Advertisement
E-Paper

নরেশ কানোয়ার রঘুদাস হতে চেয়েছিল

নরেশ কানোয়ার ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। খড়্গপুরের একটা স্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম। নরেশ ক্লাসে ফেল করত প্রায়ই, ও যখন আমাদের সঙ্গে থ্রি-তে পড়ে, আসলে তখন ওর পড়ার কথা সেভেনে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

নরেশ কানোয়ার ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। খড়্গপুরের একটা স্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম। নরেশ ক্লাসে ফেল করত প্রায়ই, ও যখন আমাদের সঙ্গে থ্রি-তে পড়ে, আসলে তখন ওর পড়ার কথা সেভেনে। অংকের মাস্টারমশাই অনিলবাবুকে সবাই যে কেন পণ্ডিতজি বলে ডাকত, তা আমি আজও বুঝতে পারি না। এক দিন ক্লাসে এসে বলা নেই কওয়া নেই পণ্ডিতজি এক-এক জনকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন, কে কী হতে চায়। এক-এক জন এক-এক রকম বলল— ডাক্তার, পুলিশ, লেখক। নরেশ বলল, ‘স্যর, আমি অনেক কিছু হতে চাই।’ স্যর বললেন, মানে? একই লোক অনেক কিছু হতে পারে নাকি?

‘প্রথমে ভাবতাম সারা জীবন ঢোলক বাজাব। একটা ঢোলক জোগাড়ও করেছিলাম স্যর, এক দিন ভোর ভোর উঠে প্র্যাকটিস করছি, বাবা ঘুম থেকে উঠে এসে এমন মার মারল... তার পর ভাবলাম সাপুড়ে হব। সাপের খেলা দেখাব এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রাম ঘুরে ঘুরে, আর আমার ঝুড়ির ভেতরে অনেক সাপ থাকবে। আমার বাঁশি শুনে তারা লেজের ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াবে, নাচবে, তার পর আবার ঝুড়ির মধ্যে ঢুকে পড়বে।’

সাপ পাবি কোথায়? ‘কেন স্যর, আমাদের এখানে তো অনেক সাপ! এই তো ক’দিন আগে আমাদের পাশের বাড়ির সন্ধ্যাকে রাত্তিরবেলা ঘুমের মধ্যে সাপে কাটল। পর দিন সকালে সন্ধ্যাকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিল সবাই। সাপদের আমি খুব ভালবাসতাম স্যর, সন্ধ্যা মরে যাওয়ার পর আর বাসি না। এখন আমি স্যর খালি পোস্টম্যান হতে চাই। অন্য কিছু না, খালি পোস্টম্যান।’

এর পর এক দিন সেই শহর ছেড়ে দিয়ে আমরা চলে গেলাম মধ্যপ্রদেশের এক ম্লান, নিষ্প্রভ গঞ্জে, ভর্তি হলাম আর এক স্কুলে, আর এক ক্লাসে। সেই স্কুলেও প্রত্যেকেই কিছু না কিছু হতে চাইত, স্বপ্ন দেখত একটা কিছু হয়ে ওঠার। এক দিন হিন্দি স্যর রচনা লিখতে দিলেন, বড় হয়ে কী হতে চাও। আমি লিখেছিলাম, আমি পোস্টম্যান হতে চাই। নরেশ কানোয়ার কী ভাবে যেন ওই পোস্টম্যান হওয়ার স্বপ্নটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল আমার মধ্যে। বাবার কাছে প্রচুর চিঠি আসত, বাবার কাকার পোস্টকার্ড আসত প্রত্যেক মাসে: স্নেহের তারাকান্ত, বহু দিন তোমাদের কোনও খবর পাই না... আসত প্রচুর ওষুধ কোম্পানির খাম। আস্তে আস্তে হলুদ হয়ে যেত সেই সব খাম, পোস্টকার্ড। অপ্রয়োজনীয় সেই সব খাম আর চিঠি নিয়ে এক জায়গায় লুকিয়ে রাখতাম আমি।

আমাদের বাড়ির চারপাশ ঘিরে ছিল বিন্ধ্য পর্বতমালা, আর তাদের ঢাল জুড়ে বড় বড় গাছের জঙ্গল। ছুটির দিনগুলোয় সেই সব চিঠিপত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম জঙ্গলের ভেতর। এক-একটা গাছ ছিল এক-এক রকম, বেঁটে গাছ, লম্বা গাছ, মোটা গাছ, সরু গাছ, কালো গাছ, সাদা গাছ। এক-এক গাছের গোড়ায় এক-একটা খাম রাখতাম, আর বিকেল গড়িয়ে গেলে আবার সেই খামগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম। বাড়ির কাছাকাছি একটা গাছের গায়ে ঝুলত একটা ডাকবাক্স। যে যার চিঠি লিখে ওই বাক্সে ফেলে দিয়ে আসত। সেই ডাকবাক্সর পেটে কান রেখে আমি চিঠিদের কথা শুনতাম। আমার বন্ধুদের মধ্যেও খেলাটা জমে উঠল। এক-একটা চিঠির এক-একটা গল্প ভেবে নিতাম আমরা, আর সেটা পরস্পরকে বলতাম। ‘উত্তরা’ ছবির কিছু দৃশ্য এ ভাবেই এসেছিল আমার কাছে।

এরও দু-এক বছর পর একটা আধো-শহরে আস্তানা গাড়লাম আমরা। এই শহরে নিত্য পোস্টম্যানদের আনাগোনা ছিল। তখন আমার মনে হত, পোস্টম্যান না হতে পারলে বেঁচে থাকার আর কোনও মানে হয় না! মাঝে মাঝেই পোস্টম্যানের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করতাম এক পাড়া থেকে আর এক পাড়া, এ-পাড়া থেকে বেপাড়া। ভাবতাম, আমার কবে এ রকম খাকি পোশাক হবে! পোস্টম্যানের ঝোলা কাঁধে আমি চিঠির পর চিঠি বিলি করে যাব এক দরজা থেকে আর এক দরজা, যারা চোখে দেখতে পায় না বা পড়তে পারে না, তাদের চিঠি পড়ে শোনাব। এই ভাবেই পেছন পেছন ঘুরতে ঘুরতে আমার সঙ্গে ভাব হয়ে গিয়েছিল রঘুদাস পোস্টম্যানের। সেই অসমবয়সী বন্ধুত্বের বিশ্বাস এমন জায়গায় পৌঁছেছিল, যে, রঘুদাস পোস্টম্যান মাঝে মাঝেই তার হাতে ধরা চিঠির গোছা আমায় বইতে দিত, আর আমিও সেই চিঠি নিয়ে মহানন্দে তার পেছন পেছন ঘুরতাম। রঘুদাসকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার কী আনন্দ, না? কত জায়গায় তুমি ঘুরে বেড়াও, কত নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে তোমার আলাপ হয়, কত চিঠির ভেতরের গল্পও তো তুমি জানতে পারো, এক-একটা গল্প এক-এক রকম, অদ্ভুত সব খবর, তাই না? রঘুদাস বলেছিল, ‘ধুর ধুর, এটা আবার একটা চাকরি! লোকের চিঠি বয়ে বেড়ানো কোনও কাজ হল? আমি তো আসলে ড্রাইভার হতে চেয়েছিলাম, বাসের ড্রাইভার। বিলাসপুর থেকে অনুপপুর, অনুপপুর থেকে মণীন্দ্রগড় বাস চালিয়ে ঘুরব। লোক উঠবে নামবে, আর আমি বাস চালাব।’ চালালে না কেন? ‘চালানোর কথাই তো ছিল। কিন্তু প্রথম দিন বাস নিয়ে বেরিয়েই একটা গরুকে প্রায় চাপা দিয়ে দিচ্ছিলাম, তার পর পাবলিক যা প্যাঁদাল, বাস চালানোর স্বপ্ন এক দিনেই উবে গেল।’

রঘুদাসের বাড়িতেও আমি গিয়েছিলাম কয়েক বার, শহর ছাড়িয়ে নিরিবিলি এক গ্রামে। বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে রঘুদাস বসত বাইরের একটা চৌকিতে, পাশে আমি। রঘুদাসের বউ একগলা ঘোমটা দিয়ে মুড়ি আর ভেলিগুড় দিয়ে যেত আমাদের। পোস্টকার্ড, মানি-অর্ডার ফর্ম নিয়ে আশপাশের গাঁ থেকে অনেক লোক আসত ওর কাছে। মানি-অর্ডারের জন্য এক আনা আর চিঠি লেখার জন্য দু’আনা করে পয়সা নিত রঘুদাস। যে দিন যে দিন আমি থাকতাম, রঘুদাস আমাকে পয়সা গুনতে দিত। চিঠি লেখা শেষ হলে একটা মাটির ভাঁড়ে জমিয়ে রাখত সব পয়সা। মাটির ভাঁড়টা দারুণ ভারী ছিল। আমি বলতাম, কী করবে এত পয়সা? ও বলত, ‘এতেও হবে না। আরও অনেক চাই, তার পর একটা বাস কিনব আমি, লাল রং করব বাসটা। ড্রাইভার লোক তুলবে, নিয়ে যাবে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা, আর আমি ড্রাইভারের পাশে বসে থাকব। চিঠি বিলি করতে, চিঠি লিখে দিতে আমার আর ভাল লাগে না।’ মুড়ি চিবোতে চিবোতে আনমনা হয়ে যেত রঘুদাস, লম্ফের আলোয় চিকচিক করত ওর চোখ, রহস্যময় হয়ে উঠত রঘুদাস।

এর অনেক অনেক পরে, সব ছেড়েছুড়ে সিনেমা করার পাগলামিটা যখন মাথায় চাপল, তখনও বুকের গভীর তলায় শুয়ে আছে এক জন পোস্টম্যান। বার বার সে ফিরে এসেছে আমার নানান ছবিতে। এক দিন খবরে পড়লাম, আমেরিকার এক ছোট্ট শহরে এক জন পোস্টম্যানের জেল হয়ে গেছে। তার অপরাধ, সে চিঠিগুলো বিলি না করে লুকিয়ে রাখত ছাদের ঘরে, গাড়ির ডিকিতে। নিজের ভেতরের পোস্টম্যানটি খুব নাড়া খেয়েছিল, তবু এই চিঠি বিলি করতে না চাওয়া পোস্টম্যানকেও আমার মনে ধরে গেল, রঘুদাসের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ এত দিন পর, আর কেমন করে জানি ‘টোপ’-এর চিত্রনাট্যে ঢুকেও পড়ল সে। কয়েক বছর আগে একটা ছবির লোকেশন দেখতে প্রান্তরের পর প্রান্তর চষে সবাই মিলে ফিরছি আস্তানায়, সূর্য তখন ঢলে পড়েছে একা একটা গাছের ও-পারে, সমস্ত আকাশ নিয়ে। আমি হঠাৎ দেখলাম, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নরেশ সেই গাছের তলায় চিঠির ব্যাগ মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।

ও যে সত্যিই নরেশ ছিল না, তা যে-কেউ জানে, কিন্তু হতেই তো পারে যে ওর নামই নরেশ, আমার ছোটবেলার বন্ধু, যে পোস্টম্যান হতে চেয়েছিল!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy