি: নাগাদ এই অঞ্চলে পরিভ্রমণ করছিলেন। প্রধানত বৌদ্ধ বিহারগুলি দেখার তাগিদে। তাঁর বিবরণ অনুযায়ী তিনি কজঙ্গল (রাজমহল অঞ্চল) থেকে যান পু্ণ্ড্রবর্ধন, (পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উত্তরভাগ) তার পর কামরূপ (ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অসম), সেখান থেকে সমতট (বাংলাদেশের নোয়াখালি-কুমিল্লা এলাকা)। তার পর তাম্রলিপ্ত (পূর্ব মেদিনীপুর), সব শেষে কর্ণসুবর্ণ (শশাঙ্কের রাজধানী, মুর্শিদাবাদ জেলা)। পরে তিনি যাত্রা করেন ওড্রদেশে (ওড়িশা)। এর মধ্যে পাঁচটি জনপদের উল্লেখ আছে। কিন্তু বাংলা নামক একটি নির্দিষ্ট এলাকা কই?

এর চার শতাব্দী পর দাপুটে দক্ষিণ ভারতীয় রাজা রাজেন্দ্র চোল (১০১২-১০৪৪ খ্রি:) গাঙ্গেয় এলাকা জয় করলেন ১০২৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, তাই তাঁর উপাধি গঙ্গৈকোণ্ড (গাঙ্গেয় অঞ্চল বিজেতা)। রাজেন্দ্রের হাতে পরাজিত শাসকেরা হলেন তণ্ডবুত্তি (দণ্ডভুক্তি: দাঁতন, মেদিনীপুর) তক্কনলাঢ়ম্‌ (দক্ষিণরাঢ়), উত্তিরলাঢ়ম্‌ (উত্তররাঢ়) এবং বঙ্গাল-এর (বরিশাল-ঢাকা-বিক্রমপুর, বাংলাদেশ) শাসকেরা। এঁদের মধ্যে পালবংশীয় প্রথম মহীপালও আছেন। তিনি কিন্তু সমগ্র বাংলার শাসক নন। অন্য দিকে বঙ্গালের শাসকও বাংলার একটি স্থানীয় শক্তি মাত্র। রাজেন্দ্র চোলও তাই বাংলা জয়ের কথা বলেন না। তিনি বরং গাঙ্গেয় এলাকায় সফল অভিযানের কৃতিত্ব দাবি করেন।

অতএব, উনিশ শতক থেকে বাংলার অতীত অনুধাবনের যে নিরলস প্রয়াস শুরু হল, তার অনেকটাই জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ দ্বারা চালিত— সেখানে অবিভক্ত বাংলার এলাকাকে মাথায় রেখে সুদূর অতীতের প্রেক্ষাপটেও সেই বড় এলাকাটিকে বাংলা বলে ইতিহাসবিদরা চিহ্নিত করে দিলেন। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা (ভারতের অঙ্গরাজ্য) এবং জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের সমাহারে একটি এলাকাকে উনিশ ও বিশ শতকের মাপকাঠিতে বাংলা তথা বেঙ্গল হিসেবে অভিহিত করা হল।

কিন্তু ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের আগে এই রকম একীকৃত নিটোল একটি ভূখণ্ড হিসেবে বাংলার অস্তিত্ব নেই। ছিল পাঁচটি উপবিভাগ: ১) পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধন (অবিভক্ত বাংলার উত্তরাংশ), ২) রাঢ় (ভাগীরথীর পশ্চিম এলাকা যার অনেকটাই পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত) ৩) বঙ্গ (বাংলাদেশের ঢাকা-বিক্রমপুর-ফরিদপুর), ৪) সমতট (বাংলাদেশের নোয়াখালি-কুমিল্লা এলাকা) এবং ৫) হরিকেল (চট্টগ্রাম ও সন্নিহিত এলাকা, বাংলাদেশ)। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের আগে এই পাঁচটি উপবিভাগের উপর কোনও একটি রাজশক্তির রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিল না। সামাজিক, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে উপবিভাগগুলির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সাদৃশ্য যে এই বিভাগগুলির মধ্যে একেবারে নেই তা নয়। কিন্তু ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে বৈচিত্র সুপ্রচুর। অর্থাৎ আঞ্চলিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন বাংলার অবস্থা একই সঙ্গে প্রাণবন্ত এবং জটিল। তার স্থানিক লক্ষণগুলির বিশেষ তাৎপর্য আছে।

প্রাচীনতম পর্ব থেকে ১২০০-১৩০০ খ্রি: পর্যন্ত বাংলা নামক ভূখণ্ডটির বহুমাত্রিক এবং জটিল অবস্থাটিকে পর্যালোচনা করার ও ফুটিয়ে তোলার আগ্রহে বাংলাদেশের এশিয়াটিক সোসাইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন। ‘হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ’ এই গ্রন্থাবলিতে এ পর্যন্ত আলোচিত ও প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত এবং স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের গত চার দশকের ইতিহাস। ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের এই সারস্বত প্রতিষ্ঠানটি এ বার উদ্যোগ নিয়েছেন বাংলার আদিপর্বের ইতিহাস রচনায় এবং তার পুনর্মূল্যায়নে। বলাই বাহুল্য, নিছক জাতিরাষ্ট্রের মাপকাঠিতে এই সুদূর অতীতকে ধরা অসম্ভব। কারণ তখন জাতিরাষ্ট্রের অস্তিত্বই ছিল না। তাই গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই ভূখণ্ডের উপবিভাগগুলির সম্যক ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করাই দুই খণ্ডে বিধৃত গ্রন্থটির প্রধান লক্ষ্য। গোটা উপমহাদেশে এটি একমাত্র অ়ঞ্চল যা উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে সাগর পর্যন্ত প্রসারিত। জীবনের প্রায় এমন কোনও দিক নেই, যা সুদূর অতীতকাল থেকেই বাংলার নদনদী দ্বারা প্রভাবিত হয়নি।

বাংলাদেশের তরফে এই পদক্ষেপ নেওয়া হল, অথচ তা বাংলাদেশের বর্তমান ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে যে আটকে রাখা হল না, তাতে ইতিহাসবোধ যথাযথ মান্যতা পেয়েছে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি সিরাজুল ইসলামের সম্পাদনায় দশ খণ্ডে, ইংরেজি ও বাংলায় আলাদা করে ‘বাংলাপিডিয়া’ নামে যে কোষগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন, সেখানেও জাতিরাষ্ট্রের মাপকাঠিতে আলোচনা আটকে রাখা ছিল না। সেই প্রাথমিক প্রয়াসের পূর্ণতর পরিণত রূপ পাওয়া যাবে নতুন প্রকাশনাটিতে। যে উদ্দেশ্যে মহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং আহমেদ হাসান দানীর উদ্যোগে ঢাকায় এশিয়াটিক সোসাইটি গড়ে উঠেছিল, তাকে অন্তত আংশিক বাস্তবায়িত করাও এই নতুন ইতিহাস গ্রন্থটির আদর্শ। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসচর্চায় যাঁদের ভূমিকা অগ্রপথিকের, তাঁদের গবেষণা নতুন ইতিহাস গ্রন্থটির জন্য একই সঙ্গে ভিত্তি এবং প্রস্থানপর্ব। কালিদাস দত্তের কৃতিত্ব যেমন স্মরণীয় এ ক্ষেত্রে, একই ভাবে উজ্জ্বল হয়ে থাকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাধাগোবিন্দ বসাক, রমেশচন্দ্র মজুমদার, বিনয়চন্দ্র সেন, সরসীকুমার সরস্বতী, নীহাররঞ্জন রায়, দীনেশচন্দ্র সরকার, ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের অসামান্য অবদান।

বস্তুত, রাজশাহির বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি এবং কলকাতার দুটি প্রতিষ্ঠান— বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, এশিয়াটিক সোসাইটি— না থাকলে এই জাতীয় প্রয়াস নেওয়াই অসম্ভব হত। অগ্রজ ইতিহাসবিদরা উনিশ এবং বিশ শতকে বাংলার অতীত উদ্ধারে ব্রতী হয়েছিলেন পরাধীন দেশের লুপ্ত গৌরব দর্শানোর অভীপ্সায়। বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের ইতিহাসচেতনাও তাঁদের অনেকাংশেই উদ্বুদ্ধ করেছিল। তারই ফসল রাখালদাসের ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’, রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ (প্রথম খণ্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এবং নীহাররঞ্জন রায়ের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’। গ্রন্থগুলির শিরোনাম থেকে বোঝা যাবে, নীহাররঞ্জন ছিলেন তাঁর সমকালীন ও পূর্বসূরি ইতিহাসবিদদের ধারণা এবং রীতিপদ্ধতির থেকে অনেকটাই আলাদা। তাঁর প্রধান অন্বিষ্ট অতীতের সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক জীবন, রাজবৃত্ত সেখানে গৌণ।

ইতিহাস রচনায় শেষ কথা বলে কিছু নেই, ইতিহাসের চূড়ায় সত্য প্রতিষ্ঠা করাও অসম্ভব। তাই নতুন আবিষ্কৃত তথ্যের আলোকে, অতীতের বাংলা নিয়ে নতুন কথা বলার সুযোগ যথেষ্ট। সেই কারণেই এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ দুই খণ্ডে ইংরেজিতে (অদূর ভবিষ্যতে বইটি বাংলাতেও প্রকাশিত হবে) বাংলার সুপ্রাচীন অতীতের সামগ্রিক আলোচনায় উদ্যোগী হয়েছেন। টাটকা, আকর তথ্য গত চার দশকে পরিমাণে বেড়েছে, আকর তথ্যের রকমফেরও উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে পুরাতাত্ত্বিক তথ্যপঞ্জি, লেখমালা, মুদ্রা এবং শিল্পসম্ভারের তথ্য উদ্ঘাটনে এ-পার ও-পার দুই বাংলাতেই বহু নতুন কথা জানা গিয়েছে। তাই পুরাতন এবং নব্যপ্রস্তর যুগে— বিশেষত লিখিত উপাদান আসার আগে— বাংলার মানুষের জীবন, জীবিকা, সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির ছবি আগের তুলনায় বদলে যেতে বাধ্য।

দুইটি বিষয়ে মন্তব্য এখানে দরকারি। প্রস্তর যুগে এবং তাম্রাশ্মীয় আমলে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্ন সামগ্রীর সঙ্গে বিহার ও ঝাড়খণ্ডের সাযুজ্য যেমন দেখা যায়, তেমন বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব এলাকার অতি প্রাচীন হাতিয়ার এবং তৈজসপত্রের সঙ্গে উত্তরপূর্ব সীমান্তবর্তী অ়ঞ্চল এবং মায়ানমারের বস্তুগত সংস্কৃতির তালমিলও নজরে পড়বে।

দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক গবেষণা পদ্ধতি অনুযায়ী পুরাবস্তু কেবলমাত্র প্রাগিতিহাসের মানুষকে বোঝার জন্য জরুরি নয়। লিখিত তথ্যরাজি থাকলেও উৎখনন এবং অনুসন্ধান থেকে পাওয়া প্রত্নবস্তুর সাক্ষ্য একান্ত প্রয়োজন নগরায়ণ বোঝার জন্য। তাই বাংলার প্রাচীনতম তিনটি নগরের পরিচয় পাওয়া যাবে বাণগড় (পশ্চিমবঙ্গ), মহাস্থান (বাংলাদেশ) এবং ওয়াড়ি বটেশ্বর-এর (ঢাকার কাছে) উৎখনন থেকে। অনেকগুলি লেখ এবং তাম্রশাসনের পাঠোদ্ধার করা হয়েছে সাম্প্রতিক দশকগুলিতে। আগে ইতিহাসবিদগণ মূলত লেখ/তাম্রশাসনের সাক্ষ্য ব্যবহার করতেন রাজবংশের ইতিহাস লেখার জন্য। এখন লেখমালার আলোকে রাজবৃত্ত ছাড়াও নিয়মিত রচিত হয় সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস।

একটি-দু’টি উদাহরণ দেওয়া যাক। ৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুরের চন্দ্রবংশীয় শাসক শ্রীচন্দ্র (৯২৫-৭৫ খ্রি.) শ্রীহট্টে এক বিশাল ব্রাহ্মণ নিবেশন (‘ব্রহ্মপুর’) তৈরি করার জন্য তাম্রশাসন জারি করে জমিজমা দিলেন। ছয় হাজার ব্রাহ্মণের বসতির ব্যবস্থা হল সেখানে। কিন্তু ব্রাহ্মণ তো কায়িক শ্রম করেন না। তাই জমি বরাদ্দ হল কায়স্থ (করণিক) গণক (হিসাবরক্ষক), স্থপতি, বৈদ্য প্রভৃতি পেশাদারদের জন্য। তারই সঙ্গে থাকলেন বহু কর্মকার, কুম্ভকার, শঙ্খবাদক, ঢক্কাবাদক, নাপিত, কর্মকার, এমনকি ভৃত্য (কর্মকর) এবং দাসী (চেটিকা)। উপাস্য দেবতাদের মধ্যে আছেন বিরলদর্শন ব্রহ্মা। সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক হল অগ্নি, মহাকাল, যোগেশ্বর এবং জৈমিনীর (শেষোক্ত জন পূর্বমীমাংসাকার দার্শনিক, দশম শতকে শ্রীহট্টে দেবতায় পর্যবসিত) উপাসনা। উপাস্য দেবতা অভিন্ন হলেও দুটি ভিন্ন মঠে তাঁদের আরাধনার ব্যবস্থা হল: একটি বঙ্গালদেশীয়দের মঠ, অপরটি দেশান্তরীয় মঠ। বাইরে থেকে শ্রীহট্টে লোক এসেছিল, তা বোঝাই যায়। হয়তো কিছু সামাজিক-সাংস্কৃতিক টানাপড়েনও ঘটে থাকবে, তাই ভিন্ন ভিন্ন মঠে অভিন্ন দেবতাসমূহের আরাধনার এক বিচিত্র নজির রয়ে গেল। লক্ষণীয় যে, রাজা শ্রীচন্দ্র বৌদ্ধ; যাঁর বিশেষ অনুরোধে ব্রহ্মপুরের জমি মঞ্জুর হল, তিনি এক বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ। অথচ ব্রহ্মপুরে উপাসনার ব্যাপারে বুদ্ধ ও বিষ্ণুর উপস্থিতি পর্যন্ত নেই। এক বহুমাত্রিক রংদার এবং জটিল পরিস্থিতির সাক্ষ্য এখানে হাজির।

ধর্মাচরণের জন্য নিষ্কর ভূসম্পদ দেওয়ার রাজকীয় তথা প্রশাসনিক দলিলের সংখ্যা প্রচুর। পুণ্ড্র এবং রাঢ় এলাকায় এক জন বা কয়েক জন ব্রাহ্মণের উদ্দেশে নিষ্কর জমি দেওয়ার নজির বেশি, মেঘনা নদীর পূর্ব দিকে একই রকম ভূমিদানের ক্ষেত্রে প্রবণতা ভিন্ন। দানগ্রহীতা সাধারণত কোনও ব্যক্তি নন, বরং কোনও ধর্মপ্রতিষ্ঠান (মঠ বা বিহার)। জমি দানের দলিলের একেবারে শেষ দিকে জমির সীমানা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি বিবরণ থাকে। আপাত-নীরস সেই তথ্য নিষ্কাশন করে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় যে অভিনব গবেষণা করেন, তা থেকে গ্রামীণ এলাকার বসতি-বিন্যাস মূর্ত হয়ে ওঠে। গ্রামগুলি দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন, আবদ্ধ এবং স্বয়ম্ভর নয়, বরং একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং পরস্পর নির্ভরশীল ছিল। তাই এই সিদ্ধান্তটি চমকে দেওয়ার মতো।

আঞ্চলিক বৈচিত্রের আর এক উদাহরণ মুদ্রা ব্যবস্থায়। খ্রি: ষষ্ঠ-সপ্তম শতক থেকে বাংলার স্বর্ণমুদ্রায় খাদের পরিমাণ বেড়েই চলেছে, অষ্টম শতক থেকে সোনার টাকা কার্যত উধাও হয়ে গেল। নীহাররঞ্জন রায় এবং রামশরণ শর্মা স্বর্ণমুদ্রার অদর্শনে দূরপাল্লার সমুদ্রবাণিজ্যের অধোগতি দেখেছিলেন। পাল-সেন বংশীয় রাজারা মুদ্রা জারি করায় অনীহা দেখালেও, সমতট-হরিকেল অ়ঞ্চলে সপ্তম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত উচ্চমানের রৌপ্যমুদ্রার ব্যবহার ছিল অব্যাহত। দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য উপাদান ছিল কড়ি। এই কড়ি কিন্তু বাংলায় পাওয়া যায় না। তা আসত সুদূর মলদ্বীপ থেকে জলপথে।

দৈনন্দিন জীবনের যে ছবি এক কালে ফুটিয়েছিলেন নীহাররঞ্জন রায়, তা বর্তমানে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে চন্দ্রকেতুগড়, তাম্রলিপ্ত এবং ময়নামতী (কুমিল্লা, বাংলাদেশ) থেকে আবিষ্কৃত ভূরি পরিমাণ পোড়ামাটির ভাস্কর্যের দ্বারা, যাতে শিল্পের দেশজ ছাপটি বিধৃত। শিল্পকলা তো বটেই, ধর্মীয় জীবন বোঝার জন্যও প্রতিমাগুলির উপযোগিতা প্রশ্নাতীত। ধর্মীয় জগতে বৌদ্ধধর্ম কী ভাবে ক্রমে গৌণ হয়ে গেল ব্রাহ্মণ্য-পৌরাণিক ভক্তিমূলক সম্প্রদায়ের দাপটে, তা-ও এক জটিল ও বর্ণময় কাহিনি। এখানে উল্লেখ করা উচিত, নালন্দা, বিক্রমশীলা এবং সোমপুর বিহার যখন অবসন্ন, তখনও কিন্তু ময়নামতী এবং চট্টগ্রাম এলাকায় বৌদ্ধধর্ম যথেষ্ট সজীব। অতি সম্প্রতি আবিষ্কৃত একটি লেখ জানান দেয় যে খ্রি: পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে কুমিল্লা-নোয়াখালি এলাকায় সক্রিয় ছিল আজীবিক নামক শ্রমণগোষ্ঠীর একটি ধর্মপ্রতিষ্ঠান। এর আগে বাংলায় আজীবিকদের উপস্থিতি এত স্পষ্ট ভাবে জানা ছিল না।

এই সব আনকোরা নতুন তথ্যের আলোকে, পূর্বসূরিদের কাজকে খতিয়ে দেখে নতুন কথা বলার সুযোগ তথা প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু এই কর্ম কোনও এক ব্যক্তির সাধ্যাতীত, এর জন্য দরকার সামূহিক প্রচেষ্টা। তাই এই কাজে শামিল হয়েছেন বাংলাদেশ, ভারত, জাপান, চিন, ফ্রান্স, জার্মানি ও মার্কিন দেশের বিশেষজ্ঞরা। প্রথম খণ্ডে থাকছে প্রাচীন জনগোষ্ঠী তথা কৌমগুলির পরিচয়— অনেকটাই নৃতত্ত্বের ভিত্তিতে। আর আছে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান-আশ্রিত দীর্ঘ আলোচনা। দ্বিতীয় খণ্ডে সন্নিবিষ্ট হয়েছে বর্ণ-জাতিতে বিভাজিত অসাম্য-চিহ্নিত সমাজ, নারীর অবস্থান, দৈনন্দিন জীবনযাপন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মুদ্রাব্যবস্থা, ধর্মীয়-জীবন (ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ এবং জৈন সম্প্রদায়), শিল্পকলার কথা (স্থাপত্য-ভাস্কর্য, চিত্রকলা, মূর্তিতত্ত্ব), সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (সংস্কৃত, প্রাকৃতে রচিত এবং অবশ্যই চর্যাপদের পর্যালোচনা)। থাকছে অনেকগুলি মানচিত্র এবং আলোকচিত্র। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপিকা রোমিলা থাপারের মুখবন্ধ এবং বিশিষ্ট অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রাককথন বইটিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।

জাতীয়তাবাদী জিগিরে যখন বিভেদ জাগিয়ে তোলা হচ্ছে, যখন বহুর মধ্যে এক খোঁজার মেঠো বুলি দিয়ে সব কিছু একাকার করে দেওয়ার দুরভিসন্ধি দেখা যাচ্ছে—তখন জাতিরাষ্ট্রের সঙ্কীর্ণ গণ্ডিকে অতিক্রম করার এ এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। আনন্দবাজার পত্রিকার দ্বাদশ বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে (১৯৩৩) রবীন্দ্রনাথ আহ্বান জানিয়েছিলেন: ‘স্বদেশেরে চাও যদি তারো ঊর্দ্ধ্বে ওঠো/ কোর না দেশের কাছে মানুষেরে ছোটো।’

জাতীয়তাবাদের চিৎকৃত এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের ওই উচ্চারণটিই দুই বাংলার ইতিহাসবিদদের এই উদ্যোগের চালিকাশক্তি।

(নামলিপির বানান ও অলঙ্করণ নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ গ্রন্থ অবলম্বনে)

History Language Bengali
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy