Advertisement
২১ মার্চ ২০২৩

রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে দিও

পঙ্কজ মল্লিকের কাছে রবীন্দ্রনাথের গান শিখে আত্মহারা কুন্দনলাল সায়গল। ছবির জন্য পাল্টানো হয়েছিল গানের বাণীও! পঙ্কজ মল্লিকের কাছে রবীন্দ্রনাথের গান শিখে আত্মহারা কুন্দনলাল সায়গল। ছবির জন্য পাল্টানো হয়েছিল গানের বাণীও!

জুটি: ‘জীবন মরণ’ ছবিতে লীলা দেশাই ও কুন্দনলাল সায়গল

জুটি: ‘জীবন মরণ’ ছবিতে লীলা দেশাই ও কুন্দনলাল সায়গল

অভীক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’, এই গানটির যে দিন রেকর্ডিং হবে, তার আগের দিন গায়ক কুন্দনলাল সায়গলকে ট্রেনিং দিচ্ছিলেন পঙ্কজ মল্লিকের সহকারী হরিপদ চট্টোপাধ্যায়। ‘জীবন মরণ’ (১৯৩৯) ছবিতে নায়ক হিসেবে এই গান গেয়েছিলেন সায়গল। সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজকুমার মল্লিক, যাঁর অসামান্য শিক্ষাগুণে রবীন্দ্রসঙ্গীত তখন ঝড় তুলেছে নায়কের মনে।

Advertisement

ট্রেনিং-এর সময়ে হরিপদবাবু ওরফে ‘মোটাদা’ যত বার সায়গলকে বলছেন গাইতে, ‘আমি তোমায় যত...’ তত বারই তিনি গাইছেন, ‘আমি আমায় যত’। কয়েক বার এমন হওয়ায় হরিপদবাবু এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। সায়গলের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘মোটাদা, ‘আমি তোমায় যত’-র ‘তুমি’-টা কে?’’ হরিপদবাবু বললেন, ‘‘পূজা পর্যায়ের ‘তুমি’ ভগবান।’’ সায়গলের বক্তব্য, ‘‘মোটাদা, এই তুমি তো সবার মধ্যেই আছে। আমি তো ভুল করিনি, যো কুছ হ্যায় সব তু হি হ্যায়।’’ অবাঙালি, প্রথাগত শিক্ষার বাইরে থাকা এক মানুষের এমন গভীর অনুভূতির প্রকাশ দেখে চমকে গিয়েছিলেন স্টুডিয়োর সবাই।

রবীন্দ্রনাথের গান গাইবার জন্যে ছটফট করতেন সায়গল। বলতেন, ‘‘তোমরা দেখো, উচ্চারণ ও এক্সপ্রেশনে আমি কোনও অবিচার করব না। তোমরা শুধু আমায় রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে দিও।’’ ‘আমি তোমায় যত’ গানটি কয়েক বার টেক করতে হয়েছিল রেকর্ডিং-এর সময়। গানের মধ্যে থাকা ‘উঠবে যখন তারা সন্ধ্যাসাগর কূলে...’ অংশটি গাইতে গেলেই কেঁদে ফেলছিলেন সায়গল। অন্তরে এই ভাবে গেঁথে যাওয়া গান ‘জীবন মরণ’ ছবিতে তাঁর কণ্ঠে কোন অনুভূতির স্তরে পৌঁছেছিল, তার প্রমাণ আজও রয়েছে রেকর্ডে।

এর বেশ কিছু দিন আগে থেকেই পঙ্কজ মল্লিক সায়গলকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত করেছিলেন। তাই ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে পেরে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন কুন্দনলাল। কিন্তু, ‘আমি তোমায় যত....’ গান নিয়ে হঠাৎই একটা খটকা জাগল ‘জীবন মরণ’-এর পরিচালক নীতিন বসু ও সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিকের মনে। ছবিতে সায়গল এক বিরহের সিচুয়েশনে গানটি গাইবেন নায়িকা লীলা দেশাইয়ের উদ্দেশে। কিন্তু গানে এক জায়গায় আছে ‘সেই কথাটি কবি,/ পড়বে তোমার মনে...’ ‘কবি’ শব্দটি তো বেমানান হয়ে যাচ্ছে এ ক্ষেত্রে! অথচ রবীন্দ্র-বাণী পাল্টানোর কোনও প্রশ্নই নেই। সায়গল শুধু মনপ্রাণ দিয়ে গানটি যে গেয়েছেন তা-ই নয়, রেকর্ডিং হয়ে গিয়েছে, এমনকি ছবির কাজও শেষের পথে। নীতিনবাবু ও পঙ্কজবাবু, দুজনেরই মাথায় এল, যদি ‘কবি’-র জায়গায় ‘জানি’ বলা যায়, তা হলে সিচুয়েশন, চরিত্র, কাহিনি— সব কিছুর সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। কিন্তু রবীন্দ্র-শব্দ বদলাবে কার সাধ্য! অতঃপর গানের রেকর্ড নিয়ে পঙ্কজ মল্লিক গেলেন জোড়াসাঁকোতে। কবি তখন সেখানে। আর্জি শুনলেন। রেকর্ডও। সম্মত হলেন। রবীন্দ্রনাথ শুধু বললেন, ছবিতে ‘জানি’ বলা যেতে পারে, তবে রেকর্ডে যেন ‘কবি’ শব্দটিই থাকে। সেটাই আছে। ‘জীবন মরণ’ ছবিতে ও রেকর্ডে সায়গল-কণ্ঠে ধরা রয়েছে যথাক্রমে ‘সেই কথাটি জানি...’ আর ‘সেই কথাটি কবি...’।

Advertisement

ছবিটিতে সায়গলের গলায় আরও একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল—‘তোমার বীণায় গান ছিল’। এই গানকে নিয়েও ঘটেছিল এক ঘটনা। সঠিক ভাবে গাওয়া হয়েছে কি না, জানার জন্যে এই গানটিও সে দিন রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথকে শুনিয়েছিলেন পঙ্কজবাবু। এক বার শুনেই গানের দ্বিতীয় অন্তরাটি আরও কয়েক বার শুনতে চাইলেন কবি। এই অংশের প্রথম লাইনে আছে ‘গান তবু তো গেল ভেসে,/ ফুল ফুরালো দিনের শেষে...’। শুনে কবি বললেন, ‘‘ফুল ফুরালো দিনের শেষে, এ কেমন করে সম্ভব?’’ হতবাক পঙ্কজ মল্লিক তক্ষুনি গানের বই খুলে কবিকে দেখালেন, সেখানে ‘ফুল ফুরালো দিনের শেষে’ই ছাপা আছে।

এ বার যা হল, তা পঙ্কজ মল্লিকের বয়ানে এ রকম: ‘কবি তখন যেন একটু দূরের দিকে দৃষ্টি মেলে দিয়ে উদাস বিষণ্ণ সুরে বললেন— কী করে এটা হল জানি না, কিন্তু ওটা তো “সুর ফুরালো দিনের শেষে” হওয়াই উচিত ছিল।’ তখন ছবি ও রেকর্ডিং-এর কাজ শেষ হয়ে গেছে, কোনও কিছু পাল্টানোর আর কোনও উপায় নেই। এ গানের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথও তাঁর অনুমোদন দিয়ে দিলেন। কিন্তু, পঙ্কজ মল্লিকের কথায়, ‘তবু ওই শব্দটি নিয়ে তাঁর বিষণ্ণতা রয়েই গেল।’ ‘জীবন মরণ’ ছবিতে ‘গান তবু তো গেল ভেসে/ ফুল ফুরালো দিনের শেষে’ গাইলেন সায়গল। আজও এটাই চলছে, গীতবিতান-স্বরবিতানেও তা-ই আছে।

এ কথা তো সত্যি, ‘গান তবু তো গেল ভেসে’-এর পরে ‘সুর ফুরালো দিনের শেষে’-ই যুক্তিপূর্ণ, যথাযথ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও, কেন তা অপরিবর্তিত থেকে গেল, তা সত্যিই রহস্যময়! পঙ্কজ মল্লিকের কাছেও সে দিন তা আশ্চর্য ঠেকেছিল, যা তিনি পরিষ্কার লিখেছেন তাঁর ‘আমার যুগ আমার গান’ বইয়ে: ‘আমার মনে একটা প্রশ্ন আজও থেকে গেছে। গীতবিতানে এখনো পর্যন্ত ওই “ফুল ফুরালো” কথাটি অপরিবর্তিতই থেকে গেছে। কবি কি তাহলে বিস্ময় প্রকাশ করার পরও এর পরিবর্তন করেন নি? পরে এই গানটি আমি স্বকণ্ঠেও রেকর্ড করেছি এবং গীতবিতানে যেমন ছাপা আছে তেমনই গেয়েছি।

কবির সেদিনকার বিস্ময় ও বেদনার তাৎপর্য আমি আজও সম্যকভাবে বুঝে উঠতে পারিনি।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.