Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
ধারবাহিক উপন্যাস, পর্ব ২৮
Novel Series

হাওয়ার আড়ালে

মিশুক কস্তুরীকে অনুরোধ করে ওর আর্টিস্টস’ ফোরামের কার্ডটা রিনিউ করিয়ে দিতে। কস্তুরী রাজি হয়। এক দিন ড্রাইভার সফিকুলকে ডেকে সে টেকনিশিয়ানস স্টুডিয়োতে যাওয়া ঠিক করে।

ছবি: পিয়ালী বালা

ছবি: পিয়ালী বালা

অজিতেশ নাগ
শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০২৩ ০৭:০৯
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: মেহুলির সঙ্গে কস্তুরীর সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। তার মধ্যেই মিশুক কস্তুরীকে ফোন করে জানায়, সে আর সব্যসাচী আন্দামানে বেড়াতে যাচ্ছে। কস্তুরী একটু ধাক্কা খেলেও নিজেকে সামলে নেয়। ওরা দেখা করে। মিশুক কস্তুরীকে অনুরোধ করে ওর আর্টিস্টস’ ফোরামের কার্ডটা রিনিউ করিয়ে দিতে। কস্তুরী রাজি হয়। এক দিন ড্রাইভার সফিকুলকে ডেকে সে টেকনিশিয়ানস স্টুডিয়োতে যাওয়া ঠিক করে। মাঝে এক দিন হরিপদবাবুর সঙ্গেও দেখা করার কথা ভাবে কস্তুরী। ও দিকে ছেলের দোষ জানার পরও তার জন্য কষ্ট পাচ্ছেন কেতকীবালা। জানা গিয়েছে, আকিঞ্চনের রেহাই পাওয়ার আশা খুব কম। কারণ আদিনাথ তার সাক্ষ্যে নিজের দোষ স্বীকার করেছে যেমন, তেমনই ফলাও করে বলেছে রাধিয়া ও আকিঞ্চনের অবৈধ সম্পর্কের কথা। আকিঞ্চনের প্রতি ঘৃণা তীব্রতর হয়েছে কস্তুরীর।

মেহুলির মুখটা মনে আসতেই ভিতরটা কেমন খুঁতখুঁত করে উঠল। যতই লোকটা সম্পর্কে আঙ্কল হোক বা বাবার মতো, বাবা তো নয়! কিছুতেই আকিঞ্চনের জায়গায় লোকটাকে বসাতে না পেরে মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। খেয়াল হল গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে।

“আর কতটা দূর?”

“রাস্তায় খুব জ্যাম। সামনে মনে হচ্ছে মিছিল বেরিয়েছে। আমি ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে নিচ্ছি।”

ফের চোখ বুজল কস্তুরী। একটা ছেলের কথা মনে আসছে। কী আশ্চর্য! এত দিন ছেলেটাকে মনেই পড়েনি। হয়তো এত দিনে লোক হয়ে গেছে ছেলেটা। দেখলে কি চিনতে পারবে? কিন্তু তার কথা এখন মনে পড়ল কেন? মিশুক-সব্যর প্রসঙ্গটা মনে আসতেই বোধহয়। কত দিন আগে হবে? কুড়ি বছর? নাকি কুড়ির বেশি? আর সবচেয়ে বড় কথা, তার কথা তো এক রকম ভুলেই গেছিল কস্তুরী। কী যেন নাম ছিল বেশ? সুকোমল? সুকুমার? শুভেন্দু? বেশ কয়েকটা নাম নিয়ে নাড়াচাড়া করে কস্তুরী বুঝল, আপাতত লাভ নেই। তবে চেহারাটা মনে আসছে বেশ। বেশ লম্বা। প্রায় ছ’ফুট। চওড়া কাঁধ। দাড়ি ছিল? না মনে হয়। সরু গোঁফ ছিল একটা। মাথার চুল তেল দিয়ে পিছন দিকে টেনে আঁচড়াত। শার্টের হাতা গোটানো থাকত। আর হ্যাঁ, ভুরুর পাশে একটা কাটা দাগ ছিল। মালবাজার ছেড়ে কলকাতায় পড়তে আসার পর থেকেই সম্পর্ক ঢিলে হয়ে যায়। দ্বিরাগমনের পর রায়বাড়িতে পাকাপাকি চলে আসার পর বেশ কয়েক বছর আর মালবাজার যাওয়া হয়নি।

বিয়ের পর প্রথম বার গিয়ে মনেও আসেনি। কস্তুরী তখন স্বামী-সংসার নিয়ে ডগমগ। ফিরে আসার দিন মনে এসেছিল ছেলেটির কথা। তবে আলাদা করে দেখা করার ইচ্ছে জাগেনি। একই ভাবে প্রথম প্রথম মগ্নতা, শতভিষা, দেবদত্তা, পেখমদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, পরে তাও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই ছেলেটির ব্যাপারে আকিঞ্চনকেও কোনও দিন বলেনি কস্তুরী। একমাত্র অদ্রিজাকে বলেছিল এক দিন মুখ ফস্কে। অদ্রিজা সব শুনে বলেছিল, “চুমু খেয়েছিস?”

“ধ্যাত!”

“ধ্যাত কী রে! প্রেম করবি আর চুমু খাবি না? গুল দিস না মাইরি।”

“না রে। সত্যি। আমরা শুধু পাশাপাশি হাঁটতাম। একে অন্যকে ছোঁওয়ার কথাও মনে আসেনি।”

“মরণ!”

আচমকা চোখ খুলে গেল। কস্তুরী বুঝতে পারল না সে কোথায় আছে। চোখ পরিষ্কার হলে দেখল, সে তার বাড়ির ড্রয়িংরুমেই বসে। আকিঞ্চন বসে কথা বলছে। একটা লোক। লোকটা কে? আকিঞ্চন বলল, “বাব্বা, ঘুমোতেও পারো! দেখো কে এসেছে।”

আকিঞ্চন আঙুল দিয়ে লোকটাকে দেখিয়ে দেয়। কোথায় দেখেছে সে লোকটাকে আগে? মনে পড়েছে। এই লোকটাই তো মেহুলিকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। আকিঞ্চনের গলা কানে এল, “চিনতে পারলে না! ইনি স্বর্ণেন্দুবাবু। মেহু এর সঙ্গেই তো বেড়াতে যাচ্ছে।”

একটা অচেনা লোকের সঙ্গে! আকিঞ্চন কেমন করে যেন মনের কথা পড়ে ফেলে বলল, “অচেনা কেন হবে? তোমার এঁকে মনে নেই? আরে, মালবাজারের দিনগুলো মনে করো। এত ক্ষণ তো এঁকে নিয়েই আমরা ডিসকাস করছিলাম। শুনলাম তোমরা নাকি একে অন্যকে একটা কিস অবধি করোনি? হা হা হা!”

আচমকা লজ্জায় লাল হয়ে গেল কস্তুরী। কিন্তু এ সেই স্বর্ণেন্দু! কোথায় সেই টানটান চেহারা, কোথায় সরু গোঁফ, সেই ব্যাকব্রাশ চুল। হতেই পারে না। তার ভাবনার মাঝেই মেহুলি বেরিয়ে এল ঘর থেকে। কী বাচ্চা বাচ্চা লাগছে দেখতে। কস্তুরী চেঁচিয়ে উঠল, “আকিঞ্চন, ওদের আটকাও। আমাদের মেয়ে এখনও বাচ্চা। হাউ কুড ইউ অ্যালাউ দিস?”

“ম্যাম, ম্যাম...”

একটা হালকা ঝুলের মতো অন্ধকার থেকে উঠে এল কস্তুরী। পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল, গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সফিকুল ঘাড় বেঁকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বলল, “আমরা কত দূর?”

“চলে এসেছি। ওই সামনে টেকনিশিয়ানের গেট। ভিতরে ঢুকবেন তো?”

“হ্যাঁ। তুমি হর্ন দাও।”

হর্ন দিতে দরজা খুলে গেল। সফিকুল গাড়ি ভিতরে ঢোকাতে যেতেই এক জন ইউনিফর্ম-পরা লোক জানতে চাইল, “কোথায় যাবেন?”

একটুও না ঘাবড়ে কস্তুরী জবাব দিল, “আর্টিস্টস’ ফোরাম।”

লোকটা কিছু ক্ষণ কস্তুরীকে নিরীক্ষণ করে সরে দাঁড়াল। ভিতরে গিয়ে গাড়ি পার্ক করাতেই কস্তুরী নেমে এল। মিশুক বলে দিয়েছিল, ‘এন্ট্রি গেটের ঠিক উল্টো দিকে এগজ়িট গেটের সামনে’। সে সোজা তাকিয়ে দেখল সামনে, যদিও অনেকটা দুরে, আর একটা গেট দেখা যাচ্ছে। ওটাই হবে, ভেবে কস্তুরী এগোতে লাগল। এই স্টুডিয়োটা কী বড়! সামনের চত্বরটাই তো বিশাল। বাঁ দিকে একটা বিল্ডিং দেখে মনে পড়ল, একটা সিরিয়ালে এটাকেই হাসপাতাল বানিয়ে দেখিয়েছিল।

মিশুক এক বার গল্পে গল্পে বলেছিল তাদের ইন্ডাস্ট্রিতে কত কী হয়। বলেছিল, “তোমাকে এক দিন দেখাব বিবি, লোকদের কেমন বোকা বানানো হয়। ফ্লোরে ঢুকে দেখবে একটা ঘর। ঘরের চারটে দেওয়াল। কিন্তু চার দেওয়ালে চার রকম সেটআপ। কোনও দেওয়ালে অফিসের ব্যাকগ্রাউন্ড, কোনওটায় মদের দোকানের কাউন্টার, কোনওটায় বেডরুম, আবার আর একটায় অন্য কিছু। শুধু ক্যামেরা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এক এক রকমের গল্প দেখানো হয়।”

শুনে চোখ কপালে উঠেছিল কস্তুরীর।

এগজ়িট গেটের সামনে যেতেই দেখতে পেল ‘আর্টিস্টস’ ফোরাম’ লেখা সাইনবোর্ড। ফোর্থ ফ্লোর। মোবাইল সাইলেন্ট করে লিফট দিয়ে পাঁচ তলায় উঠে বেরোতেই সামনে অফিস। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে কাউন্টারে মিশুকের কার্ডটা দেখাতেই আর অতিরিক্ত শব্দ খরচা করতে হল না তাকে। কাউন্টারের ভদ্রলোক তাকে অপেক্ষা করতে বলল।

অফিসঘরটা দেখতে লাগল কস্তুরী। চার দিকে প্রচুর অভিনেতার ছবি। উত্তম-সুচিত্রা, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যাল আরও কত জনের ছবি, যাঁদের অভিনয় দেখার জন্য এক সময় মানুষ পাগল ছিল। ঘরের মাঝামাঝি দেওয়ালে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের বড়সড় ফোটোগ্রাফ। ফোটোর নিচের লেখাটা পড়ে চমকে উঠল কস্তুরী। তা হলে শুভেন্দুবাবুই এই আর্টিস্টস’ ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা! আরও কিছু তথ্য জোগাড় করেছিল কস্তুরী, সেটা অবশ্য অফিসের বাইরের নোটিস বোর্ড দেখে। ওয়েস্ট বেঙ্গল মোশন পিকচার্স আর্টিস্টস’ ফোরামের সভাপতি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কার্যকরী সভাপতি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। আরও কত নাম! কত পদ! সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, কার্যকরী সদস্য।

সাড়ে পাঁচশো টাকা জমা দিয়ে যখন কার্ড-ফার্ড সব নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল, তখন বাইরে বাতাস বইছে দ্রুত। আচমকাই শীত-শীত করতে লাগল কস্তুরীর। ঝড় উঠবে না কি? আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, একটাও তারা দেখা যাচ্ছে না। কস্তুরীকে বাইরে আসতে দেখেই সফিকুল দৌড়ে এল, “তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠুন ম্যাম।”

কস্তুরীর ইচ্ছে ছিল কাজ মিটে গেলে একটু ঘুরে দেখবে টেকনিশিয়ানের চত্বর। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“আপনি ভিতরে ছিলেন তাই টের পাননি। বহুত জোরে ঝড় উঠেছিল। ওই দেখুন।”

সফিকুল যে দিকে আঙুল দেখাল, তাকিয়ে দেখল কস্তুরী। ঢোকার সময় খেয়াল করেনি। একটা উঁচু চওড়া জায়গায় কোনও সিরিয়াল বা সিনেমার সেট ফেলা হয়েছিল। আপাতত সেখানে কেউ নেই। তবে চেয়ার, বড় ছাতা সব উল্টে পড়ে রয়েছে ইতস্তত। বাপ রে! মাত্র তো মিনিট কুড়ি ছিল সে অফিসের ভিতরে। তার মধ্যেই এই! সফিকুল এ বার তার ব্যাগের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ম্যাম, আপনার মোবাইল বাজছে কি?”

ব্যাগ থেকে মোবাইল বার করল কস্তুরী। মিশুক! তাড়াতাড়ি রিসিভ করতেই মিশুকের উদ্বিগ্ন স্বর ভেসে এল, “অনেক ক্ষণ ধরে ফোন করছি বিবি, ছিলে কোথায়? শরীর ঠিক আছে?”

“আর্টিস্টস’ ফোরামের অফিসে ছিলাম রে। তাই ফোন সাইলেন্ট ছিল। কেমন আছিস তোরা?”

“আমরা ভাল আছি। স্কুবা ডাইভিং করেছি। নিকোবর আইল্যান্ডেও গিয়েছিলাম।”

আরও কত কী হুড়মুড় করে বলে যাচ্ছিল মিশুক। শুনতে শুনতে মনখারাপ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল কস্তুরীর। মনে হচ্ছিল মেয়েটা এই সময় কত্ত দূরে! ইস, কী ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে মেয়েটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে রাখতে। জড়িয়েই রাখতে।

“তোমার কি মনখারাপ? আর তো দু’-এক দিন বাকি ফিরতে! মন খারাপ কোরো না বিবি। তা হলে আমারও মন খারাপহয়ে যাবে।”

ধরে ফেলেছে! কস্তুরী তাড়াতাড়ি সামাল দিল, “আরে না না। বাড়িতে ফোন করেছিলি?”

“হ্যাঁ। সাবধানে থেকো।”

“তোরাও ভাল করে বেড়িয়ে আয়। সাবধানে থাকিস দু’জনে, মা।”

পাড়ায় ঢোকার মুখে হরিপদবাবুর বাড়ির সামনে অনেক মানুষের জটলা আর তার সঙ্গে একটা পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কস্তুরী অবাক হল। গ্যারেজে গাড়ি পার্ক করে সফিকুল তার পেমেন্ট নিয়ে চলে যেতেই কস্তুরী ফের অকুস্থলে এল। উঁকিঝুঁকি দিয়েও কিছু বুঝতে পারল না। ভিড় ঠেলে একটি ছেলে বেরিয়ে আসতেই কস্তুরী চিনতে পারল। পলাশ! ছেলেটি বলল, “উফ কী সিন! আপনি দেখতে যাবেন না ম্যাডাম।”

“হয়েছেটা কী?”

“হরিবাবু আর তার মিসেস সুইসাইড করেছে। ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আছে। জিভ-ফিভ বেরিয়ে... বিচ্ছিরি কাণ্ড!”

সে কী! কস্তুরীর হাঁটুদুটো এক বার কেঁপে উঠল। শেষে আত্মহত্যা? অজান্তে চোখ ভিজে এল কস্তুরীর। নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হল। কত দিন ভেবেছে এক বার গিয়ে দেখা করে আসবে। সে রোজ অফিস যায়, ফিরে আসে, মিশুকের সঙ্গে প্রচুর জায়গায় যায়, স্টুডিয়ো যায়, আজ টালিগঞ্জ চলে গিয়েছিল আর দুটো বাড়ি পরে যাওয়ার সময় বার করতে পারল না!

পলাশ চলে গেল। আর ভিতরে গিয়ে কী হবে? এর পর পুলিশ তদন্ত শুরু করবে। কালকের খবরের কাগজে হয়তো ‘বৃদ্ধ দম্পতি আত্মঘাতী’ শিরোনামে খবর বেরোবে। পাড়ায় কয়েকটা দিন কথা হবে, তার পর বাড়িটা ভূতের বাড়ির মতো পড়ে থাকবে।

বিষণ্ণ মনে গেট খুলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে একটা উৎকট চিন্তা মনে এল। সত্যিই কি হরিপদবাবু সস্ত্রীক সুইসাইড করেছেন? হরিপদবাবুর বেশ বয়স। তার উপরে হাঁটুতে প্রবলেম। নিশ্চয়ই তার স্ত্রীও কচি খুকিটি ছিলেন না। তাঁদের পক্ষে কি উঁচু টুল, চেয়ার বা টেবিলে উঠে সিলিং থেকে ঝোলা পাখায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়া সম্ভব? না কি অন্য কিছু? খুব বেশি ভাবার দরকার নেই। সরল অঙ্ক। হরিপদবাবুর কেউ নেই তিন কুলে, সবাই জানত। ছেলে ছিল, সেও নেই। তার মানে, এই দু’জন চলে গেলেই অত বড় তিনতলা বাড়িটা জমিসমেত বিলকুল বেওয়ারিশ। কেয়াবাত! তার মানে বছর দেড়েকের মধ্যে সব মিলিয়ে হেসেখেলে বড়সড় চব্বিশটা থ্রি-বিএইচকে ফ্ল্যাট রেডি!

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে কস্তুরী টের পেল, কপালের দু’ধারে ব্যথা করছে। সঙ্গে সামান্য কাঁপুনি। জ্বর আসছে না কি?

সিটি সিভিল কোর্ট থেকে হাইকোর্টে উঠেছিল আকিঞ্চনের মামলা। অপরাধ, স্ত্রীর বর্তমানে অন্য নারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন আর তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা। তার জন্য কোর্টের আদেশানুসারে কস্তুরীকে হাজিরা দিতে হয়েছিল। দরকার হয়েছিল সাক্ষ্যগ্রহণেরও। বেশ কয়েক মাস ধরে চলেছিল শুনানি। সাক্ষ্য দিতে এসে কস্তুরী স্বীকার করেছিল, সেই দিনের আগের দিন সন্ধেয় রাধিয়া এসেছিল তার কাছে আশ্রয় চাইতে। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আকিঞ্চনের মুখটা ঝুলে গিয়েছিল সে দিন, দেখতে পেয়েছিল কস্তুরী।

অবশেষে সেই দিন। মার্চের তিন তারিখ। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারা অনুযায়ী আট বছর জেল হল আকিঞ্চনের। আদিনাথের পাঁচ বছর। আকিঞ্চনের উপরে অবশ্য ৩০৬-এর পাশাপাশি ৪২০ ধারাও আরোপ হয়েছিল। হাতকড়া পরিহিত আকিঞ্চনকে দু’জন পুলিশ দু’দিক থেকে ধরে রেখেছিল। এক পাশে ইনস্পেক্টর ঘোষালকেও দেখতে পেয়েছিল কস্তুরী। পরে শুনেছিল এত দিনের নুন খাওয়া ঘোষালও নাকি আকিঞ্চনের বিপক্ষেই সাক্ষ্য দিয়েছিল।

কোর্টের রায় শুনে কোনও ভাবান্তর হয়নি আকিঞ্চনের। কিন্তু পুলিশ ভ্যানে তোলবার আগে এক বার চোখাচোখি হয়েছিল কস্তুরীর সঙ্গে। সে দিন কস্তুরীর সঙ্গে মেহুলি ছিল। মনে আছে আচমকাই সকলকে চমকে দিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল আকিঞ্চন। এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে, দু’জন পুলিশের পক্ষে তাকে ধরে রাখা মুশকিল হচ্ছিল। কেঁদে ফেলেছিল মেহুলিও।

শুধু কস্তুরীর দুটো চোখ ছিল খটখটে শুকনো। সে তত ক্ষণে মনস্থির করে ফেলেছে আকিঞ্চনের মেয়াদ খেটে ফিরে আসার আগেই সে বেরিয়ে যাবে রায়বাড়ি ছেড়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Series Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE