Advertisement
E-Paper

পুরভৌটিক

সব ভোটের সেরা পুরভোট। কারণ ক্যান্ডিডেটরা খুব চেনা— বুবাই, মনা, ভুটু। আর লোকে জেতে মাত্তর সতেরো বা চুয়ান্ন ভোটে।সব ভোটের সেরা পুরভোট। কারণ ক্যান্ডিডেটরা খুব চেনা— বুবাই, মনা, ভুটু। আর লোকে জেতে মাত্তর সতেরো বা চুয়ান্ন ভোটে।

সুশান্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৫ ০১:০৪
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

সকলই ফেস্টিভেল! চোত-সেল বলুন, কিংবা মাঃ-উঃ মাঃ-র টুকলি শেল, বা ধরুন বাংলা আলুর অসাম্‌ খেল, অকালবোধন আইপিএল— সব, সবই বিপুল মোচ্ছব এখন। খাওদাওশোও। কিন্তুন, কেস যখন ভোটেল, তখন এ দুনিয়া যেন এক বিরাট নিখরচার হোটেল!

যারা বলে, এক দিন বাংলা ভাষা বলে আর কিছু রহিবে না— তাদের জেনে রাখা ভাল, যদ্দিন এই নির্বাচন-ভাষণ-লিখন-কলম থাকিবে, তদ্দিন অন্য ভাষার সনে বাংলা বহাল তবিয়তে রহিবে। সব সেক্টরেই দ্যাখেন বেঙ্গলি ভাষাটা কেমন কুনঠাসা, কুণ্ঠিত— কেদারাকে তো কবেই হেঁটোর গুঁতো মেরে ‘চেয়ার’ বসে, বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয় শুধু ইসকুল কলেজের ফটকেই ফোটো হয়ে গেছে; কদ্দিন পর রসগোল্লাকেও নির্ঘাত ‘লাড্ডু’ শুনবেন। কিন্তু এই ভোট উৎসবে? বাংলা, জাস্ট বাংলা।

লিখনে-বলনে সবেতেই। এই ধরেন না, ভোট-ইলেকশন-এর সনে সমান তালে ‘আসন্ন নির্বাচন’-এর তবিয়ত ঠিকই আছে। ক্যান্ডিডেট আছেন, তো প্রার্থীও। থাক না সিট, আসন নেই কি না বলুন। ফল থাকবে, রেজাল্টও; বিপুল ভোট, নির্বাচন কমিশন, ভোট গ্রহণ কেন্দ্র, লাঠি-মেশিন-মাল-টিফিন-ডিম-বিরিয়ানি-পাউরুটি, সবার সঙ্গে মিলেমিশে বাংলা আছে। লিড-ময়দান-দখল-হাত-হাতুড়ি-ফুল-ঘাস-পানীয় জল-হকার-নিকাশি-ড্রেন-অসংগঠিত; আর শেষমেশ কিছু না থাক এই ভোট উপলক্ষে বেকার-শিশু শ্রমিক-বার্ধক্য-মহিলা-নির্যাতন এবং সংগঠন— থাকবেই থাকবে! আপনি বলবেন, ওই বিখ্যাত সাম্রাজ্যবাদ-সাম্প্রদায়িকতা-চক্রান্ত-জোট-আঁতাত— এইগুলান বাদ দিলুম কেন? এক্সপায়ারি ডেট এসে গিয়েছিল!

তবে হ্যাঁ, সমস্যা কিছু থাকবেই। ‘পবলেম’ও থাকবে। যেমন পূর্ববঙ্গের স্মৃতিমাখা হৃদয়ের অধিকারী ওই লোকাল নেতাটি হেব্বি জ্বালাময়ী ভাষণের শেষে তো নিজ শ্রীমুখেই উরুশ্চারণ কল্লেন, ‘যাই হোক এই পুরুভোটে আমাদের পাত্থিদেরকে কাজের মানুষ কাছের মানুষদেরকে বিপুল ভোটে নির্বাসিত করেন— এই আসা রাখসি...’

ওহ্, আর একখান কথা ছিল। আমরা কিন্তু আজ অনেক কিছুই শিখে গেছি। যেমন, কেউ আর বলেন না, ‘চুল কাটতে যাচ্ছি’ বা ‘গাড়িতে তেল ভরতে যাচ্ছি’। এখন আমরা শিখেছি, চুল ‘কাটাতে’ বা তেল ‘ভরাতে’ হয়। কিন্তু আমরা কেউ কেউ এখনও একটা গন্ডোয়ানা যুগের ধারণা বয়ে বেড়াচ্ছি— ‘ভোটটা দিয়ে আসি।’ মানে? আপনি আর কবে বুঝবেন দাদু, চুল কাটানো, তেল ভরানোর মতোই ভোট ‘করানো’ হয়! হ্যাঁ! ঠোঁটকাটা নেতারা তো প্রকাশ্য দিবালোকেই বলেন, ‘সাধু-সন্ন্যাসী বা দাড়িওয়ালা কবিদের দিয়ে তো আর ভোট করানো যায় না!’ বা ‘মনে রাখবেন, এখানে ভোটটা আমিই করব!’ তবে! এখনও বলিবেন— আই কাস্ট মাই ভোট! আমি ভোট দেব! আরে বাবা, আপনাকে ভোটটা ‘দেওয়াবে’! ভোটটা দিয়ে ‘আসাবে’!

এ সব জেনে যদি আপনি সিদ্ধান্ত করেন, অমূল্য ভোটটি দিবেন না, সেটা কিন্তুন ভাল হইব না। কারণ, আপনাকে এই ক’দিন আগেই অ্যাসিড বাপি, জিভকাটা কেলো, মুখপোড়া খোকন অতীব মোলায়েম স্বরে বুঝিয়ে গেছে না, ‘মাসিমা আপনার ইটা গণতান্তিক ওদিকার!’ তাই এই ‘ওদিকার পোয়োগ’ না করিলে জানেন তো পিসি, আপনি অনুপ্রবেশকারী, মাওবাদী, রাষ্ট্রদ্রোহী— কত কী!

যাই বলেন কমরেড, সব ভোটের সেরা পৌর নির্বাচন। অন্তত আমার কাছে। তার মূল কারণ, এখানে ক্যান্ডিডেটগণ ভীষণ ভীষণ চেনা। তাদের টোটাল বায়োলজিকাল ডেটা জানা। সেই জন্যেই তো ব্যানারে ব্যানারে তাদের নামের পাশে ইয়া ব্র্যাকেটে জ্বলজ্বলিং আদুরে ডাকনাম। কেউ সান্টা, কেউ ভোঁদা, কেউ কাছের মানুষ কাজের মানুষ: নাটা গোপ‌্লা!

এই ভোট ভালবাসার আরও বড় কারণ, এখানে কেউ তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে তিন লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার ব্যবধানে পরাজিত করেন না। ডিফারেন্স হয় একশো তিপ্পান্ন বা বা দুশো সত্তর ভোট— মাঝেমাঝে টাই-ও হয় গো। মানে একেবারে লাস্ট বলে আউট হতে হতে ডাইভ দিয়ে ক্রিজে! তখন মনে হয় আইব্বাপ, আমার ভোটটা যদি ইট্টু ইদিক-ওদিক হত! ওতেই তো ডিসিশন হল! ওহ্‌! প্রকৃত গণতন্ত্রের ভুরভুরে ফ্লেভার এই পুর-ভোটেই!

আর আমার চৌত্রিশ পুরুষের সৌভাগ্য, আমাদের ওয়ার্ডে যাঁরা দাঁড়ান, সব্বাই প্রায় দেবতুল্য মাস্টারমশাই-অধ্যাপক-ফেয়ার প্রাইস শপের মালিক-পুর কন্ট্রাকটর। এঁরাই পথ দেখান। গলা নামিয়ে বলেন, বুঝতেই তো পারছেন, আমরা তো আর রেল-বিল্টু বা গেঁড়ে-কেষ্ট নই! সে তো বটেই! রেল-বিল্টু অমন নাটকীয় ভাবে গলাও নামাতে পারে না, আর ডায়ালগে ছবি বিশ্বাস মার্কা মিনতি-কাম-হুমকির অলৌকিক ঠান্ডা-গরমও মেশাতে পারে না, অর্ডারি লস্যির মতো!

সেই আমার পেথম পুর-ভোটের দিন! এট্টু বেশি বয়সে নাম উঠেছে তো! এক ভৌটিক টানে সেই বিখ্যাত ক্ষুধিত পাষাণ বুথের দিকে ধাবমান। সকাল সকাল। দাঁতের দুকান সাজিয়ে। আরে বাপ! কত পতাকা-ফেস্টুন-শিকলিময় আমার এই চেনা রাস্তাটা একেবারে কার্নিভ্যালি হয়ে উঠেছে। মাঝেমাঝে ওপর থেকে ঝোলানো পতাকা কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমি আলতো হাতে সরিয়ে দিচ্ছি, যদি ছিঁড়ে পড়ে যায় তো গেলাম। শ্লা, ওদের ভোটার হয়ে গেছে রে। ধরিয়ে দে। দিশি পুলিশ দিয়ে খাওয়া!

কিন্তু না, আমি সব বাধাকে ড্রিবল করতে করতে এগ্গে যাই। আর কী খাতির, কী খাতির! দাদাকে চা দে রে, বউদিরা কখন আসবেন, ভাইপোটার জ্বর সেরেছে? দু’পক্ষই। না না মিছে বলব না, এমন যত্ন, এমন আত্তি আমার স্ত্রীর বাবার বাড়িতেও কখনও পাইনি। শুধু একটাই আপশোস, দু’পক্ষকে তো দিতে পারব না, মানে পারানো যাবে না!

এট্টু ইমোশনাল হয়ে ভোট গ্রহণ কেন্দ্রের সামনে পৌঁছতেই দুই প্রার্থীই কুশল বিনিময় কল্লেন। আহা, এই হল আসল গণতন্ত্র। লড়াই তো হবে মেশিনে! মানুষ কেন লড়তে যাবে, মরতে যাবে!

ট্রেনে-বাসে ঠিক স্টপেজে নামতে পারা আর ভোটকক্ষের মেশিনে ঠিক বোতামটা টিপতে পারা— এ আমার বরাবরের টেনশন।

হ্যাঁ, পেরেছি, মানে পারানো হয়েছে। এ বার ঘরের ছেলের ঘরে ফেরার পালা। আবার খাতির খেতে খেতে ঘরে ফিরে টিভি দেখব।

বুথের বাইরে বেরিয়েই পরিচিত দুই প্রার্থীর সনে দেখা। দুজনকেই ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা কল্লাম— ঠিকঠাক দিয়েছি। কিন্তু অবাক কাণ্ড, আমার পানে কেউই তো তাকাচ্ছেই না! এ-ও হয়! ঝুলন্ত পতাকার কাপড়গুলো হাওয়ায় উড়ছে, কিন্তু একটু ওপরে। আমি তো ওগুলোকে ছুঁতে পারছি না!

আচ্ছা, আমাদের ভোটকেন্দ্রে যদি কোনও অনিয়ম হয়, গন্ডগোল হয়— তবে তো ফের ভোট হবে। শুনেছি অনেক জায়গাতেই তো এমন হয়।

আহা, ঈশ্বর তোকে জোড়া পাঁঠা দেব, যদি আমার বুথে রি-পোল হয়। মানে, আমি আবার কয়েক মুহূর্ত হলেও রি-লাইফ পাব, বাঁচা পাব, তোয়াজ, পাত্তা— আবার।

susantaghosal68@gmail.com

sushanta ghosal municipality poll 2015 kmc election 2015 vote scenario robibasoriyo robibasoriyo feature
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy