Advertisement
E-Paper

এক-এক কিকে দু’তিন জনকে ঘায়েল করলাম

আমার প্রথম ছবি ওড়িয়া ভাষায়। ছবির নামটা বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘কালোমানিক’। ওড়িয়াতে তো ‘ল’ ধ্বনিটা নেই। তাই উচ্চারণ হবে ওই ‘ল’ আর ‘ড়’-র মাঝামাঝি কিছু। সিনেমার নামটা তাই হবে কলামানিকো বা কড়ামানিকো— এই রকম। আমার উলটো দিকে তখন ওড়িশার এক নম্বর হিরো, সিদ্ধান্ত। সময়টা ১৯৯৭।

শ্রীলেখা মিত্র

শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
কলামানিক

কলামানিক

আমার প্রথম ছবি ওড়িয়া ভাষায়। ছবির নামটা বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘কালোমানিক’। ওড়িয়াতে তো ‘ল’ ধ্বনিটা নেই। তাই উচ্চারণ হবে ওই ‘ল’ আর ‘ড়’-র মাঝামাঝি কিছু। সিনেমার নামটা তাই হবে কলামানিকো বা কড়ামানিকো— এই রকম। আমার উলটো দিকে তখন ওড়িশার এক নম্বর হিরো, সিদ্ধান্ত। সময়টা ১৯৯৭।

তখন আমি ইংরেজি নিয়ে পড়ছি। এমএ করার কথা ভাবছি। পাশাপাশি অ্যাডভার্টাইজিং অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন‌্স-এ ডিগ্রি কোর্সও করছি। পরে এই পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাসও পেয়েছিলাম। তার সঙ্গেই আবার চলছে একটা চ্যানেলে অ্যাঙ্করিং-এর কাজ। ফলে টাকাপয়সা মোটামুটি ভালই হাতে আসছে। কিন্তু কেরিয়ার কোন দিকে যেতে চলেছে, তখনও ঠিক জানি না।

ওড়িশায় ওই সময় রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় এক নম্বর হিরোইন। রচনা-সিদ্ধান্ত সেখানে দারুণ জনপ্রিয় জুটি। কিন্তু পরিচালক বসন্ত সাহু তাঁর ছবির জন্য নতুন মুখ খুঁজছিলেন। এবং তার জন্যই তিনি কলকাতায় আসেন। তখন টেলিভিশনে আমাদের এডিটর ছিলেন রবিরঞ্জন মৈত্র। উনি বোধহয় আমার কিছু ক্লিপিংস দেখিয়েছিলেন বসন্ত সাহুকে। দেখে, কথা বলে, পরিচালক আমাকে নির্বাচন করেন।

চললাম ওড়িশায়। বাবার সঙ্গে ট্রেনে চড়ে। ভাই তখন ছোট, পড়াশোনা করছে। ফলে, মা যেতে পারতেন না। আর অফিস কামাই করে, উইদাউট পে হয়েও বাবাই আমার সব জায়গার সঙ্গী। এ সব অবশ্য আমরা তখন টেরও পাইনি। পরে জেনেছি। এমনও নয় যে সেই সব দিনে আমার টাকায় হাত পড়ত। আমি যে টাকাটা পেতাম, বাবা সেটা সোজা সেভিংসে ঢুকিয়ে দিতেন। কী করে যে সব কিছু ম্যানেজ করতেন কে জানে! এমনও হয়েছে, ওড়িয়াতে ওঁরা বলছেন, আমি শুনে শুনে ডিক্টেট করছি, আর বাবা স্ক্রিপ্ট লিখে দিচ্ছেন। পরের দিন সেই ডায়ালগ মুখস্থ করে শুটিং করছি।

প্রথমে আমরা গেলাম কটক। কটকের বিখ্যাত ফিল্ম স্টুডিয়ো আর তার আশেপাশে ক’দিন শুটিং হল। তার পর ওখান থেকে ভুবনেশ্বর। আর গান শুট করতে চেন্নাই। নাচের দৃশ্যগুলোয় দক্ষিণের কোরিয়োগ্রাফার ছিল। আমি ভালই নাচতে পারতাম। কিন্তু সমস্যা হল, ওঁরা ভীষণ তাড়াতাড়ি কথা বলতেন। ফলে বুঝতে অসুবিধে হত। এক বার, ওঁরা ‘কাট’ বলেছেন। ‘কাট’ বলার পরও লাস্ট মুভমেন্টটা একটু কন্টিনিউ করতে হয় এডিটরের সুবিধের জন্য। কিন্তু আমি সে সব ভুলে গিয়ে ‘কাট’ শুনে একেবারে থেমে গেলাম। ফলে বেশ একটু বকা খেতে হল। বকুনি খেয়ে আমি তো ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছি। খুব আত্মসম্মানে লেগেছে। তখন বাংলার টেলিভিশনে আমি মোটামুটি চেনা মুখ। কিছু কিছু বাঙালি টুরিস্ট আমাকে চিনতেও পারছেন। তাদের সামনে আমাকে এ ভাবে অপমানিত হতে হল! কিন্তু ওঁরা দেখি কান্না দেখে ভয়ানক অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে লাগলেন, ‘না না। আমরা তোমায় বকিনি। আমরা এ রকমই জোরে কথা বলি।’

ছবিতে শুধু নাচ-গান নয়, ফাইটও করতে হয়েছে আমাকে। হিরো পেটাচ্ছে ভিলেনদের। আসলে মারটা আমিই মারছি। মানে, হিরো আমাকে দু’হাতে শূন্যে তুলে ধরছে। আমি এক-একটা কিক-এ দু-তিন জনকে ধরাশায়ী করছি। দারুণ অভিজ্ঞতা! তবে, পরিশ্রম করতে হত প্রচুর। প্রায় বারো ঘণ্টা কাজ করতে হত। কখনও সেটা চোদ্দো-পনেরো ঘণ্টাও হয়ে যেত। আবার পর দিন সকালে কল-টাইম।

একটা জিনিস এখনও মনে আছে। ওঁরা ভীষণ পুজোর মতো করে ছবি করতেন। শুটিং শুরুর আগে আমরা সবাই খালি পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তার পর ক্যামেরাকে প্রণাম করতে হত। ডিরেক্টরকে প্রণাম করত অ্যাসিস্ট্যান্টরা, আর্টিস্টরা। তার পর নারকোল ফাটিয়ে, প্রসাদ মুখে দিয়ে, দিনের প্রথম শট শুরু হত। এটা হত প্রতি দিন। ফলে, আমার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় ফিরে এসেও আমি যখন শট শুরুর আগে ক্যামেরাকে আর পরিচালককে প্রণাম করতাম, রীতিমত হাসাহাসি!

আবার বোধহয় এই ছবিতেই, নয়তো এর পরের ছবিতে (আসলে দুটো ছবি খুব কাছাকাছি সময়ে শুট করা হয়েছিল তো!) আমি মরে গিয়েছিলাম। দৃশ্যটা ছিল— আমাকে চিতার আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটার যখন শুটিং হচ্ছে, তখন শটটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আবার ওঁরা ক্যামেরা চালিয়ে আমার সামনে ধূপকাঠি ঘুরিয়ে একটা পুজোর মতো করতেন, আর আমাকে ক্যামেরার সামনে একটা স্মাইল দিতে হত— আমি যে সত্যিই মরিনি সেটা বোঝাতে! এটা ওঁদের একটা রিচুয়াল। কিন্তু আমার খুব মজা লাগত।

রিলিজের পর বাবার সঙ্গে হল-এ ছবিটা দেখতে গিয়ে আর এক কাণ্ড! আমার মরে যাওয়ার দৃশ্যের সময় হঠাৎ শুনলাম পাশে একটা ফ্যাঁচফোঁচ আওয়াজ। দেখি, বাবা কাঁদছে! বললাম, ‘বাবা, ও বাবা, এই তো আমি, তোমার পাশে বসে। আমি তো জ্যান্ত আছি।’

শুটিংয়ের প্রথম দু-তিন দিন সিদ্ধান্তের কোনও শট ছিল না। তার পর যখন ও সেটে এল, আমি তো পুরো হাঁ। ও মা, এ যে সলমন খান! এত সুন্দর দেখতে! এ আমার হিরো! বাবা দেখলাম আমাকে টেরিয়ে-টেরিয়ে দেখছেন। জানতেন তো, মেয়ের একটু দুর্বলতা আছে ভাল দেখতে ছেলেদের ওপর। তাই মেপে নিচ্ছিলেন, মেয়ে ছেলে দেখে গলে গেল কি না! সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এখনও যোগাযোগ আছে। অনেক ছবিও করেছি ওর সঙ্গে।

আমাদের জুটিটা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। ওই ছবিটা করতে করতেই আমি আরও একটা ওড়িয়া ছবির জন্য সই করি। তার পর আরও অনেক অফার আসে। ওঁরা চেয়েছিলেন, আমি যেন ওখানে থেকেই কাজ করি। কিন্তু আমার খুব বোর লাগছিল। সপ্তাহে তিন দিন নিরামিষ খেতে হত। ও আমার মুখে রুচছিল না। তাই ঠিক করলাম, ওখানে থাকার চেয়ে এখানে ফিরে এসে সিরিয়াল করাও অনেক ভাল।

তবু, এ বছর যখন ভারতের কোন ছবি অস্কারে যাবে তা নির্বাচন করার জুরি সদস্য হিসেবে ডাক পেলাম, আমার প্রথমেই মনে পড়ল সেই ওড়িয়া ছবিটার কথা, কারণ এতটা পথ পেরিয়ে আসার ওটাই তো প্রথম সিঁড়ি!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy