নাগরিক: শিল্পীর ছবিতে কলকাতার চিৎপুরের রাজপথ। জনজীবন তখনও অতিষ্ঠ ছিল রোগ-অসুখের প্রকোপে। উনিশ শতকের ছবি
মারা যাচ্ছেন সুকুমার রায়। পুত্রের পায়ের উপর মুখ গুঁজেছেন বিধবা মা। স্ত্রী সুপ্রভা দেবী মাথার কাছে একটা ছোট টুলে বসে, মুখে কথা নেই, বন্ধ চোখ থেকে বইছে জলের ধারা। মৃত্যু এল পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে, ‘আবোল তাবোল’ ছেপে বেরনোর ন’দিন আগে। রোগের নাম কালাজ্বর।
তত দিনে বেরিয়ে গিয়েছে কালাজ্বরের দিশি ওষুধ, ইউরিয়া স্টিবামিন। ১৯২২ সালের অক্টোবরে, সুকুমারের মৃত্যুর প্রায় এক বছর আগে, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চে তার সফল প্রয়োগের কথা লিখেছেন। তা সত্ত্বেও সুকুমার কেন সেই ওষুধ পেলেন না? সম্ভবত তার কারণ, কলকাতার সাহেব ডাক্তাররা তখনও তাকে ছাড়পত্র দেয়নি। সুকুমারের চিকিৎসা করছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, মেয়ো হাসপাতালের অধ্যক্ষ দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্র। তিনি ক্যাম্বেল মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসকের আবিষ্কারের কথা জানতেন কি না, কে জানে। লীলা মজুমদার লিখছেন, ‘সেবাযত্ন, ওষুধপত্রের কোনও ত্রুটি হয়নি।’ কী ছিল সেই ওষুধ, তা অবশ্য জানা যায় না।
১৩০ বছর আগে জন্মানো মানুষটি যেন কলকাতার মুখ। এই রেনেসাঁ শহরে নইলে সুকুমারের মুক্তচিন্তা আর আদ্যন্ত শহুরে রসবোধ জন্মাত না (আর কোথায় কল্পনায় ধরা দিতে পারে ট্যাঁশগরু?)। তাঁর অকালমৃত্যুর কারণও এই শহর, পত্তনের সময় থেকেই যার পরিচয় তার মহামারী। ‘রেতে মশা দিনে মাছি’ নিয়ে জ্বরের শহর কলকাতা। ধনী-গরিব, কেউ রক্ষা পায়নি। বঙ্কিমচন্দ্রের পরিবারের এক পুত্রবধূ স্বামীকে চিঠি লিখছেন, ‘প্লিহা বড় হওয়াতে আমার পেট বড় হইয়াছে।’ স্বামীর বিরহে সে ওষুধ খায়নি, জানাচ্ছে অভিমানী মোতিরানি।
মজা হল, জোব চার্নক যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঘাঁটি পত্তন করেছিলেন কলকাতায়, তার একটা কারণ ম্যালেরিয়া এড়ানোর তাগিদ। গোড়ায় গিয়েছিলেন হুগলি। সেখানে মুঘল নবাবের নায়েব-গোমস্তাদের আস্তানা। তাদের খাঁই মেটাতে নাজেহাল হয়ে গেলেন হিজলিতে। সেখানে যেমন বাঘ, তেমনি মশা। ১৬৮৭-র ফেব্রুয়ারি থেকে জুন, তিন মাসে দলের প্রায় দু’শো জন মারা গেল জ্বরে। অতঃপর উলুবেড়িয়া ট্রায়াল দিয়ে এলেন সুতানুটি। গোবিন্দপুর খাল (এখনকার টালি নালা), পূর্বে সল্ট লেক আর উত্তরে ইছাপুর খাল সুতানুটি-কলকাতা-গোবিন্দপুরকে প্রায় একটা দ্বীপ তৈরি করেছে। মুঘল সেনা চট করে আক্রমণ করতে পারবে না। ১৬৯০ সালে পত্তন হল কলকাতার।
চার্নক কি আর জানতেন, এক দিন লাল কাগজে ছেপে পোস্টার পড়বে ‘শত্রুর চাইতে অনেক বেশি সৈন্য মারে ম্যালেরিয়া’? ব্রিটিশ সেনাদের নির্দেশ দেওয়া হবে, ‘তুমি ঢুকছ ম্যালেরিয়া এলাকায়। কম্যান্ডিং অফিসারের নির্দেশ মেনে সব সতর্কতা পালন করো।’ এক সাহেব লিখছেন, ১৭০০ সালে কলকাতায় প্রায় ১২০০ ইংরেজ ছিল, জ্বরের কোপে পরের বছর ৪৬০ জন কবরে। কোম্পানি গিয়ে রানির শাসন এল, তখনও ফোর্ট উইলিয়াম, ব্যারাকপুর, দমদম, আলিপুর— চারটে ক্যান্টনমেন্টে সব চেয়ে বেশি মৃত্যু জ্বরে। গোরা সৈন্য বাঁচাতে জনস্বাস্থ্যের পত্তন কলকাতায়। নেটিভ মরলে তাদেরও মরতে হয়। আর জ্বর তো নেটিভদের লেগেই আছে। নেটিভ হাসপাতালের এক ডাক্তার লিখছেন (১৮৩৩), নেহাত পিলে খুব না ফুললে, আর পেট ছেড়ে না দিলে কেউ জ্বরের জন্য ডাক্তার দেখায় না।
তবে নেহাত মরে না যায়, তার জন্য পুজো দেয়। খিদিরপুরের ওলাইচণ্ডী মন্দির, পাড়ায় পাড়ায় শীতলা মন্দির মহামারীর উত্তরাধিকার। দু’শো বছর ধরে ‘সিটি অব প্যালেস’ কলকাতা, কংগ্রেসি-স্বদেশী-সন্ত্রাস-হরতালের কলকাতার সঙ্গে গলাগলি বাস করেছে মহামারীর কলকাতা।
দু’শো বছর আগের এই গল্পই ধরুন। ডাকসাইটে ধনী রূপলাল মল্লিকের নতুন বাড়িতে গৃহপ্রবেশ। বিশপ হেবরের স্ত্রী লিখছেন, সেখানে রইসদের ‘হার্টথ্রব’ বাইজি নিক্কির গান শুনেছেন (পর পর তিন রাতের মুজরোর জন্য যাঁর ‘রেট’ ছিল হাজার টাকা আর দু’খানা কাশ্মীরি শাল), গান শুনতে গিয়ে তিনি মশার কামড়ে তিষ্ঠোতে পারেননি। তাঁর নালিশ, অতিকায় বাড়ির যেটুকু অতিথিরা দেখবে, তা বাদে বাকিটা বিশ্রী নোংরা, জমে-থাকা ময়লা এড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়েছে সাবধানে।
আজ যেমন পঞ্চাশ-লাখি পুজোমণ্ডপে অপূর্ব কারুকাজ দেখে বেরিয়ে আবর্জনার স্তূপ পাশ কাটাতে হয় সন্তর্পণে। দুর্গাদালান থেকে প্রতিমা আজ কর্পোরেশনের রাস্তায়, কিন্তু সর্বজনীন পুজোর কর্তারা ‘রিপ্যাকেজ্ড’ জমিদার। তাই জাঁকজমক আর জঞ্জালের এমন সাবেকি সহাবস্থান। তাই পুজোর পরেই শহরে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া।
কতগুলো শতাব্দী একত্রে বেঁচে আছে এই শহরে? একশো বছর আগের সরকারি রিপোর্ট বলছে, ক্যাম্বেল হাসপাতালের জলাশয়ে মিলেছে অ্যানোফিলিস মশার লার্ভা। সেই হাসপাতাল এখন নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ। এনআরএস-সহ কলকাতার সব মেডিক্যাল কলেজ আজও মশার আঁতুড়ঘর। দেড়শো বছর আগে যখন বর্ধমানে, নদিয়ায় হাজার হাজার মানুষ মরছিল জ্বরে, জনসংখ্যা নেমে আসছিল অর্ধেকে, তখন কেউ বুঝতে পারছিল না রোগটা কালাজ্বর না ম্যালেরিয়া। তার পর রোনাল্ড রস কলকাতাতে বসেই মশার হুলের মাহাত্ম্য বুঝলেন, উপেন্দ্রনাথ কালাজ্বরের ওষুধ বিক্রি করে লক্ষপতি হলেন। আজ পাড়ায় পাড়ায় প্যাথ ল্যাব। তবু বোঝা যাচ্ছে না, লোকে কিসে মরছে— ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, না কি আর কোনও জ্বর। আজও নিরাময়ের উপায় হাতের কাছে, তবু বিনা চিকিৎসায়, ভুল চিকিৎসায় মরছে মানুষ।
কলকাতায় শোকতাপের একটাই অ্যান্ডিডোট, চুটকি। আজকাল সুকুমারের ‘হযবরল’ নিয়ে প্যারডি ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়াতে —
তুমি কে? তোমার কী হয়েছে?
সে খানিকক্ষণ ভেবে বলল, ‘আমার অজানা জ্বর হয়েছে। আমার অজানা জ্বর হয়েছে, আমার ভাইয়ের অজানা জ্বর হয়েছে, আমার পিসের অজানা জ্বর হয়েছে...’
‘তার চেয়ে সোজা করে বললেই হয় তোমার গুষ্টিসুদ্ধ সবার অজানা জ্বর হয়েছে।’
সে আবার খানিক ভেবে বলল, ‘তা তো নয়, আমার সেপ্টিসিমিয়া উইথ লো প্লেটলেট কাউন্ট। আমার মামার সেপ্টিসিমিয়া উইথ লো প্লেটলেট কাউন্ট, আমার খুড়োর সেপ্টিসিমিয়া উইথ লো প্লেটলেট কাউন্ট ...’
এই না হলে আমরা দাদাঠাকুরের সুপুত্তুর? তিনি ডিএল রায়ের গানে কথা বসিয়েছিলেন, আমি সারা সকালটি করি নাই কিছু করি নাই কিছু আর/ শুধু মাদুরেতে শুয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ম্যালেরিয়া জ্বরে কেঁপেছি...’। বিছের হুলের মতো, এই প্যারডির বিষ শেষ দু’লাইনে — ‘আছে সবার উপরে মাথা তব প্রভু, উপেক্ষা কভু ঘৃণা গো/ ধর চৌষট্টি হাজার সহিত চাষার অন্তিম নিশ্বাস রেখেছি।’ জ্বরে মৃত্যু চৌষট্টি হাজার। তখনও যোগ হয়নি তেতাল্লিশের মন্বন্তরের তিরিশ লক্ষ মৃত্যু, যখন অনাহারে মৃতপ্রায়দের শেষ ধাক্কা দিয়েছিল ম্যালেরিয়া, কলেরা, বসন্ত। দেশ যে বছর স্বাধীন হয়, সে বছর বিরাশি হাজার বাঙালি মারা যায় ম্যালেরিয়ায়। সে সময়ের একটা রিপোর্টে (১৯৪৪) জানা যায়, মহামারীর সময়ে এন্তার কালোবাজারি হত কুইনিন। আজ ডেঙ্গির বাজারে ব্ল্যাক হচ্ছে রক্তের প্লেটলেট।
তবু তফাত একটু আছে। ‘বিদূষক’ শরৎচন্দ্র বিদেশি শাসককে স্বনামেই খোঁচা দিয়েছেন। আজ গণতান্ত্রিক ভারতে সব বাঙালি প্যারডি-রচয়িতার নাম, ‘সংগৃহীত।’ মশা কমেনি, ভয় বেড়েছে।
কেন কলকাতা মশা-মাছি আর জ্বরের আড়ত, তা নিয়ে নানা থিওরি মেলে। সাহেবদের পছন্দের ব্যাখ্যা ছিল হিন্দুদের চরিত্রদোষ। যারা দিনে তিন-চার বার চান করে, তাদেরই বাড়ির পাশের রাস্তায় মলমূত্র, গঙ্গায়-খালে মৃতদেহ। নেহাত শেয়াল, হাড়গিলে, কাক-চিল ছিল বলে রক্ষে। শুনে অন্যেরা তেড়েফুঁড়ে বলেন, তোমরাই বা কিসে কম বাপু? শিল্পবিপ্লবের পর লন্ডনের কী হাল ছিল, প্লেগ-পক্সে কত মরেছে, তা নিয়ে আর মুখ খুলিও না। আবার কেউ একটু সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন। আসলে কলকাতা তো কারও দেশ-মুলুক ছিল না। শহরটাই বহিরাগতদের। মজুর, কেরানি, বণিক, জমিদার, সবাই টাকার ধান্দায় এসেছে। যারা দু’পয়সা করেছে, তারা পথঘাট, মন্দির-ইস্কুল নির্মাণ করেছে দেশ-গ্রামে, কলকাতায় নয়। প্রযুক্তিবাগীশের উত্তর, ইংরেজগুলোই মুখ্যু। ভেবেছিল কলকাতার ঢাল গঙ্গার দিকে। আদতে ঢালু সল্ট লেকের দিকটা। ভুলভাল খাল কাটার ফলে নিকাশির বদলে জল দাঁড়িয়ে গেল। জ্বর তাড়াতে সল্ট লেকের জলাজমি ভরাট করে দেওয়া উচিত, উঠেছিল দাবি।
যদি সে দিন সাহেবরা তা মেনে নিত, যদি সিপাহি বিদ্রোহের আগেই ভরে যেত সল্ট লেকের জলাজমি, কলকাতার ম্যাপটা অন্য রকম হত। তা হয়নি, কিন্তু ইতিহাসের গতি ঠিক করেছে জ্বর। তৈরি হল ফিভার হাসপাতাল কমিটি। দ্বারকানাথ ঠাকুর, রসময় দত্তেরা চাঁদা দিলেন। কলকাতায় জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য চাঁদা সেই প্রথম। মতিলাল শীলের দান-করা জমিতে তৈরি হল মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতাল। কলেজ শুরু ১৮৩৫, হাসপাতাল ১৮৫২ সালে। এশিয়ার প্রথম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। প্রেসিডেন্সি কলেজ যেমন তৈরি করেছিল সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহাদের, তেমনই মেডিক্যাল কলেজ থেকে উঠে এলেন উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, কেদারনাথ দাস, শম্ভুনাথ দে, সুবোধচন্দ্র মিত্র। বিংশ শতকে বিশ্বের চিকিৎসা মানচিত্রে স্থান পেল কলকাতা।
শুধু কলকাতা কেন? ম্যালেরিয়া নির্ধারণ করেছে বহু শহরের, এমনকী সভ্যতার ইতিহাস। মায়া সভ্যতা উজাড় করেছিল ম্যালেরিয়া। আলেকজান্ডারকে বিষ দেওয়া হয়েছিল, নাকি ভারতের মশা ঢেলেছিল ম্যালেরিয়ার বিষ? তাঁর সাকিন গ্রিস দেশ থেকে রোগ ছড়ায় রোমে। সতেরোজন পোপ মারা গিয়েছেন ম্যালেরিয়ায়। ইতালি ছিল ম্যালেরিয়ার আড়ত, যদ্দিন না মুসোলিনি নামে এক যুদ্ধবাজ ফাসিস্ত শাসক জলা বুজিয়ে ধ্বংস করেন মশার বংশ।
কলকাতা কি ফাসিস্ত শাসক দেখেছে? বিতর্ক চলতে পারে। তবে শাসকের আদেশে গুলি চলেছে, লোক মরেছে। মশা মরেনি। প্রতি বছর মারণ-পতঙ্গের পাখার ডাকে জেগে ওঠে অতীতের প্রেত। স্কুলবালক, কলেজতরুণীর চোখে ঘনিয়ে আসে ঘুমের ঘোর, সাঙ্গ হয় জীবনের গান। কলকাতার রাস্তায় তখন তারস্বরে বাজে ছট কিংবা জগদ্ধাত্রী পুজোর মাইক। এ শহরে মৃত্যুও এক পার্বণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy