Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বিস্মৃত এক নেত্রীর কাহিনি

তিনি জয়াবেন দেশাই। ইংল্যান্ডে শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া প্রথম ভারতীয় মহিলা। কিন্তু এ দেশের নারী-আন্দোলন মনে রাখেনি তাঁকে।তিনি জয়াবেন দেশাই। ইংল্যান্ডে শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া প্রথম ভারতীয় মহিলা। কিন্তু এ দেশের নারী-আন্দোলন মনে রাখেনি তাঁকে।

জননেত্রী: ধর্মঘটের সময় লন্ডনের রাস্তায় জয়াবেন দেশাই

জননেত্রী: ধর্মঘটের সময় লন্ডনের রাস্তায় জয়াবেন দেশাই

শ্রাবণী বসু
শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের ডলিস হিলের একটা দেওয়ালে নজর কাড়ে শাড়ি পরা এক ভারতীয় রমনীর মুরাল। আগে দেওয়ালটা ছিল গ্রানউইক কারখানার। সত্তরের দশকের শেষ দিকে এই কারখানা আর শাড়ি-পরা এই ভারতীয়ই কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন গোটা ব্রিটেন।

সময়টা ১৯৭৬-এর গ্রীষ্মকাল। গরম যেন সে বার অনেকটাই বেশি। গ্রানউইক কারখানার ঘটনাটা সে সময়েরই।

কারখানার ফোটোপ্রসেসিং বিভাগে অধিকাংশ কর্মচারী ছিলেন মহিলা। তাঁদের বেশির ভাগই এশীয়। মূলত, ভারতীয় ও পাকিস্তানি। এই মহিলা কর্মচারীরা যাঁদের তত্ত্বাবধানে কাজ করতেন তাঁরা ছিলেন পুরোদস্তুর বর্ণবিদ্বেষী ব্রিটিশ সাহেব। কারণে অকারণে এশীয়দের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কটুক্তি, অপদস্থ করা তাঁদের স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এমনকি টয়লেটে যাওয়ার জন্যও মহিলাকর্মীদের অনুমতি চাইতে হত সুপারভাইজারের কাছে। একে শরৎচন্দ্রের ‘মেজদা’ গোছের পরিস্থিতি, তার ওপর এই মেয়েদের বেতনও কম।

এই পরিস্থিতিতে ২০ অগস্ট কর্মীদের বলা হল ওভারটাইম বা অতিরিক্ত সময় কাজ করার জন্য। যা ছিল বাধ্যতামূলক।

প্রতিবাদে সরব হলেন অনাবাসী এক গুজরাতি মহিলা। দুই সন্তানের জননী জয়াবেন দেশাই। পাশে পেয়েছিলেন তাঁর ছেলে সুনীল দেশাইকে। ছেলেও ওই কারখানায় কাজ করতেন। জয়াবেনের এই প্রতিবাদ ছিল প্রায় বারুদে জ্বলন্ত শলাকা ছুঁড়ে মারা। ফলে এক ঘণ্টার মধ্যে পাশে পেলেন বহু সহকর্মীকে। শুরু হল ঐতিহাসিক গ্রানউইক ধর্মঘট—সত্তরের দশকে ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ ধর্মঘট।

কিন্তু কেন কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দিল কর্মীদের উপর? অগস্ট, বিলেতে গ্রীষ্মকালীন ছুটির মরসুম। ভ্রমণের পর ছবি প্রিন্ট করার হিড়িকও পরে এই সময়। গ্রানউইকে সবচেয়ে বেশি কাজের চাপ থাকে এই সময়ই। তাই চাহিদা মেটানোর পুরো চাপটাই কর্মীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হল।

এ দিকে এই ঘোষণায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে মহিলারা। কারণ ছুটির পর বাড়ি ফিরে রান্না ও ঘরের কাজ তাঁদেরই করতে হত। অতিরিক্ত কাজের বোঝা এবং কম বেতন, বিষয় দুটি তো ছিলই, কফিনের শেষ পেরেক হল মহিলা কর্মীদের প্রতি খারাপ ব্যবহার।

তিরিশের দশকে গুজরাতে জন্ম হয় জয়াবেনের। সূর্যকান্ত দেশাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর তিনি আফ্রিকার তানজ়ানিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন। ওখানেই তাঁর স্বামী কাজ করতেন। তখন ভারত ও পাকিস্তান থেকে তানজ়ানিয়া, কেনিয়া, উগান্ডার মতো আফ্রিকান দেশে প্রচুর শ্রমিককে পাঠানো হত। কালক্রমে সেখানেই তাঁরা সংসার পেতে থিতু হতেন।

সূর্যকান্তও সেরকম এক পরিবারের ছেলে। ষাটের দশকে তানজ়ানিয়া ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হলে স্বাধীন সরকার ‘আফ্রিকানাইজ়েশন’ নীতি গ্রহণ করে। এর ফলে অর্থনীতি ও সরকারি কাজের সিংহভাগ চলে আসে স্থানীয়দের হাতে।

সমস্যায় পড়ে এশীয় পরিবারগুলি। বেশ কিছু ভারতীয় এবং পাকিস্তানি পরিস্থিতি বুঝে চলে আসেন ইংল্যান্ডে। কিন্তু আফ্রিকা থেকে লন্ডনে আসা এশীয় মেয়েরা সম্মানজনক কাজ পাচ্ছিলেন না। যুদ্ধোত্তর ইংল্যান্ডে তাঁদের জন্য পড়ে ছিল কম বেতনের শ্রমিকের কাজ। পাশাপাশি ছিল চূড়ান্ত বর্ণবিদ্বেষ। এ সবের মাঝেই এই ছিন্নমূলদের নতুন জীবন শুরু।

এই সময়েই ফোটোগ্রাফিক ফিল্ম প্রসেসিং ‘গ্রানউইক ফ্যাক্টরি’ লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করেছিল। যেখানে লেখা ছিল ‘আসুন, আমরা আপনাদের সকলকে কাজ দেব।’

সহজেই সাড়া পেল গ্রানউইক। সব পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারবে বেছেবুছে এমন কর্মঠ মহিলাদের নিয়োগ করল তারা। ধনতন্ত্রের যেমন নিয়ম আর কী! অতঃপর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে কাজ পাওয়ার কথা। এশীয় মহিলা কর্মীতে ভরে গেল গ্রানউইক।

শাড়ি, কার্ডিগান পরিহিতা, চার ফুট দশ ইঞ্চির জয়াবেন দেশাইয়ের গড়পরতা চেহারা দেখে বোঝার উপায় ছিল না তাঁর ব্যক্তিত্ব আর পাঁচজন কর্মীর চেয়ে কত আলাদা। সেই ক্ষুরধার ব্যক্তিত্বের বলে ধর্মঘটের নেত্রী হয়ে উঠলেন তিনি। ছেলে ও সহকর্মীদের নিয়ে বসে গেলেন ধরনায়। লন্ডনের রাস্তায় শাড়ি পরা মহিলারা হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ করছেন, পুলিশদের লাঠির মোকাবিলা করে কারখানায় ধর্মঘট করছেন—অল্প সময়ের মধ্যে বিষয়টা জায়গা করে নেয় খবরের কাগজে। দেখানো হয় টিভিতেও। মধ্যবিত্ত গুজরাতি বৌ উঠে এলেন লন্ডনের সংবাদ-শিরোনামে। ব্রেক্সিটের আমলে স্মরণ করা যেতে পারে, তিনিই ইংল্যান্ডের বুকে ধর্মঘটের প্রথম এশীয় নেত্রী।

ধর্মঘটের গুরুত্ব গ্রানউইক কর্তৃপক্ষ প্রথমে বুঝতেই পারেনি। বরং একে ব্যঙ্গ করে বাঁদরদের কোলাহলের সঙ্গে তুলনা করেছিল। এর উত্তরে জয়াবেন বলেছিলেন, ‘‘আপনি তো আর কারখানা চালান না, চিড়িয়াখানা বানিয়ে তুলেছেন! সেখানে বিভিন্ন ধরণের প্রাণী আছে। কয়েকটা বাঁদরও আছে। তাদের ইশারায় নাচানো যায়। কিন্তু ভুলে যাবেন না, কয়েকটা সিংহও আছে। তারা এক কামড়ে ধড়-মুন্ডু আলাদা করে দিতে পারে। আমরা সিংহ, মিস্টার ম্যানেজার...’’

জয়াবেনের এই সিংহ পরিচিতিই তখনকার ব্রিটেনে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল। ধর্মঘটকে সমর্থন করে এগিয়ে এলেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। জয়াবেনের ছেলে সুনীল সে সময়টা বোঝাতে বলেছিলেন, ‘আ হট সামার উইথ হট টেম্পার।’ যতক্ষণ না ম্যানেজমেন্ট তাঁদের সঙ্গে সসম্মানে কথা বলছেন, কিছুতেই তাঁরা নড়বে না— জয়াবেন এই দাবিতে অটল ছিলেন। যথার্থ নেত্রীর মতো তিনি বলেছিলেন, ‘‘গ্রানউইক আমাদের কাজ দিয়েছিল কারণ ওদের লোকের দরকার ছিল।’’

সত্তরের দশকে ট্রেড ইউনিয়ন সক্রিয় ছিল ইংল্যান্ডে। কিন্তু তা ছিল শুধু মাত্র শ্বেতাঙ্গ কর্মীদের জন্য। সেই সময় কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে এশীয় কর্মীরা কম বেতন পেতেন, তাঁদের অধিকার নিয়ে শ্বেতাঙ্গ কর্তৃপক্ষ মোটেও মাথা ঘামাত না। ফলে জয়াবেন এবং তাঁর সহকর্মীরা বুঝলেন তাঁদের নিজস্ব অধিকার নিয়ে লড়াই করার জন্য একটা জায়গা থাকা জরুরি। তাই জন্য তাঁরা যুক্ত হলেন অ্যাপেক্স-এর (অ্যাসোসিয়েশন অব প্রফেশনাল, এগজিকিউটিভ, ক্লারিকাল অ্যান্ড কম্পিউটর স্টাফ) সঙ্গে। কিন্তু তা সত্ত্বেও গ্রানউইক তাঁদের স্বীকৃতি দেয়নি।

উপরন্তু ১৩৭ জন কর্মী, যাঁরা ধর্মঘটের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের বরখাস্ত করে গ্রানউইক।
কিন্তু এক মাসের মধ্যে ছবিটা উল্টে যায়। জয়াবেনের নেতৃত্বে কর্মীরা ইংল্যান্ডের অন্যান্য কারাখানার শ্রমিকদের জানান তাঁদের লড়াইয়ের কথা। পরিণাম, ক্রমবর্ধমান সমর্থন। ১৯৭৭ সালের জুন মাসে এই ধর্মঘটকে সমর্থন করে ডলিস গ্রিন টিউব স্টেশনে প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন। পুলিশের সঙ্গে সমর্থকদের হাতাহাতি হয়। লেবার পার্টির মন্ত্রী, শার্লে উইলিয়ামস, ডেনিস হোয়েল, ফ্রেড মুলে ধরনায় যোগ দেন। গ্রানউইক ধর্মঘট টানা দু’বছর হয়েছিল। একটা শাখা খোলা হয় যেখানে নথিভুক্ত করা হয় ধর্মঘটকারী ও তাঁদের সমর্থকদের নাম ও তথ্য। এই ধর্মঘটকে সমর্থন করেছিলেন ব্রিটিশ খনিশ্রমিকরাও। ‘ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মাইনওয়ার্কার্স’-এর অন্যতম নেতা আর্থার স্কারগ্রিল জয়াবেনের পাশে দাঁড়ান। কয়লা শ্রমিকদেরও পাশে পান জয়াবেন। তৎকালীন এম পি জ্যাক ড্রোমি এই ধর্মঘটকে সমর্থন করেছিলেন। তিনি জয়াবেন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, শ্রমিকদের অধিকারের লড়াইয়ের জন্য নতুন প্রজন্ম তাঁকে মনে রাখবে। অখ্যাত গুজরাতি মহিলা এ ভাবেই শ্বেতাঙ্গ মনে ছাপ ফেলে হয়ে উঠলেন প্রকৃত জননেত্রী।

কারখানার সঙ্গে জয়াবেনদের মতবিরোধ শুধু ধরনা, পিকেটিং, স্লোগান, পোস্টারে আটকে ছিল না। তাঁদের রক্তাক্তও হতে হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে আট হাজার সমর্থকের প্রতিবাদকে পুলিশ দিয়ে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। ২৪৩ জন আহত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১২ জনকে মেরে হাড়গোড় ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। এর প্রতিবাদে নভেম্বরের প্রচণ্ড ঠান্ডায় জয়াবেন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস হেড কোয়াটার্সের সামনে অনশনে বসেন। পরিস্থিতি দেখে হোম সেক্রেটারি মার্লিন রিজ় প্রস্তাব দিয়েছিলেন ওই এলাকায় বিরাট পুলিশবাহিনী মোতায়েন করা দরকার। পাশাপাশি বিক্ষোভকারীদের মিষ্টি কথায় ভুলোনোর চেষ্টাও করেন।। এতে তাঁকে নিয়ে বিদ্রুপ করে অবস্থানকারীরা। এই দুই বছর ট্রেড ইউনিয়ন তহবিল থেকে আন্দোলনকারীদের সামান্য খুদকুঁড়ো দেওযা হত। তবু ভুখা পেটেই আন্দোলনের মাত্রা বাড়তে থাকে। প্রমাদ গোনে সরকার।

এত কিছুর পরও এই আন্দোলন সাফল্যের মুখ দেখেনি। আফশোস করে জয়াবেন বলেছিলেন, আমাদের আন্দোলনের পর কারখানার কর্মসংস্কৃতি অনেকটাই বদলে ছিল। যাঁরা গ্রানউইকে থেকে গিয়েছিলেন, কোম্পানি পরে নিজস্ব গাড়িতে তাঁদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। কিন্তু বরখাস্ত-হওয়া জয়াবেনরা এ সব কিছুই পাননি।

জয়াবেন সাফল্যের মুখ দেখেননি। কিন্তু গ্রানউইক ধর্মঘট শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষকে এক করেছিল। পাশাপাশি, ইতিহাস এই আন্দোলনকে মনে রাখবে দেশছাড়া, ছিন্নমূল এক নারীর অধিকারের লড়াই হিসেবে, যার পুরোভাগে এক ভারতীয় নারী।

জয়াবেন মারা গিয়েছেন মাত্র আট বছর আগে। ২০১০ সালে। তার আগে, ৬০ বছর বয়সের প্রৌঢ়ত্বে ড্রাইভিং পরীক্ষায় পাশ করেন। লাইসেন্স হাতে পেয়ে বন্ধুদের বলেছিলেন, নিজেকে মুক্ত বিহঙ্গ মনে হচ্ছে। মুক্তির জন্য তখনও এমন আকাঙ্খা তাঁর!

ভারতের শ্রমিক আন্দোলন এই নারীকে মনে রাখেনি। কিন্তু দেরিতে হলেও ইংল্যান্ডে সম্মানিত হয়েছেন এই ভারতীয়। ২০০৭ সালে জিএমবি ট্রেড ইউনিয়নের তরফ থেকে সোনার পদক পেয়েছিলেন তিনি। গত বছর, গ্রানউইক ধর্মঘটের ৪০ বছর পূর্তিতে নাট্যকার নিল গোর একটি নাটক লিখেছেন, ‘উই আর দ্য লায়ন মিস্টার ম্যানেজার।’ সম্প্রতি এই ধর্মঘট নিয়ে একটি তথ্যচিত্রও তৈরি হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE