Advertisement
E-Paper

সেই হস্টেলদিনগুলো

প্রথম বার আমার এক বন্ধু আমায় নিয়ে গিয়েছিল ইডেন হিন্দু হস্টেলে। সে প্রেসিডেন্সিতে তিন বছর পড়ে ফেলেছে, আমি সবে ভর্তি হয়েছি। আমার বন্ধুটি সেই হস্টেলে অ্যাডমিশন ছাড়াই তিন বছর থাকছিল, এর ওপর আবার আমাকে জোটাল। আমি হস্টেলে এই প্রথম।

সানি চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির অনেকখানি জুড়ে আছে হস্টেলের বন্ধুত্ব

‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির অনেকখানি জুড়ে আছে হস্টেলের বন্ধুত্ব

প্রথম বার আমার এক বন্ধু আমায় নিয়ে গিয়েছিল ইডেন হিন্দু হস্টেলে। সে প্রেসিডেন্সিতে তিন বছর পড়ে ফেলেছে, আমি সবে ভর্তি হয়েছি। আমার বন্ধুটি সেই হস্টেলে অ্যাডমিশন ছাড়াই তিন বছর থাকছিল, এর ওপর আবার আমাকে জোটাল। আমি হস্টেলে এই প্রথম। এই নতুন লাগাটা আমার ভালই লাগতে লাগল। কিন্তু দু’দিন পর থেকেই মনে হতে লাগল, এটা নোংরা, ওটা অসহ্য, সেটা বিরক্তিকর। কলকাতার হাঁটুজলে আমার জুতোর ভেতরে জল ঢুকে যায়, ভিড়ের মধ্যে লোকে ছাতার খোঁচা মারে, ফুটপাত দিয়ে যাচ্ছি, তাড়া আছে অথচ দেখো তো সামনের লোকটা হাঁটছে ধীরে ধীরে।

খাবারের কথা নিয়ে তো উপন্যাস লিখতে পারি। দোকান দু’রকমের। এক রকম ছিল, ঢুকলেই পাঁচশো টাকা। কী করে যে এত বিল হবে টের পাবে না। আর আর একটায় গেলে চল্লিশ টাকায় সেরে দেবে বটে, কিন্তু সেখানে ডালের সর্বজনবোধ্য নাম জল, ভাতের আসল নাম কাঠি, মাংসের আর এক নাম হাড়, যে কোনও তরকারি হল ঘ্যাঁট, আর ঝোলকে বলতে পারি কোনও অপরিবর্তনশীল তরল। কোনও তফাত নেই মাছ মাংস আর ডিমের ঝোলে। এক বার তো ডিমের কারি চাইলাম আর দেখলাম সিদ্ধ ডিমটা ভেজে ওপরে মাটনের ঝোলটা বেমালুম দিয়ে দিল।

হস্টেলে অ্যাডমিশন নিলাম। এ বার থেকে খাওয়াটা হস্টেলেই। তবু স্বাদ নেই। ওদের ঝোল বানানোর রেসিপিটা আজও উদ্ধার করতে পারলাম না, পারলে বিষ তৈরির নতুন পদ্ধতি বের করে নিতাম। ডাল দিয়ে সামান্য ভাত আর মাছ খেয়ে চলে আসতাম প্রতি দিন। রাতে খাওয়ার পরে দাদারা ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া নতুন ও সিনিয়র ছেলেদের ঠিকুজি-কুষ্ঠি জানতে চাইবে। এ এক জ্বালা, অত ছেলের নাম, তার বাবার নাম, তার বাড়ির পুরো ঠিকানা, এখন তার ঠিকানা, তার নেশা আছে কি না, কোন বিষয়ে পড়ে, মাধ্যমিক থেকে তার রেজাল্ট কোথায় কী— সব মনে রেখে পুরোটা একটা যে কোনও ভাষায় বলতে হবে। অর্থাৎ পিন কোড বললেই ফেল, বলতে হবে ডাকঘর সূচক সংখ্যা। এটাকে বলে ইনট্রো, সকলের সঙ্গে পরিচয় করা। খুব ভাল, কিন্তু পরিচয় তো হয় থাকতে থাকতে মিশতে মিশতে। এ আবার কেমন পরিচয়, ওরে তোর সব বল রে আমি খিস্তি খেতে চাই না। এ তো জুলুম। র‌্যাগিং। এমনটাই মনে হত, যদ্দিন না দেখলাম, ডেঙ্গিতে ছেলেটা কোনও কথাই বলতে পারল না, কিন্তু তাকে নার্সিং হোমে ঠিক ইনফর্মেশন দিয়েই ভর্তি করা হল এবং তার বাড়ির লোককেও খবর দেওয়া হল।

সময় বদলাতে থাকল। দাদারা এ বার খুনসুটির সঙ্গে সঙ্গে রাত একটার সময় পেঁয়াজি ভেজেও খাওয়ায়। খুব মনে পড়ে, এক দিন মহাত্মা গাঁধী রোডের ক্রসিং-এ দাঁড়িয়ে ভেবেছিলাম, আমি জানি আমাকে কলেজের দিকে যেতে হবে কিন্তু যদি না যাই তবে কে বারণ করবে! আবার এক দিন রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে তাস খেলতে বসেছি, এক বন্ধু একটু পরে বলল, ‘চল, চা খেয়ে আসি।’ ‘এখন চায়ের দোকান কোথায় পাবি?’ বাইরে তাকিয়ে দেখি রোদ উঠে গেছে।

এক রাতে, হঠাৎ ঘরের বাইরে শুনি ধুপধাপ শব্দ। উঁকি মেরে দেখি এক জনের হাতে ফুটবল। ব্যস, সেও আমায় দেখে ফেলেছে। রাত দুটোর সময় অনেকে মিলে, মাঠে। বড় মাঠের কোনায় কমলা আলো জ্বলছে। কে যে কোনটা বোঝার কোনও উপায় নেই। ঠিক হল অর্ধেক ছেলে জামা খুলে খেলবে, আর অর্ধেক জামা পরে। জামা যাদের পরা— তাদের জামায় আলো পড়ে চকচক করবে, আর যাদের খালি-গা, তাদের করবে না। জোর কদমে খেলা চলতে থাকল। মজাটা হল এর পরে। খেলতে খেলতে ছেলেরা ঘামতে শুরু করল আর খালি গায়ের ওপরে ঘাম মাঠের আলোয় চকচক করে উঠল। এ বার আর চেনা যায় না। সবাই তাদের বিরোধীদের বল পাস করতে শুরু করল। তবু ওই ভাবে চলল খেলা। অবশেষে ঘেমেনেয়ে ফিরে, শাওয়ারের জলে স্নান করে, ঘুম। খোলা বাথরুমে সবাই সবাইয়ের গায়ে জল ছিটিয়ে স্নান করা প্রতি দিনের ব্যাপার ছিল। এগারোটায় ক্লাস, আর যদি সবাই এগারোটাতেই ঘুম থেকে ওঠে, তবে যা হয় আর কী। ‘ওরে আমার তাড়া আছে’, ও বলল, ‘আমারও’, ‘তবে চ এক সঙ্গেই...।’

বাড়ি এলে হস্টেলকে মনে পড়েছে। আগে সপ্তাহে এক বার বাড়ি আসতাম, এখন মাসে এক বার। পরীক্ষার পর অনেকটা সময় বাড়িতে কাটিয়ে যখন হস্টেলে ফিরেছি, তখন হঠাৎ খাবারের স্বাদ ভাল লেগেছে। যে হস্টেলের দেওয়ালগুলো ছুঁতে ঘেন্না করত, সেই দেওয়ালে ফ্রেশার্স-ওয়েলকামের জন্য ডেকরেশন করেছি। বড় কাগজে কায়দার ক্যালিগ্রাফি করে লিখেছি— ‘আমার বাড়ি হস্টেলে।’

তার পর কলকাতার পথে পথে ভালবেসেছি, প্রেমিকার শখে কলকাতার ফুলের দোকানে রক্তকরবীর অর্ডার দিয়েছি। সেই ফুলের দোকান থেকে কেমন একটা ন্যাতা হয়ে যাওয়া ফুল এনে দিয়ে বলেছে, এই হল রক্তকরবী। বোঝাও যাচ্ছে না সেটা ফুল বলে। সেটাই দিয়ে দিলাম। আমারই চেতনার রঙে ওটাই হল রক্তকরবী। এ ভাবেই কলকাতা হয়ে উঠেছে ভালবাসার শহর। বন্ধুরা রাত দুটো-আড়াইটের সময় ঘুম থেকে তুলে বলেছে, ‘চা খেতে যাই চল।’ ‘যাব না ভাই, খুব শরীর খারাপ’, ঘুমনোর জন্য এসব কোনও অজুহাত কাজে দেয়নি। পাজামা-গেঞ্জি, হাফপ্যান্ট-টিশার্ট পরেই কলেজ স্ট্রিট দিয়ে প্রায়ই গভীর রাতে আমরা বন্ধুরা হস্টেল থেকে যেতাম চা খেতে। চার দিকে সার সার ডাব। তার মধ্যেই পুলিশের গাড়ি আসত, সব দেখে নিয়ে চলে যেত। অন্ধকারে স্ট্রিটলাইটে কলেজ স্ট্রিট, প্রেসিডেন্সি— সবই স্বপ্নের দিন ছিল।

স্বপ্ন এক সময় ভাঙবেই। সকলেরই ভেঙেছে। যে দাদারা আমাদের ইনট্রো নিয়েছিল, সেই দাদারা চলে গেছে, আমরাও যাব। কেবল আমাদের আগে যারা এসেছিল, তারা আমরা থাকাকালীন মাঝে মাঝে আসত, থাকত, পুরনো স্মৃতির দরজা খোলা হত। তারা যেন যায়নি কোনও দিন। শুধু আমাদের বেলায় হল ইতি। হিন্দু হস্টেল ভাঙা হবে। আবার মেরামত করে নতুন করে গড়া হবে এই হস্টেল। তাড়াহুড়ো করে সব ছেড়ে পালিয়ে আসতে হল আমার বাড়ি হস্টেল থেকে। এখনও মেরামত শেষ হয়নি। গেলে দেখতে পাবে পড়ে রয়েছে জামা, কারও দাবার ঘুঁটি, কারও তাস। ঠিক মনে হয় জেমস ক্যামেরনের ‘টাইটানিক’ ছবিতে জাহাজ ডোবার শেষ মুহূর্তে এক অভিনেতা যেমন তাঁর ঘড়িটা মিলিয়ে নেন জাহাজের ঘড়িটার সঙ্গে, তেমনই যেন এরা সেই সময়কে এখানে আটকে রেখে, নিজেরা চলে গেছে হস্টেল থেকে।

এখন ছেলেরা চলে এসেছে রাজারহাটে। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় রাজারহাটে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতে দিয়েছে এই সব ছাত্রদের। সেখানে সব কেমন আছে? একসঙ্গে একটা পুরো ওয়ার্ড যেখানে একসঙ্গে থাকত, সেখানে বন্ধুরা আজ দূরে দূরে। হয়তো কারও রুমমেট আজ পাশের ফ্ল্যাটে। আরও সমস্যা হল, আগে হস্টেলে প্রতি দিন সকালবেলা তিনটে দরজা কখন খুলবে তার জন্য সকলে তাকিয়ে থাকত। চার নম্বর দরজাটা খোলা, কিন্তু কমোড বলে কেউ যেত না। দাঁতে দাঁত চেপে সব দাঁড়িয়ে আছে। কত জন হন্তদন্ত হয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। গালাগাল দিতেও পারছে না, পাছে বাঁধ ভেঙে যায়! মাঝে মাঝে জল ছুড়ে দিচ্ছে দরজার ওপর দিয়ে, তাতে যদি ব্যাটা বেরিয়ে আসে। আর আজ দেখো, ফ্ল্যাট-কালচারটাই ইন্ডিয়ান নয়, ফলে সেখানে সকালে বড় দুঃখে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয় ভেতো বাঙালির ছেলেরা।

যেখানে আমাদের ঘর ছিল, তা করে দেবে বড় হলঘর। কাঠের পার্টিশনের দেওয়ালে আঁকা ছিল চে গেভারা, কার্ল মার্ক্সের ছবি। কত জন লিখেছিল নিজেদের নাম। ভেবেছে, যদি কখনও পরে আসি, তবে দেখতে পাব আমার নামটা, ফিরে পাব অতীতের ছোঁয়া। কোথাও লেখা ছিল, ‘সামটাইমস আই থিংক ইফ ইউ ক্যান ফিল মাই ফিলিংস’, অথবা, ‘ইফ দেয়ার ইজ নো হোপ ইউ ক্যান ইনভেন্ট হোপ’— এমনই কত কিছু। আজ ভাঙা কাঠের দেওয়ালগুলো স্তূপাকারে পড়ে আছে মাঠে। এখনও হলুদ রং করা কাঠের ওপর কালো কালির ছাপ দেখতে পাওয়া যাবে।

sunnchatto9@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy