পরাধীন দেশে ফুটবল মাঠে বিদেশিদের সঙ্গে ভারতীয়দের খেলাকে ঘিরে উত্তাল জাতীয়তাবাদী আবহ তৈরি হত। বেতারের রিলে মারফত সেই উত্তেজনা দূর-দূরান্তে থাকা ভারতীয়দের মধ্যে আরও ছড়িয়ে পড়াটা যে স্বাভাবিক, সে সম্ভাবনার কথা ব্রিটিশ-পরিচালিত বেতার-কর্তৃপক্ষের ধারণাতেও নিশ্চয়ই ছিল। তাও তারা যখন এই অনুষ্ঠান শুরু করলেন, তাতে মনে হয়, ফুটবলের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে রেডিয়ো-সেটের বিক্রি বাড়ানো এবং তার মাধ্যমে বেশি লাইসেন্স-ফি রোজগারের দিকটাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন ব্রিটিশ কর্তারা। প্রসঙ্গত, রেডিয়োর শুরু থেকে সত্তরের দশকের কিছু সময় পর্যন্ত প্রত্যেক বেতার-গ্রাহককে প্রতি মাসে লাইসেন্স-ফি দিতে হত।
খেলার ধারাবিবরণী সম্প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে কর্তৃপক্ষের বিশেষ উদ্দেশ্য কাজ করেছিল। কলকাতায় যেমন ফুটবল জনপ্রিয়, তেমনই মুম্বইয়ে ক্রিকেট। তাই এখানে চালু হওয়া ফুটবল-ধারাবিবরণীর গ্রহণযোগ্যতা দেখে, ১৯৩৭ সালে মুম্বই-বেতার শুরু করল ক্রিকেট-ধারাভাষ্য। তখন মুম্বইয়ে হত পেন্ট্যাঙ্গুলার ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। সেই খেলার প্রথম ক্রিকেট-ধারাভাষ্য শুরু করলেন এ এফ এস ববি তালিয়ারখান। তুখোড় ইংরেজির দখলের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের আগ্রহ ধরে রাখার নৈপুণ্য ছিল তাঁর। মাইক্রোফোন শেয়ার করা পছন্দ করতেন না, ফলে লাঞ্চ এবং টি ছাড়া সম্পূর্ণ এবং নিরবচ্ছিন্ন ধারাভাষ্য দেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর।
ফুটবল ম্যাচের ধারাবিবরণী শুরু হত বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। তখনই খেলার শুরু। ৫০ মিনিটের ম্যাচ, মাঝে ১০ মিনিট বিরতি। খেলা শেষ হত সাড়ে ছ’টায়। সবই কিন্তু ‘কলকাতা সময়’-এর হিসেবে। তখন সারা ভারতে একই সময় অনুযায়ী কাজকর্ম হত না। ভৌগোলিক অবস্থান অনুসারে অঞ্চলভেদে সময় পাল্টে যেত। পরে কাজের সুবিধের জন্য ইলাহাবাদের সময়কে মাপকাঠি ধরে সারা দেশে ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম নির্ধারিত হয়। তখনকার ‘কলকাতা সময়’-এর চেয়ে প্রায় ২৪ মিনিট এগিয়ে এসেছে আইএসটি।
ফুটবল ম্যাচ ঘিরে তৈরি হওয়া জাতীয়তাবাদী বাতাবরণের ব্যাপারে বেতার-কর্তৃপক্ষ কিন্তু সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন না। বেতার কেমন চলছে বা আগামী দিনের পরিকল্পনা কী, এ সব নিয়ে তখন মাসে মাসে বেতারে বক্তব্য রাখতেন স্টেশন ডিরেক্টর, যা ‘স্টেশন ডিরেক্টরের নোটবুক হইতে’ শিরোনামে নিয়মিত প্রকাশিত হত ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকায়। ১৯৩০ সালের জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত স্টেশন ডিরেক্টরের বক্তব্যের এক জায়গায় বলা হচ্ছে —‘... মোহনবাগান ও ক্যালকাটা ক্লাবের ম্যাচ খেলা হয়নি বলে আমরা কিছু ঘোষণা করতে পারিনি, কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের কিছু হাত ছিল না। রাজনীতি খেলার ক্ষেত্র অবধি প্রসারিত হওয়ার ফলে এই খেলা বন্ধ হয়েছে। আমরা ঠিক সময়ে ঘোষণা করার জন্য মাঠে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেদিন খেলা হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়। যা হোক, আমরা সংবাদপত্র থেকে জানতে পেরেছি যে, ভারতীয় ক্লাবগুলি স্বেচ্ছাসেবিকাদের সঙ্গে এ সম্বন্ধে একটা আপস-নিষ্পত্তি করার জন্য চেষ্টা করছেন, যার ফলে তাদের খেলা হয়তো সম্ভব হবে। আমরা ডিসিএলআই ও লয়াল্স-এর খেলা ইতিপূর্বে ঘোষণা করেছি। এইসব ঘোষণা কীভাবে হচ্ছে বা কীভাবে হলে ভালো হয়, তা শ্রোতৃবর্গের কাছ থেকে জানতে পারলে বিশেষ খুশি হব।’ এখানে ‘ঘোষণা’ মানে ধারাবিবরণী। বক্তব্যের যেখানে রাজনৈতিক কারণে খেলা বন্ধ হওয়ার কথা রয়েছে, তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কী হতে পারে? ‘স্বেচ্ছাসেবিকা’ কথার উল্লেখ থেকে অনুমানে আসে, ১৯৩০ সালের ২২ জুন ঊর্মিলা দেবীর (দেশবন্ধুর বোন) নেতৃত্বে কংগ্রেসের ‘নারী সত্যাগ্রহী সমিতি’ আইন অমান্য কর্মসূচি পালন করে। বিরাট মিছিল হয় কলেজ স্কোয়ার থেকে দেশবন্ধু পার্ক পর্যন্ত। এই মিছিলে ভয়াবহ ভাবে চড়াও হয় ব্রিটিশ পুলিশ। সমিতির বহু স্বেচ্ছাসেবিকা সাংঘাতিক আহত হন। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এরই জেরে সম্ভবত ভারতীয় ক্লাবগুলি খেলা বয়কট করেছিল। স্টেশন-ডিরেক্টরের বক্তব্যের ধরন থেকে পরিষ্কার বেরিয়ে এসেছে ব্রিটিশসুলভ মনোভাব। বিশেষ করে যে ব্যাপারে উনি ব্যবহার করেছেন ‘আপস নিষ্পত্তি’-র মতো শব্দ— তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
এ ভাবেই চলছিল। ইংরেজিতে ফুটবল-ধারাবিবরণীর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা দেখে ‘ভারতীয়’ বিভাগের ডিরেক্টর নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদারের মনে হল, বাংলা ভাষাতেও এই ফুটবল-রিলে চালু করলে কেমন হয়? কিন্তু কে হবেন ধারাভাষ্যকার? বেতারের শুরুর দিন থেকেই ঘোষক ও সংবাদপাঠক হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন প্রখ্যাত ফুটবলার রাজেন সেনগুপ্ত, ১৯১১-য় শিল্ড জয়ী মোহনবাগানের সেন্টার-হাফ। তাঁর নামটাই প্রথমে এল। কিন্তু তিনি তখন ছুটিতে। তাই নৃপেনবাবু বাছলেন বেতার-ভাষ্যবিশারদ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে। কিন্তু তিনি আবার ফুটবলের কিছু বোঝেন না। মহা ঝামেলা! তাই খেলাপাগল রাইচাঁদ বড়ালকে, যিনি আবার বিশিষ্ট সঙ্গীতকারও, সাহায্যকারী হিসেবে জুড়ে দেওয়া হল বীরেনবাবুর সঙ্গে। দু’জনে গেলেন মাঠে। সেটা ১৯৩৪ সাল। বেতারে প্রথম বার সেই বাংলা ধারাবিবরণী কী বিচিত্র আকার নিয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘বেতার জগৎ’-এ প্রকাশিত বীরেন ভদ্ররই লেখা থেকে।
মাঠের ইউরোপীয় দর্শকে ভরা অংশে ধারাবিবরণী দেওয়ার জায়গা নির্দিষ্ট হয়েছিল, সেখানে বসে বীরেনবাবু বলা শুরু করলেন। পাশে থাকা রাইচাঁদবাবু সব বলে বলে যাচ্ছেন তাঁকে। কিন্তু মাঝে-মাঝেই তিনি খেলা দেখায় মশগুল হয়ে চুপ করে যাচ্ছিলেন। আর তখনই অসহায় বীরেন ভদ্র ধারাবিবরণীর মধ্যেই বলে উঠছিলেন, ‘ও রাই, বল না...’ ফুটবল তো তাঁর কাছে পুরোটাই ধোঁয়াশা। তাই এই আকুতি। ধারাভাষ্যের এই হাল দেখে আশপাশে থাকা বিদেশি দর্শকরা হেসে লুটিয়ে পড়ছিলেন। সে এক লজ্জাকর অবস্থা! এক বার তো চরম কেলেঙ্কারি করে ফেললেন বীরেনবাবু। গোলকিপার হাত দিয়ে বল ধরেছে, আর তিনি বলে উঠলেন ‘হ্যান্ডবল’। রাইচাঁদবাবু-সহ চার পাশে থাকা সবাই তো হেসে অস্থির। বীরেনবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হল রাই?’ রাইচাঁদবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘হল তোমার মুন্ডু! গোলকী হাতে ধরলে হ্যান্ডবল হয় রে গাধা?’ যাই হোক, এ রকম অভিনব বাংলা রিলের মধ্যেই সে দিনের ম্যাচ শেষ হল। বেতারকেন্দ্রে পা দিয়েই রাইচাঁদের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে নৃপেন মজুমদারকে বীরেন ভদ্র বললেন, ‘এরকম বুদ্ধিমান লোকদের আমার সঙ্গে পাঠাবেন না মশাই, একটা কথা বজ্জাতি করে বলে না, আবার উল্টে হাসে।’ নৃপেনবাবুও তো সব শুনে হাসি চাপতে পারলেন না। এই ঘটনা প্রাথমিক ভাবে মজার হলেও পাশাপাশি কিছু কথা মনে আসে। যখন চার দিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিবেশ, তার কোনও কিছুর প্রভাব যে ব্রিটিশ-পরিচালিত বেতার-সংস্থায় থাকবে না, সেটাই স্বাভাবিক। অনুমান করাই যায়, সেই সময়ে বেতারের ভারতীয় কর্মীদের মধ্যে এ বিষয়ে যথেষ্ট অস্বস্তি ছিল। অথচ, করারও কিছু নেই। তাই যখন ফুটবল ঘিরে ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে, তার প্রভাব দু’জন দেশীয় ভাষ্যকারের মধ্যে পড়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু, ধারাভাষ্যে সেই মনোভাবের লক্ষণ দেখানো চলবে না। উপরন্তু, তাঁরা বসেছেন ইউরোপীয় দর্শকদের মধ্যে। সব মিলিয়ে মনে হয়, সে দিনের এই কাজটি হয়তো বীরেনবাবুদের কাছে যথেষ্ট বিড়ম্বনারই ছিল। তাই হয়তো, ১৯৩৪ সালে ওই এক বার ছাড়া, পরাধীন ভারতে দ্বিতীয় বার আর বাংলায় ক্রীড়া-ধারাভাষ্যের প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। সে দিনের ধারাবিবরণীর বাহ্যিক ব্যর্থতাই হয়তো এর একমাত্র কারণ নয়।
এর ১৪ বছর পর, ১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বার বেতারে সম্প্রচারিত হল বাংলা ক্রীড়া-ধারাভাষ্য। সে বার চিনা ফুটবল দল কলকাতায় এসে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান ও আইএফএ একাদশের বিরুদ্ধে চারটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে। প্রত্যেকটি খেলার ইংরেজি ধারাবিবরণীর পাশাপাশি শুধুমাত্র ইস্টবেঙ্গল বনাম চিনা দলের ম্যাচটির বাংলা ধারাবিবরণী সম্প্রচার করে কলকাতা বেতার। দিনটা ছিল ১৪ জুলাই, ১৯৪৮। বাংলায় ধারাভাষ্য দিয়েছিলেন বহুমুখী প্রতিভাধর খেলোয়াড় (ফুটবল-ক্রিকেট-টেনিস) নির্মল চট্টোপাধ্যায়। ক্রিকেটে আন্তর্জাতিক মানের নয়নাভিরাম ব্যাটিং-এর জন্য এঁকে বলা হত ‘বাংলার মুস্তাক আলি।’ কিন্তু, সে দিনের ধারাভাষ্যে ইনি সফল হননি। নির্মলবাবুর রিলে খেলার গতির সঙ্গে ঠিক তাল মেলাতে পারছিল না। সুতরাং, দ্বিতীয় বারের চেষ্টাও দানা বাঁধল না।