Advertisement
E-Paper

একটি আমের দাম হাজার টাকা

মুর্শিদাবাদের আম কোহিতুর। স্বাদ ও ঐতিহ্যের দৌড়ে পিছনে ফেলে দিয়েছে ল্যাংড়া, হিমসাগর, আলফান্সো সবাইকে। সিরাজউদ্দৌলার আমল থেকে এই আম স্বাদে-গন্ধে প্রায় কোহিনুর। মুর্শিদাবাদের আম কোহিতুর। স্বাদ ও ঐতিহ্যের দৌড়ে পিছনে ফেলে দিয়েছে ল্যাংড়া, হিমসাগর, আলফান্সো সবাইকে। সিরাজউদ্দৌলার আমল থেকে এই আম স্বাদে-গন্ধে প্রায় কোহিনুর।

দেবাশিস চৌধুরী এবং অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৮ ০০:০০

এক দিকে ল্যাংড়া, রানিপসন্দ, গোলাপখাসেরা। গোটা বাংলায় তো বটেই, বাইরেও এঁরা গণ্যমান্য। অন্য দিকে যিনি আছেন, তার পরিচিতি বিশেষ নেই। নাম কোহিতুর। নিবাস মুর্শিদাবাদ। কিন্তু আম-রাজ্যে তিনি কোহিনুর।

আম-বিশেষজ্ঞদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কে হরদমই লড়াই এই দুই পক্ষের মধ্যে। সেই তর্কে উঠে আসে আম-পালনের গল্প। আমকে খাস ব্র্যান্ড করার প্রসঙ্গও।

এই যুদ্ধের সঙ্গে কিন্তু ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে মুর্শিদাবাদের নবাবি আমল। ১৭০৪ সালে ঢাকা থেকে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে সরিয়ে আনেন মুর্শিদকুলি জাফর খাঁ। তাঁর ও পরবর্তী নবাবদের উৎসাহে মুর্শিদাবাদে তৈরি হয় আম-বাগান। এবং সেখানে বিভিন্ন ধরনের আমের বর্ণসঙ্কর। সেই সব বাগিচা থেকে কখনও বেরিয়েছে রানিপসন্দ, কখনও মির্জাপসন্দ বা সারেঙ্গা। তেমনই কোনও অনামা মালির হাতে তৈরি হয়েছে কোহিতুর। ল্যাংড়া-হিমসাগরের কথা আম-বাঙালি মাত্রেই জানেন। কিন্তু কোহিতুরের আখ্যান খুব বেশি প্রচার পায়নি কখনও। যদিও তার জন্ম-বৃত্তান্ত শুনলে তাক লেগে যায়।

গাছ পাকা হওয়ার আগেই পেড়ে ফেলতে হয় এই আম। মুর্শিদাবাদের আম-চাষিদের মতে, গাছ পাকা হয়ে গেলে কোহিতুরের স্বাদ বদলে যায়। তাই স্বাদ ধরে রাখতে হিসেব করে দেড়-দু’দিন আগেই আম পেড়ে ফেলা হয়।

এ যেন তখন ন’মাস হওয়ার আগেই জন্মানো শিশু! ঠিক সেই ভাবেই একে অতি সাবধানে গাছ থেকে পাড়া, পাকানো এবং সংরক্ষণ করা হয়। লাঠির আগায় দড়ির জাল (স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে ঠোসা) লাগিয়ে আম পাড়া হয়। কোহিতুরের বেলা সেই জালের মধ্যে তুলোর প্যাডিং থাকে। নামানোর পরেও তাকে রাখা হয় তুলোর মধ্যেই। যাতে সামান্যতম চোটও না লাগে আমের গায়ে। এখানেই শেষ নয়। দু’-তিন ঘণ্টা পরপর আমগুলো উল্টে পাল্টে দিতে হয়। যাতে এক দিকে চাপ পড়ে বা এক দিক গরম হয়ে আমের স্বাদ নষ্ট না হয়। কোহিতুর কাটার আগে দু’-তিন ঘণ্টা জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়।

নবাবি আমলে এই সব দেখভালের জন্য অভিজ্ঞ লোক থাকত। তাঁদের আম-কেরানি বা আম-পেয়াদা বলা হত। তাঁদের ছিল জহুরির চোখ। তাঁরা দেখেই বলে দিতে পারতেন, কখন কোন আমকে গাছ থেকে পাড়তে হবে বা কোনটিকে জলে ভেজাতে হবে। কোহিতুর আম কাটাও দেখার মতো পর্ব। দা, কাটারি বা ছুরি দিয়ে নয়, কোহিতুর কাটা হতো বাঁশের কঞ্চি দিয়ে। এমন ভাবে, যাতে আঁটিতে আঘাত না লাগে। তাতেও নাকি তার স্বাদ নষ্ট হয়ে যেতে পারে!

এমন আমের ঘ্রাণ সিরাজউদ্দৌলার শহর থেকে কলকাতায় এসে পৌঁছেছে আগেই। কখনও আম-উৎসবে, কখনও নামী কোনও হোটেলের রান্নাঘরে। এমনকী, ২০১৫ থেকে কলকাতায় পাওয়া যাচ্ছে কোহিতুর। মাঝে মাঝে নিলামও হয়। এক একটি কোহিতুরের দাম ওঠে ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত! ল্যাংড়া, হিমসাগর, চম্পা, রানিপসন্দ, গোলাপখাসের মতো আম মুর্শিদাবাদের খুচরো বাজারে বিকোয় ২৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। সেখানে কোহিতুর স্থানীয় বাজারে প্রায় পৌঁছয়ই না। তার আগমন সরাসরি কলকাতায়।

আম চাষিরা জানাচ্ছেন, অন্য আম, সে যতই আহামরি হোক না কেন, গাছ রয়েছে প্রচুর। ভাল ফলনের বছরে এক একটি গাছে হাজার থেকে বারোশো আম ধরে। সেখানে কোহিতুরের গাছ অত্যন্ত কম। এখন মুর্শিদাবাদে হাজার হাজার হিমসাগর গাছ আছে, তার কাছাকাছি সংখ্যাতেই রয়েছে ল্যাংড়ার গাছ, সেখানে কোহিতুর-গাছের সংখ্যা হাতে গোনা। মুর্শিদাবাদে লালবাগের কাছে আট-দশটা, জিয়াগঞ্জে তিন-চারটে। গোটা জেলায় সব মিলিয়ে শ’খানেক গাছ হবে কি না সন্দেহ! সেগুলোতে কোনওটি গোটা পঞ্চাশের বেশি আম ধরে না। হাতে গোনা এক আধটা গাছ আছে, যাতে ’শখানেক কোহিতুর ধরে। স্বাদের সঙ্গে অপ্রতুলতার জন্যও চাহিদা বেড়েছে কোহিতুরের।

মুর্শিদাবাদের লোকজন এখনও নবাবি আমলের স্বাদে মজে। তাঁরা মনে করেন, আগের সেই কোহিতুর আর নেই! তাঁদের কথায়, মুর্শিদকুলি খাঁয়ের সময়কার গাছ সম্ভবত আর একটিও নেই। কারণ, তিনশো বছরের বেশি সময় ধরে কোনও আম গাছ ফলন দেয় কিনা সন্দেহ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক আম গাছ কেটেও ফেলা হয়েছে। পলাশির যে বিখ্যাত আমবাগানে সিরাজের সঙ্গে ব্রিটিশ সৈন্যদের যুদ্ধ হয়েছিল, সেখানকার অবস্থাও তথৈবচ। তবে পরবর্তী নবাবদের আমলের কিছু গাছ এখনও বেঁচে আছে। বিশেষ করে হুমায়ুন জাহ, যাঁর আমলে হাজারদুয়ারি তৈরি হয়, তিনি আমবাগানের প্রতি যত্নবান ছিলেন। তিনি নবাবি শুরু করেন ১৮২৪ সালে। অর্থাৎ, তাঁর আমলে লাগানো আম গাছের বয়স এখন দু’শো বছরের কাছাকাছি। বেঁচেবর্তে থাকলে সে সব গাছে এখনও ফলন সম্ভব।

মুর্শিদাবাদের চাষিরা কোহিতুরের স্বাদ নিয়ে তাই খুঁতখুঁতে। তাঁদের অনেকের কথায়, এখন তো আর পুরনো গাছ নেই। তাদের পরের প্রজন্ম রয়েছে। ফলে আগের থেকে ফিকে হয়েছে স্বাদ। যদিও কলকাতার বাজারে তুলোয় মোড়া কোহিতুরের দাম তাতে টোল খায়নি। বরং নানা আম-উৎসবের মধ্যে দিয়ে তার পরিচিতি বাড়ছে।

কৌলিন্যের এই যুদ্ধে তাই যৌথ বাহিনী গড়েও বেশ পিছনে পড়ে যাচ্ছে অন্য আমেরা। তারা সবাই এখন আম-জনতা। খাস শুধু ওই এক জন, কোহিতুর।

Mangoes Kohitur Expensive Mangoes কোহিতুর
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy