এই মেয়ে, তোর কী হয়েছে রে?” থাকতে না পেরে এক দিন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম। আমি যে হাসপাতালে এখন আছি, সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ডাক্তারবাবুরা কাজ করেন। তারই মধ্যে এক জন সদ্য পাশ করা তরুণী ইন্টার্নকে আমার দফতরে আজকাল দেখতে পাই। অপূর্ব সুন্দরী, টানা টানা চোখ, টিকোলো নাক, কালো ঘন চুল, ফর্সা, কিন্তু সাহেবদের মতো সাদা নয়! আমার ধারণা ছিল পাকিস্তানি বা তুরস্কবাসী। এমন মিষ্টি মেয়ে, কেন যেন মনমরা হয়ে থাকে সারা ক্ষণ!
লাঞ্চ ব্রেকে এক দিন ওকে একা পেয়ে সরাসরি প্রশ্নটা করেই ফেললাম। প্রথমটায় সে অবাক হলেও লম্বা শ্বাস নিয়ে স্নিগ্ধ ভাবে হাসল। যেন বলতে চাইল, ‘যাক, কেউ তো জিজ্ঞেস করল!’
বুঝলাম, আর আমায় কিছু করতে হবে না। তার জন্ম ইরানে। তার জন্মের সময় ইরান উত্তাল। বছর কয়েক আগে ইরানে ঘটে গেছে বিরাট পটপরিবর্তন। ১৯৭৯ সালে ইরানের রাজতন্ত্র আর ১৯০৬ সাল থেকে চলে আসা পারস্য সংবিধানের পরাজয় হয়েছে। প্রো-আমেরিকান, প্রো-ওয়েস্টার্ন ইরানের রাজা মহম্মদ শাহ পাহলভী এক বছরের বিপ্লবের ধাক্কা সামলাতে পারেননি। জয়ী হয়েছেন ইসলামি নেতা আয়াতোল্লা খামেনেই। যে ইরান শাহ-এর আমলে ভূমি সংশোধন দেখেছে, জমির সমবণ্টন আর কৃষকদের সমান অধিকার দেখেছে, দেখেছে সাক্ষরতা অভিযানে সেনেটের সামনে লক্ষাধিক মহিলার মিছিল, দেখেছে বিশ্ব মহিলা ফুটবল প্রতিযোগিতায় ইরানি মেয়েদের সাফল্য, লাইনে দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে মহিলাদের ভোট দিতে দেখেছে, দেখেছে স্কার্ট-শর্টসের ইরানি মেয়েদের টেনিস প্রতিযোগিতায় যোগদান— সেই ইরানে শিয়া মুসলিম নেতা ও বাইরের অন্যান্য দেশ থেকে পিলপিল করে আসতে থাকা শিয়া সমর্থকদের বিপ্লবের পরিণতি যা হওয়ার, তাই হয়েছে। শাহ-এর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। কিন্তু খামেনেই ক্ষমতায় এসেই ইরানি মহিলাদের বোরখার ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেন। ধর্মীয় অত্যাচার আর সুন্দরী নাবালিকা ইরানিদের জোর করে বিয়ে দেওয়ার মধ্যে আর না-ই বা গেলাম! ইরানের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প, ইরান-ইরাক যুদ্ধ, খামেনেইদের সাঙ্গোপাঙ্গদের দ্বারা দীর্ঘ দিন আমেরিকার দূতাবাস ঘেরাও, ইরানের তেলের উপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা, খামেনেইয়ের বিরুদ্ধে শিক্ষিত ইরানিদের বিদ্রোহ, সব মিলিয়ে ইরানের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি আর তেলের শেয়ার দ্রুত নিম্নগামী হল।
এমন এক সময়ে, ১৯৯২ সালে এক জন উদারপন্থী স্কুলশিক্ষক ও তাঁর লাইব্রেরিয়ান স্ত্রীর কোল আলো করে, একটি পুত্রসন্তানের ছ’বছর পরে জন্ম হয় নেই আলিপুর নামে সেই তরুণীর। ‘নেই’ কথাটার ইরানি অর্থ নক্ষত্র, আর আলিপুর পদবি। ওর বাবা ছিলেন খামেনেই-বিরোধী প্রতিবাদী যুবকগোষ্ঠীর নেতা। বোরখা পরতে না চাওয়ায় ওর মায়ের চাকরি চলে যায়। ওদের বাড়ির উপর হামলা হয় একাধিক বার। কয়েক বছর পর বাবারও স্কুলের কাজটি যখন চলে যায়, ঘোর বিপদে পড়ে এই পরিবার। সুরক্ষার কথা ভেবে দেশান্তরি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন নেই-এর বাবা। চলে আসেন তুরস্ক। কয়েক মাস শ্রমিকের কাজ করেন, আর নেই-এর মা সেলাইয়ের। কিন্তু পাকাপাকি নাগরিকত্ব দিতে তুরস্কের সরকার রাজি হয় না, যে হেতু তারা ছিল খামেনেই-এর বন্ধু দেশ। অনেক ভেবেচিন্তে নেই-এর বাবা অস্ট্রেলিয়াতে হিউম্যানিটারিয়ান ভিসার জন্য আবেদন করলেন। অর্থাৎ নিজভূমে নানা অত্যাচার-অপমান সহ্য করে পরবাসী হলে এই ভিসার দ্বারা নাগরিকত্ব পাওয়া যেতে পারে। আবেদন মঞ্জুর হল। অবশেষে নেই-এর চার বছর বয়সে ওরা সপরিবার চলে এল অস্ট্রেলিয়ায়।
এইটুকু শুনে আমি তখন চিন্তা করছি, এটাই কি তা হলে ম্লানমুখের কারণ? কিন্তু এ তো অনেক দিন আগেকার ঘটনা! একটু থেমে নেই বলল, “আসলে আমি ইরানের ‘হাফতসিন’ খুব মিস করছি।”
নতুন শব্দ শুনেই সজাগ হয়ে উঠি। কী সেটা? তখন মার্চ মাস চলছিল। বছরে দু’বার সূর্য যখন ঠিক নিরক্ষরেখার উপরে থাকে এবং পৃথিবীর দুই গোলার্ধেই সমান আলো দেয়, তখন পৃথিবীতে দিন ও রাত প্রায় সমান হয়। এক বার মার্চে আর এক বার সেপ্টেম্বরে। মার্চে এই দিন থেকে পার্সি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নতুন বছর শুরু হয়। পার্সিদের নববর্ষকে ‘নওরোজ়’ বলে। তার সাত দিন আগে থেকে শুরু হয় নানা প্রস্তুতি এবং নওরোজ়ের দিন উৎসব সম্পূর্ণ হয়। একেই ‘হাফতসিন’ বলে। ‘হাফত’ মানে সংখ্যায় সাত, আর ‘সিন’ হল ইংরাজির ‘এস’-এর মতো পার্সি ভাষার একটি অক্ষর। ‘সিন’ বা ‘এস’ দিয়ে শুরু সাতটি জিনিস টেবিলে সাত দিন আগে থেকে রাখা থাকে। সাত সংখ্যাটি ওদের কাছে খুব পবিত্র। এই প্রথা সাসানীয় সভ্যতার, অর্থাৎ প্রায় ছ’হাজার বছরের পুরনো। ওই সাত দিন শুধু আনন্দ, হইচই, কেনাকাটা। এই সময় ছোটরা গুরুজনের বাড়ি গিয়ে দেখা করে শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ নিয়ে আসে। ওই সাতটি ‘এস’ দিয়ে জিনিস হল— ‘সবজে’ বা ঘাস যা প্রকৃতি, উৎপাদন আর আনন্দের প্রতীক, ‘সার’ বা রসুন, যা নিজের অধিকার স্থাপন ও ওষধির প্রতীক, ‘সুমাক’ বা এক ধরনের সুগন্ধি যা জীবনের প্রতীক, ‘সিব’ বা আপেল যা ভালবাসার প্রতীক, ‘সানজেদ’ বা এক ধরনের ফল যা জ্ঞান, পুনরুজ্জীবন, স্মৃতি ও মেধার প্রতীক, ’সেরকে’ হল ভিনিগার যা ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের প্রতীক, ‘সামানু’ হলো পুডিং জাতীয় মিষ্টি যা সন্তান উৎপাদনের প্রতীক। এই সাতটি শুভ জিনিস একটি টেবিলে ইরানি নকশা-করা টেবিলক্লথের উপর সাজিয়ে রাখা হয়। সঙ্গে রাখা হয় আয়না, যা আত্মোপলব্ধির প্রতীক। পরস্পরের বাড়ি যাওয়া, উপহার দেওয়া, হাফতসিন টেবিলে বসে খাওয়া, শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ বিনিময় চলে সাত দিন ধরে। যেন আনন্দের সপ্তপদী।
শুধু এই জন্যই এত মন খারাপ? আমি আরও একটু এগিয়ে জিজ্ঞেস করি, “তুমি কি ডিউটির চাপে এই বছর ‘হাফতসিন’ উপভোগ করতে পারোনি?”
নেই ম্লান হেসে বলে, “এই দিনটা আমার কাছে যেমন আনন্দের, তেমন দুঃখেরও।”
আমি চুপ। নেই থামে না। শেষ যে বছর তারা ইরানে নওরোজ় পালন করেছে, সে বার সন্ধেবেলা তার দাদু-দিদা একটা লাল জামা পরা পুতুল নিয়ে এসেছিল তাদের বাড়ি। নতুন জামা পরে নতুন পুতুল নিয়ে খেলতে ব্যস্ত ছিল নেই। অকস্মাৎ খবর আসে আয়াতোল্লা খামেনেই-এর দলবল তাদের বাড়ি ঘেরাও করতে আসছে। ইরাক-ইরান যুদ্ধের মূল হোতা ইনিই। তার পর ঠিক কী কী হয়েছিল সে দিন, মনে করতে পারে না সে, সদ্য চার বছরের বালিকা তখন। শুধু মনে পড়ে রাতের অন্ধকারে তাড়াহুড়ো করে অন্য কোথাও পালিয়ে আশ্রয় নেয় ওরা, তার পর সাত দিনের মধ্যে তুরস্কে চলে আসে সপরিবার। প্রাণ রক্ষার তাগিদে ইরানের বাড়িতে ফেলে আসে অনেক কিছুই, অনেক স্মৃতি আর লাল জামা পরা সেই নতুন পুতুলটি, যেটা তার পর থেকে প্রতি নওরোজ়ে তার কাছে প্রচণ্ড কষ্টের স্মৃতি হয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
অস্ট্রেলিয়াতেও তারা এবং কিছু ইরানি পরিবার ‘হাফতসিন’ আর ‘নওরোজ’ পালন করে ঠিকই, কিন্তু সাত দিন নয়, দিনকতকের স্বল্প আনন্দ। সে জানে, চাইলেও সে আর ইরানে ফিরতে পারবে না কোনও দিন, যদি না কোনও উপপ্লব ঘটে! কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে যায় নেই।
আমার তখন গলা বুজে আসছে। তাকাতে পারলাম না ওর চোখের দিকে। মনে পড়ল, আমার স্বামী কৌশিক এক বার গাড়ি নিয়ে ইরান গিয়েছিল। ভারতবর্ষ থেকে এসেছে শুনে ওকে প্রায় পাঁজাকোলা করে গাড়ি সমেত নিজেদের বাড়িতে অতিথি হিসেবে নিয়ে গিয়েছিল এক পার্সি দম্পতি। থাকা-খাওয়া-ঘোরা সবেতে এত আন্তরিকতা ছিল যে, কৌশিক প্রায় এক সপ্তাহ থেকে যেতে বাধ্য হয়। কোনও আত্মীয়ের বাড়িতেও সে আজ অবধি এত দিন থাকেনি! এত সুন্দর দেশ, এত সুন্দর যে দেশের মানুষ, তাদের এ কী পরিণতি! বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকার মনখারাপটা নিতান্ত ঠুনকো বলে মনে হচ্ছিল তখন।
সত্যি, বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকুই বা আমরা জানতে পারি!
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)