নক্ষত্র: ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি। জুয়ার আসরে হারলেও সাহিত্যে হারতে হয়নি তাঁকে। (ছবি: গেটি ইমেজেস) ডান দিকে, ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ।
জুয়ার ঠেকের পাশে এক জুয়াড়ির মূর্তি। বিরল ঘটনা। জার্মানির উইসবাডেন শহরের বিখ্যাত জুয়ার ঠেকের পাশে এই জুয়াড়ির আবক্ষ মূর্তি বসেছে ১৯৯৭ সালে। এই জুয়ার ঠেকের মাহাত্ম্য যাঁরা জানতেন, তাঁদের কাছে এই মূর্তি জায়গাটির গৌরব বাড়িয়ে তুলেছে। এই জুয়াড়ি রাশিয়া থেকে সুদূর জার্মানির একাধিক শহরে জুয়ার অমোঘ টানে ছুটে গেছেন বার বার। কখনও জিতেছেন, হেরেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি।
প্রথম বার পশ্চিম ইউরোপ ভ্রমণের সময় জার্মানির উইসবাডেনের এই আসরে যোগ দিয়ে এই জুয়াড়ি এগারো হাজার ফ্রাঁ হাতে পান, পরে তা খোয়াতে হয়েছিল সেখানেই। সে বার বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে সাহায্যের জন্য দেশে দাদাকে চিঠি লিখতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বার ফের দশ হাজার চারশো ফ্রাঁ জুটে গিয়েছিল। তার থেকে কিছু টাকা দেশে আপনজনদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, বাকি টাকাটা নিয়ে আরও কয়েক দান খেলতে গিয়ে হারাতে হয়েছিল পুরোটাই। হোটেলের বিল, গাড়িভাড়ার টাকা সরিয়ে রেখেছিলেন বলে রক্ষে। অন্য এক শহরে গিয়ে আবার জুয়ার নেশায় সব হারিয়ে অসুস্থ স্ত্রীর জন্য পাঠানো টাকা ফেরত চেয়ে চিঠি পাঠাতে হয়েছিল। সে বার কোনও মতে রক্ষা পেয়েছিলেন এই জুয়াড়ি। জুয়াড়ির নাম ফিয়োদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি— কিংবদন্তি রুশ ঔপন্যাসিক ও গল্পকার— যিনি জন্মেছিলেন ১৮২১-এর ১১ নভেম্বর। জুয়া খেলার সঙ্গে দস্তয়েভস্কির স্মৃতির অনুষঙ্গ থাকায় ২০০৫ সালে রাশিয়ার এক লটারি কোম্পানি তাদের টিকিটে এই সাহিত্যিকের ছবি ছেপে দেয়, তবে তাতে তাঁর প্রপৌত্র আদালতে মামলা ঠুকে দেন।
‘দ্য গ্যাম্বলার’ উপন্যাসে আমরা পাই জার্মানির মনোরম সব শহরে জুয়ার নেশায় নিজেকে হারিয়ে ফেলা দস্তয়েভস্কিকেই। তাঁর দ্বিতীয় ইউরোপ ভ্রমণের সময় তাঁকে ধরেছিল আর এক নেশায়। পোলিনা সুস্লোভাকে পাওয়ার নেশা। বছর দুই আগে আলাপ। সাহিত্যে উৎসাহী পোলিনার মধ্যে নিজের কিছু চিন্তাভাবনার ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। তার উপর পোলিনা ছিলেন দুর্দান্ত সুন্দরীও। সে বার সেই উদ্দাম সফরে জুয়াড়ি তাঁর জুয়া খেলায় জড়িয়ে ফেলেছিলেন পোলিনাকেও। নিজের সব হারিয়ে কখনও প্রেমিকার আংটি নিয়েও বন্ধক দিতে হয়েছে জুয়াড়ি প্রণয়ীকে। আবেগে উথালপাথাল সেই দিনগুলো অনিশ্চয়তার এক আশ্চর্য উপাখ্যান।
তেইশ বছর বয়সে দস্তয়েভস্কি মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি ছেড়ে দেন। উদ্দেশ্য, সাহিত্যে আরও মনোযোগ দেওয়া। অর্থকষ্ট চিরসঙ্গী হয়। অর্থকষ্ট থেকেই কি জুয়ার নেশা? জীবনীকার জোসেফ ফ্রাঙ্কের মতে, জার্মানিতে প্রকৃত অর্থে জুয়ার নেশায় মজেছিলেন তিনি। যক্ষ্মা কেড়ে নিয়েছিল স্ত্রী মারিয়াকে। প্রেম করে বিয়ে। খুব সুখকর দাম্পত্য কাটাতে না পারলেও দু’জনের মনের টান ছিল। শেষ দিকে সে জীবনে দমকা হাওয়ার মতো এসে হাজির হয়েছিলেন পোলিনা। তাঁর দাবিতে মারিয়াকে ডিভোর্স দিতে পারেননি। স্ত্রীর শেষ দিনগুলোয় কাছে ছিলেন। অতি প্রিয় দাদাকেও হারাতে হল কিছু দিন পরেই। দাদার সঙ্গে চালু করা সাধের পত্রিকাটিও মুখ থুবড়ে পড়ল। ঋণের পাহাড় জমছিল। কাঁধে দাদার পরিবারের দায়িত্ব। পাওনাদারদের তাগাদা বিষিয়ে তুলল জীবন। ধূর্ত প্রকাশক স্টেলোভস্কির কাছে হাত পাতলেন দস্তয়েভস্কি। এ যাবৎ যা কিছু লিখেছেন, সব তাঁর হাতে তুলে দিয়ে পেলেন তিন হাজার রুবল। সঙ্গে একটি শর্ত। পরের বছরের মধ্যে লিখে দিতে হবে একটি নতুন উপন্যাস। না পারলে পরবর্তী ন’বছর যা-ই লিখুন, কোনও পারিশ্রমিক ছাড়াই তুলে দিতে হবে স্টেলোভস্কির হাতে। আকণ্ঠ অর্থসমস্যার মধ্যে ভাঙাচোরা মন নিয়ে লেখালিখির কাজ কি সম্ভব! আর এক বছরের মধ্যে উপন্যাস না লিখতে পারলে ন’বছরের জন্য উপার্জনের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। বাঁধা পড়ে যাবেন স্টেলোভস্কির মতো শঠ লোকের হাতে। একদম খাদের ধারে দাঁড়িয়ে দস্তয়েভস্কি অদ্ভুত এক জুয়ার দান ফেলেছিলেন।
১৮৬৫-র জুলাই মাসের শেষে দস্তয়েভস্কি উইসবাডেনে এসে হাজির হয়েছিলেন তৃতীয় বারের জন্য। স্টেলোভস্কির টাকায় ঋণ কিছুটা মিটিয়ে হাতে সামান্য যে অর্থ ছিল, তাই নিয়ে। দেশে থাকতে ঋণের ফাঁস চেপে বসেছিল গলায়। ভাগ্যের চাকাটা যদি ঘোরে, এই আশায় জুয়ার ঠেকে হাজির হওয়া। কিন্তু না, তৃতীয় বার জুয়ার ঠেকে এসে সর্বস্বান্ত হতে হল! হোটেলের বিল না মেটাতে পারায় মালিক খাবার বন্ধ করে দিলেন। দিন কাটতে লাগল না খেয়েই। লজ্জার মাথা খেয়ে পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখতে লাগলেন। সুবিধে হল না। যে কোনও সময় হোটেল থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দিতে পারে হোটেলের মালিক। দিতে পারে পুলিশেও। জুয়া খেলে বিপদে পড়লেও এত শোচনীয় অবস্থায় পড়তে হয়নি কোনও দিন।
জুয়ার ঠেকে কপাল খোলার আশা ছাড়াও, মনের কোণে ছিল পোলিনার সঙ্গে আবার অভিসারের বাসনা। তার স্মৃতি যে এখনও নেশা ধরিয়ে দেয়, এলোমেলো হয়ে যায় সব কিছু। দেখা হল, কিন্তু দেখা দিয়েও ধরা দিলেন না পোলিনা। কপর্দকশূন্য এবং বিধ্বস্ত দস্তয়েভস্কিকে নিয়ে আর আগ্রহ ছিল না তাঁর। খালি পেটে উইসবাডেনের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান হৃতসর্বস্ব জুয়াড়ি। এক দিন রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে এক শুভার্থীর পরামর্শে ‘রাশিয়ান হেরাল্ড’ পত্রিকার সম্পাদক কাতকভকে তিনি প্রস্তাব পাঠালেন, একটি গল্প বা ছোট উপন্যাস লিখবেন তাঁর পত্রিকার জন্য। তিনি জানালেন, তলস্তয় তাঁর পত্রিকায় লেখার জন্য যে পারিশ্রমিক পান, তার অর্ধেকেরও কম পারিশ্রমিকে তিনি লিখবেন। সে বছর ‘রাশিয়ান হেরাল্ড’-এ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল লিয়ো তলস্তয়ের একটি উপন্যাস, যা পরে বিশ্বসাহিত্যের এক অক্ষয় কীর্তি, ‘ওয়র অ্যান্ড পিস’। তখনকার মতো বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে অগ্রিম হিসেবে দস্তয়েভস্কি চেয়ে পাঠালেন তিনশো রুবল। অগ্রিম এসেছিল, তবে বেশ দেরিতে। তত দিনে স্থানীয় এক ফাদারের সাহায্য পেয়ে দেশে ফিরে এসেছেন তিনি। ‘রাশিয়ান হেরাল্ড’-এর সঙ্গে শুরু হয়েছিল তাঁর গৌরবময় যাত্রা। উইসবাডেনের হোটেলে জুয়া খেলার পাগলামি, পোলিনার সঙ্গে কাটানো এলোমেলো কিছু মুহূর্তের উত্তেজনার ফাঁকে অঙ্কুরিত উপন্যাসের রূপরেখা আমূল বদলে গেল। ১৮৬৬-র জানুয়ারি থেকে কাতকভের পত্রিকায় দস্তয়েভস্কি লিখতে শুরু করলেন। জন্ম নিল বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম মাইলফলক ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’। এই উপন্যাসের দৌলতে পত্রিকাটির বিক্রি এক লাফে পাঁচশো কপিরও বেশি বেড়ে যায়।
উইসবাডেন থেকে দেশে ফেরার পর নানা শারীরিক অসুস্থতা, বিশেষত মৃগী দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠল। পাওনাদারদের উপদ্রব তো ছিলই। কাতকভ অনেক তাগাদা দিয়ে তবে কিস্তির লেখা পেতেন। কিন্তু এ দিকে স্টেলোভস্কির সঙ্গে যে জুয়া খেলায় নেমেছিলেন, তার কী হবে? ও দিকে শর্তের সময় শেষ হতে চলল, তবু স্টেলোভস্কির জন্য এক অক্ষর লিখে উঠতে পারেননি তিনি। নীচপ্রকৃতির স্টেলোভস্কিকে তিনি ভালই চেনেন। বিপদগ্রস্ত লেখকদের ফাঁদে ফেলার জন্য সে সদাপ্রস্তুত। শর্তভঙ্গের আতঙ্ক তাঁকে স্থির থাকতে দেয় না। এক বন্ধু বুদ্ধি দিলেন, স্টেনোগ্রাফারের সাহায্যে লিখতে। দেশে স্টেনোগ্রাফি ব্যাপারটা ছিল একদম নতুন। স্টেনোগ্রাফির কোর্স তখন প্রথম চালু করেছিলেন এক প্রফেসর। দস্তয়েভস্কি বরাতজোরে পেয়ে গেলেন তাঁর সেরা ছাত্রী আনা স্নিতকিনাকে। প্রতিদিন দুপুর থেকে বিকেল কয়েক ঘণ্টা তিনি মুখে-মুখে বলে যান তাঁর কাহিনি। আনা শর্টহ্যান্ড নেন নোটবুকে। মোটে ছাব্বিশ দিনে সম্পূর্ণ হয়ে গেল নতুন উপন্যাস ‘দ্য গ্যাম্বলার’। স্টেলোভস্কির শর্তের শেষ তারিখের ঠিক আগে আগেই লেখা শেষ হয়েছিল, কিন্তু হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন স্টেলোভস্কি। সদ্য শেষ হওয়া উপন্যাস তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে দস্তয়েভস্কি যাতে শর্ত জিততে না পারেন, সে জন্য গা ঢাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু আনার বুদ্ধিতে আইনের দ্বারস্থ হয়ে জিতে যান দস্তয়েভস্কি।
খাদের কিনারা থেকে বহু বার ফিরে এসেছেন এই রুশ সাহিত্যিক। প্রথম জীবনে ‘পেত্রাশেভস্কি’ গোষ্ঠীতে যোগ দেওয়ার অপরাধে বন্দি করা হয়েছিল তাঁকে। প্রগতিশীল চিন্তাধারার এই গোষ্ঠীর সদস্যরা জ়ারের রাশিয়ায় নিষিদ্ধ বইপত্র নিয়ে আলোচনা করার জন্য কর্তৃপক্ষের বিষনজরে পড়েন। জ়ার-বিরোধী কার্যকলাপের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় দস্তয়েভস্কির মতো কয়েকজনকে। নিয়ে যাওয়া হয় ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে। দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল সারিবদ্ধ ভাবে। পাশেই রাখা ছিল কফিনগুলো। প্রথম যাদের পালা, তাদের বেঁধে ফেলা হয়েছিল খুঁটিতে। মৃত্যুর প্রহর গোনার সেই মুহূর্তগুলো ছিল ভয়ঙ্কর। ‘দি ইডিয়ট’ উপন্যাসের মতো কোনও কোনও লেখায় সেই মানসিক যন্ত্রণার বর্ণনা দিয়েছেন দস্তয়েভস্কি। অসহনীয় সেই মানসিক চাপে এক বন্দি পাগল হয়ে গিয়েছিল, সারা জীবনে সে আর স্বাভাবিক হতে পারেনি। বধ্যভূমিতে তাঁদের দিকে রাইফেল তাক করা হলে শিরদাঁড়া দিয়ে যখন ঠান্ডা স্রোত বয়ে গিয়েছিল, ঠিক তখনই এসেছিল অভাবনীয় নির্দেশ। মৃত্যুদণ্ড বদলে গিয়েছিল সাইবেরিয়ার জেলে চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে। শুধু কারাদণ্ড নয়, কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। সে অভিজ্ঞতাও বিষময়। যে দিন দস্তয়েভস্কির উপন্যাস লেখার কাজে সাহায্য করার জন্য স্টেনোগ্রাফার আনা প্রথম তাঁর কাছে আসেন, সে দিনই এই গল্প তিনি তাকে শুনিয়েছিলেন। বদমেজাজি মানুষটির তখনও ভরসা ছিল না যে, স্টেলোভস্কির ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা সফল হবে। সে সব কথাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে বেরিয়ে আসছিল অবসন্ন মানুষটির মুখ থেকে। আনা ক্রমশ বুঝতে পেরেছিলেন, কত বেদনার পাথর চেপে আছে এই গুণী মানুষটির বুকে।
সে বার ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে থেকে বেঁচে ফিরে ফিয়োদর মিখাইলোভিচ গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠেছিলেন। তখন তাঁর ২৮ বছর বয়স। স্টেলোভস্কির সঙ্গে খেলায় এ বার যখন বাজি জিতলেন, তাঁর বয়স পঁয়তাল্লিশ। গলা ছেড়ে গান না গাইলেও রেস্তরাঁয় ডাকলেন আনাকে। উদ্যাপনের সময়েই বিষাদের মেঘ ছায়া ফেলল দস্তয়েভস্কির মনে। নিঃসঙ্গ, অসুস্থ এবং আর্থিক ভাবে বিপর্যস্ত দস্তয়েভস্কি তাঁর চেয়ে পঁচিশ বছরের ছোট এই তরুণীর সঙ্গে সময় কাটিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর আঁধারমনে উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে দেয় মেয়েটির উপস্থিতি। তাঁর মতো এক জন মানুষের জন্য গভীর সমবেদনায় ভরা আনার মন। আনার সঙ্গে আর দেখা হবে না ভেবে মনটা গুমরে ওঠে। তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন, আনাকে বলেন ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ উপন্যাস শেষ করতে তার সাহায্য লাগবে। আনার মনটাও কী যেন হারানোর আশঙ্কায় নিশ্চুপ ছিল। এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। পরের দিন আনা পৌঁছতেই উত্তেজিত দস্তয়েভস্কি তাকে বললেন, তিনি একটি নতুন উপন্যাস শুরু করতে চান, একটি ব্যাপারে তিনি বড় ধন্দে পড়েছেন, তাই তার মত চাই। আসলে ‘দ্য গ্যাম্বলার’ উপন্যাস লেখার ছাব্বিশ দিন তিনি তো আনাকে নিছক স্টেনোগ্রাফার হিসেবে ভাবেননি। অনেক সময়ই উপন্যাসের কোনও এক বাঁকে পৌঁছে তিনি মত চেয়েছেন তাঁর। এত বড় সাহিত্যিকের এই বদান্যতা আনাকে মুগ্ধ করেছে।
দস্তয়েভস্কি এ বার শুরু করলেন তাঁর নতুন উপন্যাসের কথা। সে উপন্যাসের বিষণ্ণ নায়ক জীবনে হারিয়েছেন বহু কিছু, সমস্যার ভারে নুয়ে পড়া মানুষটি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত। প্রতিভাবান সেই মানুষ মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা ভাবনাগুলোকে যে ভাবে তাঁর শিল্পকর্মে ফুটিয়ে তুলতে চান, পেরে ওঠেন না। শিল্পী ভালবেসে ফেলেছেন একটি মেয়েকে। আনিয়া নামে সে মেয়েটি নম্র, ভদ্র, প্রাণোচ্ছল, বুদ্ধিমতী, হৃদয়বতী। দস্তয়েভস্কি আনাকে প্রশ্ন করলেন— এই নায়কের প্রেমে পড়া কি মেয়েটির পক্ষে সম্ভব? কী আছে তাঁর আনিয়াকে দেওয়ার মতো? এমন লোককে হৃদয় দিলে সেটা বোধ হয় আনিয়ার তরফে একটা নিদারুণ ত্যাগস্বীকার হবে! দু’জনের বয়সের তফাতও তো অনেক! এমন ঘটনা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য হবে?
আবেগতাড়িত আনা উত্তর দিয়েছিলেন— কেন অসম্ভব? মেয়েটির হৃদয়ে যদি অনুভূতির গভীরতা থাকে, সে যদি সংবেদনশীল হয়, তবে সে ভালবাসতেই পারে শিল্পীকে।
মুহূর্তের স্তব্ধতা পেরিয়ে কাঁপা গলায় দস্তয়েভস্কি আনাকে বলেছিলেন, নিজেকে আনিয়ার জায়গায় বসিয়ে ভাবতে। আনা দেখলেন, নিদারুণ এক অস্বস্তির ছায়া ফিয়োদরের মুখে। তাঁর মনে হল, সতেরো বছর আগে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় বোধহয় এ রকমই দেখাচ্ছিল তাঁকে। অপেক্ষা করে আছেন ফিয়োদর মিখাইলোভিচ, আনা নেতিবাচক একটি শব্দ উচ্চারণ করলেই যেন গুলিবিদ্ধ হবেন তিনি। কিংবা যেন জীবনের সর্বস্ব বাজি লাগানো এক জুয়াড়ি, আনার উপর নির্ভর করছে তাঁর জেতা অথবা সর্বস্বান্ত হওয়া।
আনা গভীর আন্তরিকতায় তাঁর ভালবাসার কথা জানিয়েছিলেন সেই জুয়াড়িকে। জুয়াড়ি দস্তয়েভস্কি জিতে গিয়েছিলেন। আনার সঙ্গে দস্তয়েভস্কি জীবনের শেষ চোদ্দো বছর কাটিয়েছিলেন। সেই সময়কাল তাঁর আজন্ম বেদনার দীর্ঘ কাহিনির মাঝে আনন্দের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। তাঁর অগোছালো জীবন পাল্টে দিতে আনার চেষ্টার কসুর ছিল না। সংসারের সব সমস্যার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে দস্তয়েভস্কিকে নির্ভার এক জীবন উপহার দেওয়া হয়ে উঠেছিল আনার একমাত্র লক্ষ্য। তাঁর সব সময়ের ইচ্ছে ছিল, সাহিত্যসৃষ্টিতে মগ্ন থাকুন সৃষ্টিশীল মানুষটি। আনার সঙ্গে বিয়ের পরে আবার ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন দস্তয়েভস্কি। আবার সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন জুয়ার আসরে। বিয়ের আংটিটিও হারাতে হয়েছিল। তবে সেই সফরের শেষে তিনি আনাকে কথা দেন, জুয়ার নেশা ছাড়বেন। সম্ভবত সে কথা তিনি রেখেছিলেন।
মানুষের মন বড় ভাল বুঝতেন দস্তয়েভস্কি, আর তাঁর মন নিয়ে মনস্তত্ত্ববিদরা এখনও মাথা ঘামিয়ে চলেছেন। তাঁর জুয়ার আসক্তিকে ‘কম্পালসিভ গ্যাম্বলিং’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। দারিদ্রের অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে আসার দুর্দম ইচ্ছে তাঁর জুয়া খেলার বড় কারণ। তবে দস্তয়েভস্কির চিঠিপত্র পড়লে বোঝা যায়, জুয়ায় জেতার ব্যাপারে এক অদ্ভুত আত্মপ্রত্যয় জন্ম নিয়েছিল তাঁর মনে। জুয়ার বাজি জেতার অলীক পারদর্শিতা নিয়ে তৈরি অদ্ভুত অহমিকা দস্তয়েভস্কির মতো জুয়াড়িদের জুয়ার টেবিলে টেনে নিয়ে যায়। ‘দ্য গ্যাম্বলার’ উপন্যাসের নায়কের মধ্যে ঠিক এই মানসিকতাই আমরা লক্ষ করি। এই অহমিকাতেই ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এর নায়ক বিবেককে অগ্রাহ্য করতে চেয়েছিল, তার করুণ পরিণতিই উপন্যাসে দেখিয়েছেন দস্তয়েভস্কি।
জুয়ায় বার বার হেরে গেলেও সাহিত্যরচনায় বহু বাজি তিনি জিতে নিয়েছিলেন, যদিও নানা শারীরিক অসুস্থতা অথবা অর্থকষ্ট তাঁকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিত প্রতিনিয়ত। ১৮৮১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার দু’মাস আগে দস্তয়েভস্কি সম্পূর্ণ করে গিয়েছিলেন তাঁর শেষ উপন্যাস ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজ়ভ’। সেই উপন্যাস তিনি উৎসর্গ করে যান আনাকে, যার হাত ধরে তিনি জিতেছিলেন অনেক বাজি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy