E-Paper

কর্মের শিক্ষায় কৃষ্ণের বাসুদেবত্ব

পিতার নাম বসুদেব বলেই কিন্তু কৃষ্ণ বাসুদেব নন। বাসুদেব নামের পিছনে লুকিয়ে আছে মহাভারতের এক জটিল ধারণা। ভগবদ্গীতার সর্বোচ্চ দেবতা বাসুদেব। মহাভারতের শান্তিপর্বে তিনি বলেছেন, তিনি সমগ্র জীবজগতের আবাসস্থল, তাই তিনি বাসুদেব। আবার জৈন কিংবদন্তিতেও রয়েছে বাসুদেব ও প্রতিবাসুদেবের উল্লেখ, যাঁরা আসলে কৃষ্ণ ও জরাসন্ধ।

কণাদ সিংহ

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০২৫ ০৭:৫৯

বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের অন্যতম নাম কেন? তাঁর বাবার নাম বসুদেব বলে? শুধু তা নয় কিন্তু। বাসুদেব নামের পিছনে লুকিয়ে আছে এক জটিল ইতিহাস, যা উঠে এসেছে ‘মহাভারত’-এর এবং কৃষ্ণের ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে আলোচনায়। রোমিলা থাপর, রামশরণ শর্মা, কেভিন ম্যাকগ্রা প্রমুখের গবেষণায় দেখেছিলাম, পরবর্তী সময়ে নিজেও কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, মহাভারত রচনার ইতিহাসকে দু’টি প্রধান স্তরে ভাগ করা যায়। মহাভারতের মূল কেন্দ্রীয় আখ্যান গড়ে উঠেছে পরবর্তী বৈদিক যুগের প্রথম দিকের কুরু-পাঞ্চাল জনপদের প্রেক্ষাপটে। চারণকবিদের এই মৌখিক সৃষ্টি পরে লিখিত ও বিধিবদ্ধ রূপ পেয়েছে ব্রাহ্মণদের হাতে। তাঁরা মূল আখ্যানের পরিবর্তনের সঙ্গে সংযোজন ঘটিয়েছেন অনেক নতুন অংশেরও। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক উপকথা এবং উপদেশমূলক সংলাপ, যেগুলির সঙ্গে বক্তা ও শ্রোতার পরিচয় ছাড়া মহাভারতের মূল আখ্যানের বিশেষ সম্পর্ক নেই। এই অংশগুলির উপর বিশেষ ভাবে রয়েছে মৌর্য-পরবর্তী ও গুপ্তযুগে গড়ে ওঠা ভাগবত-বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব। কৃষ্ণকে বিষ্ণুর সঙ্গে একাত্ম করে দেখাও মহাভারতের বৈষ্ণবায়ণেরই বৈশিষ্ট্য।

কৃষ্ণ কি তবে মহাভারতের মূল আখ্যানের অংশ ছিলেন না? কৃষ্ণ কুরু বা পাঞ্চাল নন। কিন্তু মহাভারতের মূল আখ্যানের সঙ্গে কৃষ্ণ অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। কৃষ্ণবিহীন আদি-মহাভারতের কল্পনা যে পণ্ডিতেরা করার চেষ্টা করেছেন, কেউই সফল হননি। উপরন্তু কৃষ্ণের উল্লেখ মেলে বিভিন্ন প্রাচীন উপাদানে। ‘ছান্দোগ্য উপনিষদ’-এর মতো প্রাচীন উপনিষদে ঘোর আঙ্গিরসের ছাত্র হিসেবে দেবকীপুত্র কৃষ্ণের উল্লেখ রয়েছে। কৃষ্ণ ও অর্জুনের উপাসক গোষ্ঠীর উল্লেখ করেছেন পাণিনি। মেগাস্থিনিস দেখেছেন, মেথোরা (মথুরা) ও ক্লিজোবোরা (কৃষ্ণপুর?) নগরে শূরসেন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক যোদ্ধার উপাসনা, যাঁকে তিনি গ্রিক বীর হেরাক্লিসের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। এই যোদ্ধা অবশ্যই কৃষ্ণ। প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন পরম্পরায়, এবং খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকের নাট্যকার ভাসের একাধিক নাটকে রয়েছে কৃষ্ণকথার উপস্থিতি। এর মধ্যে কৃষ্ণের বাল্য-কৈশোর সম্পর্কিত কিংবদন্তিও রয়েছে, যা মহাভারতে অনুপস্থিত বলে পরবর্তী কালে রচিত হয়েছে ‘হরিবংশ’।

গুপ্তযুগ থেকে রচিত পুরাণগুলিতেও কৃষ্ণকাহিনি পাওয়া যায়, যার মধ্যে ‘বিষ্ণুপুরাণ’ প্রাচীনতম। খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে রচিত প্রাকৃত কাব্যসঙ্কলন ‘গাথাসপ্তশতী’র তিনটি কবিতায় কৃষ্ণের উল্লেখ মেলে। প্রাচীন তামিল সঙ্গম সাহিত্যে উল্লিখিত পশুপালকদের দেবতা মায়োন বা ময়বনও কৃষ্ণের সঙ্গে একাত্ম। সব মিলিয়ে প্রাচীন সাহিত্যের নানা উপাদানে কৃষ্ণের উপস্থিতি অনস্বীকার্য, যার অনেকগুলিই রচিত মহাভারতের বৈষ্ণবায়ণ ঘটার আগে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, কৃষ্ণ এক না বহু? মথুরা-বৃন্দাবনের গোপালক কৃষ্ণ, মহাভারতের কৃষ্ণ, আর দ্বারকার যাদব-বৃষ্ণিগোষ্ঠীর নেতা কৃষ্ণ কি একই ব্যক্তি? প্রথম জনের উল্লেখ মহাভারতে প্রায় নেই বললেই চলে। তবে কি এক ঐতিহাসিক বৃষ্ণি বীরের কাহিনির সঙ্গে পরবর্তী কালে মিশে গেছে পশুপালক গোষ্ঠীর এক রাখাল-দেবতার কিংবদন্তি? রয়েছে নানা মত। কিন্তু, কৃষ্ণের বৈষ্ণবায়ণ ঘটারও আগে থেকে, পাণিনি-মেগাস্থিনিসের সময়েও কৃষ্ণের এক ধরনের দেবতায়ন ঘটে গিয়েছিল। এই কৃষ্ণ আর মহাভারতের কৃষ্ণ যে অভিন্ন, তার প্রমাণ মেলে পাণিনির বিবরণে কৃষ্ণের সঙ্গে অর্জুনের উপাসকদের উল্লেখে। যাদব-বৃষ্ণিরা তাঁদের বীর পূর্বপুরুষদের উপাসনা যেমন করতেন, তেমনই কৃষ্ণ ও অর্জুনকে যথাক্রমে নারায়ণ নামক এক লৌকিক দেবতা এবং তাঁর নর-নামক সহযোগীর অবতার ভাবার চলও ছিল। বৈষ্ণবধর্মের উত্থানের পর নারায়ণ ও বিষ্ণু একাত্ম হয়ে গেলে কৃষ্ণও স্বয়ং বিষ্ণু বা বিষ্ণুর অবতার হিসেবে পরিচিত হন। কিন্তু তার আগে কৃষ্ণের দেবত্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর ‘বাসুদেব’ পরিচয়।

পাণিনি কৃষ্ণের উপাসকদের ‘বাসুদেবক’ বলেই উল্লেখ করেছেন। পাণিনির ভাষ্যকার পতঞ্জলি বাসুদেবের হাতে কংসবধের উল্লেখ করে বলেন, বাসুদেব এক জন দেবতার নাম। বৃষ্ণিবংশীয়রা বৃষ্ণিবীরদের যে পাঞ্চরাত্র পদ্ধতিতে উপাসনা করতেন, সেখানেও কৃষ্ণ বাসুদেব নামেই পরিচিত। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের ব্যাকট্রিয় গ্রিক রাজা আগাথোক্লিসের মুদ্রায় রয়েছে বৃষ্ণিবীর বাসুদেব ও সঙ্কর্ষণ-এর (বলরাম) প্রতিকৃতি। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকেই শুঙ্গরাজা কাশীপুত্র ভাগভদ্রের সভায় আসা ইন্দো-গ্রিক রাজা আন্টিয়ালকিডাসের দূত হেলিয়োডোরাস ভাগবতধর্ম গ্রহণ করে বিদিশায় একটি মন্দির নির্মাণ করেন। এই মন্দির না টিকলেও টিকে যাওয়া একটি স্তম্ভে খোদিত লেখ সাক্ষ্য দেয়, তাঁর উপাস্য দেবতার নাম ‘দেবদেব বাসুদেব’। প্রায় সমসাময়িক রাজস্থানের স্থানীয় রাজা গাজায়ন পারাশরীপুত্রের ঘোষুণ্ডি ও হাতিবাড়া লেখ এবং খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের মহারাষ্ট্রের নানাঘাট থেকে প্রাপ্ত একটি সাতবাহন লেখতেও রয়েছে বাসুদেব ও সঙ্কর্ষণের উপাসনার উল্লেখ। শক মহাক্ষত্রপ ষোড়শের কোঠী লেখতে মথুরার কাছে বাসুদেব-মন্দিরের উল্লেখ আছে। ‘ঘট জাতক’ ও ‘মহাউম্মগ জাতক’-এর মতো বৌদ্ধ কৃষ্ণকাহিনিগুলির মুখ্যচরিত্রের নামও বাসুদেব, যদিও তাঁর পরিচয় হিসাবে কান্হ (কৃষ্ণ) শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে। মহাভারতের ভগবদ্গীতাতে যখন কৃষ্ণের সর্বোচ্চ দেবত্বের ঘোষণা করা হচ্ছে, তখনও কিন্তু কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার নন। বরং গীতায় সর্বোচ্চ দেবতার নাম বাসুদেব— বাসুদেবঃ সর্বম্ ইতি (৬.২৯.১৯)। মহাভারতের বিভিন্ন বৈষ্ণবায়িত অংশে বাসুদেব শব্দের একাধিক ব্যাখ্যা রয়েছে, যার সঙ্গে বসুদেবের নামের সম্পর্ক নেই। ‘শান্তিপর্ব’-এ (১২.৩৪১.৪১) কৃষ্ণ স্বয়ং বলছেন— ‘ছাদয়ামি জগৎ বিশ্বং ভূত্বা সূর্য ইবাংশুভিঃ। সর্বভূতাধিবাসশ্চ বাসুদেবস্ততো হ্যহম্॥’— আমি গোটা বিশ্বকে সূর্য বা চন্দ্রের মতো আচ্ছাদিত রাখি। যে হেতু আমি সমস্ত জীবের আবাস স্থল, তাই আমিই বাসুদেব। এই ঘোষণা কৃষ্ণের বৈষ্ণবায়ণের সঙ্গে জড়িত। মহাভারতের অন্যত্র (৫.৬৯.৩) এই ব্যাখ্যার আরও বিস্তৃত রূপ পাওয়া যায়— ‘বসনাৎ সর্বভূতানাং বসুত্বাৎ দেবযোনিতঃ। বাসুদেবস্ততো বেদ্য বৃষত্বাৎ বিষ্ণুরুচ্যতে॥’— সমস্ত জীবকে আবৃত করে রাখা, ঐশ্বর্য ও দেবগণের আশ্রয়স্থল হওয়ার জন্যই তিনি বাসুদেব নামে পরিচিত, বিশালত্বের জন্যই তাঁর নাম বিষ্ণু। স্পষ্টতই বাসুদেব পরিচয় এখানে বিষ্ণুর সঙ্গে দেবত্বজ্ঞাপক পরিচয়।

বাসুদেবত্বের জৈন কিংবদন্তি আবর্তিত হয় ৬৩ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বা ‘শলাকপুরুষ’দের ঘিরে। এঁদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থান অবশ্যই ২৪ জন তীর্থঙ্করের, যাঁরা জৈনধর্মের মূল প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত।এঁরাই জৈনধর্মের সর্বোচ্চ আদর্শ। কিন্তু বাস্তব জগতের কার্যকলাপকে জৈনরাও অস্বীকার করতে পারেন না। তাই সংসারজীবনের সফলতম ব্যক্তিত্বদের মধ্যে পরিগণিত হয়েছেন ১২ জন চক্রবর্তী, বা অপ্রতিদ্বন্দ্বী সার্বভৌম সম্রাট, যাঁদের স্থান তীর্থঙ্করদের পরেই। বাকি ২৭ জনের পরিচয় নয় জন বাসুদেব, নয় জন বলদেব ও নয় জন প্রতিবাসুদেব।

বাসুদেব প্রবৃত্তিমার্গের সফলতম ব্যক্তি— বিপুল শক্তিশালী, ঐশ্বর্যবান, সাতটি অমূল্য সম্পদের অধিকারী এবং সুন্দরীতমা নারীর স্বামী, যাঁর কোনও কিছুর অভাব নেই। প্রতিবাসুদেব প্রায় তাঁর সমান ক্ষমতাসম্পন্ন এবং প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রতিবাসুদেবকে বধ করে এই দ্বন্দ্বে জয়ী হন বাসুদেব। বস্তুজগতে চরম সাফল্য সত্ত্বেও এই হত্যার পাপে মৃত্যুর পর তাঁর নরকবাস অবধারিত। তবুও বাসুদেব প্রতিবাসুদেবের থেকে ধার্মিক, কারণ তাঁর সহযোগী ও ধর্মপরায়ণ ভাই বা দাদা বলদেব থাকেন তাঁর সহায়। কৃষ্ণ, বলরাম ও জরাসন্ধ জৈন পরম্পরার নবম এবং শেষ বাসুদেব, বলদেব ও প্রতিবাসুদেব। যে কৃষ্ণ গীতায় নিবৃত্তিমার্গের বিপরীতে কর্মযোগের কথা দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, জৈন পরম্পরাও তাঁকে মনে রেখেছে প্রবৃত্তিমার্গের সফলতম পুরুষ, বাসুদেব হিসেবে। অবশ্যই কৃষ্ণের বাসুদেবত্ব জৈন পরম্পরায় প্রদর্শিত হয়েছে আরও মহিমান্বিত নিবৃত্তিমার্গের বিপরীতে।

জৈন পরম্পরায় বাসুদেব কৃষ্ণের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিবাসুদেব কংস বা দুর্যোধন নন— জরাসন্ধ। মহাভারতেও জরাসন্ধ-আখ্যানই কিন্তু আভাস দেয় কৃষ্ণের বাসুদেবত্ব লাভের। আবার এই আখ্যানই জুড়ে দেয় বৃন্দাবন, মথুরা ও দ্বারকার কৃষ্ণকে। বৃন্দাবনের কৃষ্ণের বাল্য-কৈশোরলীলার পরিচিত কাহিনি শেষ হয় মথুরায় কংসবধে। কংসবধের প্রতিশোধ নিতে জরাসন্ধের মুহুর্মুহু আক্রমণ থেকে বাঁচতেই কৃষ্ণের নেতৃত্বে মথুরা ছেড়ে দ্বারকায় বসতি গড়েন যাদব-বৃষ্ণিরা। আর এই জরাসন্ধকে বধ করতে কৃষ্ণ সক্ষম হন মহাভারতে, পাণ্ডবদের সহায়তায়।

মহাভারতে কৃষ্ণের বাল্য-কৈশোরের সামান্য আলোচনা এসেছে জরাসন্ধের প্রসঙ্গেই। রাজসূয় যজ্ঞ করার বিষয়ে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের পরামর্শ চাইলে কৃষ্ণ তার প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে মগধরাজ জরাসন্ধের কথা বলেন। জরাসন্ধ বিপুল শক্তিশালী, তাঁর সহযোগী বহু— চেদীরাজ শিশুপাল, করুষাধিপতি বক্র, হংস ও ডিভক নামের দুই বীর সেনাপতি, পুণ্ড্রাধিপতি বাসুদেব, প্রাগ্জ্যোতিষরাজ ভগদত্ত, বিদর্ভরাজ ভীষ্মক। জরাসন্ধের দুই কন্যা, অস্তি ও প্রাপ্তির বিবাহ হয়েছিল কৃষ্ণের মামা কংসের সঙ্গে, যে কংস মথুরার যাদব-বৃষ্ণি গণসঙ্ঘকে রাজতন্ত্রে বদলে ফেলতে চান। যাদব-বৃষ্ণি সঙ্ঘমুখ্যদের সাহায্য করে কংসবধ করেন কৃষ্ণ। এরই প্রতিশোধ নিতে জরাসন্ধ মথুরা আক্রমণ করেন। যাদবদের চতুরতায় বিভ্রান্ত হয়ে হংস ও ডিভক আত্মহত্যা করলে জরাসন্ধ সাময়িক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। কিন্তু জরাসন্ধের বারংবার আক্রমণ থেকে রেহাই পেতে মথুরা ত্যাগ করে দ্বারকায় পাড়ি দেন যাদব-বৃষ্ণিরা। জরাসন্ধ অবশ্য তাতে ক্ষান্ত হননি। তিনি তাঁর কাছে পরাজিত রাজাদের বন্দি করে রাখতেন একশো জন রাজাকে শিবের কাছে বলি দেওয়ার উদ্দেশ্যে। জরাসন্ধ-বধের সময় বন্দি রাজার সংখ্যা ৮৬-তে পৌঁছেছিল। ব্রাহ্মণ স্নাতকদের ছদ্মবেশে কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে মগধে প্রবেশ করেন। জরাসন্ধ তাঁদের সাদর আপ্যায়ন করেন। রাত্রিবেলা কৃষ্ণ নিজেদের পরিচয় দিয়ে জরাসন্ধকে ওঁদের মধ্য থেকে যে কোনও এক জনের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানান। তীব্র আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জরাসন্ধ সব চাইতে শক্তিশালী ভীমকেই বেছে নেন। দীর্ঘ মল্লযুদ্ধের শেষে ভীমের হাতে মৃত্যু হয় জরাসন্ধের। জরাসন্ধের বিশাল সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে তাঁকে বধ করতে সফল হন কৃষ্ণ।

বন্দি রাজাদের শিবের কাছে বলি দেওয়ার উল্লেখ থেকে অনেক পণ্ডিত এই কাহিনিকে পৌরাণিক বৈষ্ণবধর্মের উত্থানের পর সংযোজিত একটি শৈব-বৈষ্ণব সংঘাতের কাহিনি হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু জরাসন্ধের নরবলি দেওয়ার ইচ্ছে, তাঁর ধর্মাচরণের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের সংযোগস্থাপনের সবচেয়ে বড় বাধা। শিবের কাছে বলিদানের উল্লেখ থাকলেও, খেয়াল রাখা উচিত যে মূলস্রোতের শৈবধর্মেও নরবলি প্রচলিত ছিল না। তা ছাড়া শৈব-বৈষ্ণব সংঘাতের বিবরণ দিতে কোনও বৈষ্ণব কবি কেন এমন কাহিনি রচনা করবেন, যেখানে এক শৈব রাজার আক্রমণে কৃষ্ণকে মথুরা ছেড়ে চলে যেতে হবে এবং অবশেষে অন্যের সাহায্যে তাঁকে বধ করতে হবে? বরং জরাসন্ধ-কাহিনির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য এই আখ্যানের প্রাচীনত্ব নির্দেশ করে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে মগধ তথা গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পাটলিপুত্র। কিন্তু জরাসন্ধের কাহিনিতে পাটলিপুত্রের উল্লেখ নেই। এমনকি জরাসন্ধের রাজধানী ঠিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতকে, বুদ্ধ ও মহাবীরের সমকালীন মগধরাজ বিম্বিসার-অজাতশত্রুর রাজধানী রাজগৃহও নয়— রাজগৃহের উপকণ্ঠের এক প্রাচীনতর গিরিদুর্গ গিরিব্রজ। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতক থেকে মগধ ক্রমশ উত্তর ভারতের সবচেয়ে বড় শক্তিতে পরিণত হয়, যার চরম পরিণতি ছিল প্রথমে নন্দ এবং পরে প্রায় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশব্যাপী মৌর্য সাম্রাজ্য। কিন্তু জরাসন্ধ-আখ্যানের পটভূমি যদি তার থেকে প্রাচীন হয়, তবে কেমন ছিল পরবর্তী বৈদিক যুগের মগধ?

পরবর্তী বৈদিক যুগের প্রথম দিকে, যখন ঋগ্বেদের যুগের যাযাবর গোষ্ঠীগুলি কৃষিনির্ভর বসতি গড়ে তুলতে শুরু করে, তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কুরু ও পাঞ্চাল বা বর্তমান হরিয়ানা, দিল্লি, ও উত্তরপ্রদেশের অংশবিশেষ। মগধ (দক্ষিণ বিহার) ছিল বৈদিক সভ্যতার বাইরে, যদিও বৈদিক সমাজের কাছে অপরিচিত নয়। অথর্ববেদের এক মন্ত্র নিজের রাজ্য থেকে জ্বর তাড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি, সেই জ্বর পাঠাতে চেয়েছে মগধের মানুষদের মধ্যে। কেন মগধের প্রতি এই বিরাগ? কিরাত-কীকট প্রভৃতি জনজাতি অধ্যুষিত মিশ্র-সংস্কৃতির মগধ তখনও বৈদিক সংস্কৃতি ও কৃষিসভ্যতাকে আয়ত্ত না করলেও তার সামরিক শক্তি নিতান্ত কম ছিল না। বৈদিক সাহিত্যে যে চারণকবিদের উল্লেখ পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সূতগোষ্ঠী, যারা ক্ষত্রিয় রাজাদের চারণকবি, সারথি, দূত ও পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করত। কিন্তু মগধ বৈদিক সমাজের অংশ না হলেও, সূতদের পাশাপাশি উপস্থিত আর একটি গুরুত্বপূর্ণ চারণকবিদের গোষ্ঠীর নাম ‘মাগধ’। মগধের শক্তি এতটাই ছিল যে, তাদের কীর্তিকাহিনি মনে রাখার জন্যও সম্ভবত ছিল চারণকবিদের গোষ্ঠী। তাদের রচনা কি মিশে গিয়েছে সূতদের রচনার সঙ্গে? তাই কি কৃষ্ণের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েও জরাসন্ধ চিত্রিত এক অতিথিপরায়ণ, বীর, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন রাজা হিসেবে? মিশ্র সংস্কৃতির মগধের রাজা কি এক দিকে ব্রাহ্মণদের আতিথ্য দেখানো ও অন্য দিকে স্থানীয় জনজাতির রীতি অনুযায়ী নরবলিদানের মাধ্যমে বৈধতা পেতে চেয়েছিলেন উভয় জগতেই?

কৃষিভিত্তিহীন জনজাতির পক্ষে সাম্রাজ্যবিস্তার প্রায় অসম্ভব। পূর্ব ও মধ্যভারতের এই জনজাতিগুলি ছিল মূলত পশুচারণ ও লুণ্ঠননির্ভর। জরাসন্ধের রাজধানী গিরিব্রজ-র নামের শেষে ব্রজ শব্দটি প্রবল ভাবে পশুচারণের অর্থনীতির ইঙ্গিতবাহী। জরাসন্ধ নিজেও চিত্রিত এক লুণ্ঠনজীবী হিসেবে। তিনি রাজ্য অধিগ্রহণ করেন না। রাজাদের বন্দি করে আনেন। তাই জরাসন্ধ তাঁর আধিপত্য বিস্তারের জন্য বেছে নিয়েছিলেন অন্য পথ। বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে তিনি প্রভাববিস্তার করতে চেয়েছিলেন উত্তর ভারতের সমতলভূমির রাজনীতিতে— যাদব-বৃষ্ণি গণসঙ্ঘশাসিত শূরসেন রাজ্যের মধ্যে দিয়ে। কংসবধ ছিল সেই চেষ্টায় এক বিরাট আঘাত।

তাঁর পরবর্তী বিশ্বস্ত অনুচর, চেদীরাজ শিশুপালও ছিলেন কৃষ্ণের আত্মীয়। হরিবংশ ও পুরাণগুলিতে জরাসন্ধ-শিবিরের আর এক সহযোগীর মাধ্যমে কৃষ্ণকে হত্যার চেষ্টার কথাও জানা যায়, যাঁর নাম কালযবন। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন, পুরাণ অনুসারে কালযবন যাদব-বৃষ্ণিদের পুরোহিত গার্গ্য শিশিরায়ণ ও এক গোপকন্যার সন্তান। অতএব যবন পরিচয়টি এই চরিত্রের উপর জোর করে আরোপিত। বরং কংস-শিশুপালের মতোই কালযবনেরও কৃষ্ণের আত্মীয় হওয়ারই সম্ভাবনা। অন্য দিকে, জরাসন্ধ তাঁর নিজস্ব সংগঠনকে শক্তিশালী করতে শিশুপালের বিয়ের আয়োজন করেন বিদর্ভরাজ ভীষ্মকের কন্যা রুক্মিণীর সঙ্গে, যে পরিকল্পনা ভেস্তে যায় কৃষ্ণ রুক্মিণীকে হরণ করে বিবাহ করায়।

কৃষ্ণ-জরাসন্ধের এই রাজনৈতিক সংঘাতের প্রেক্ষাপটেই আমাদের বুঝতে হবে, মহাভারতে কৃষ্ণের ভূমিকা ও রাজনৈতিক উত্থান। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর-সভায় মহাভারতে কৃষ্ণের প্রবেশ। সেই সময় জতুগৃহ থেকে সদ্য বেঁচে ফেরা পাণ্ডবরা যেমন বিপন্ন ও রাজ্যহারা, জরাসন্ধের সঙ্গে লড়াইয়ে কৃষ্ণও তেমন কিছুটা কোণঠাসা। কিন্তু শক্তিশালী পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের সঙ্গে পাণ্ডবদের বৈবাহিক সম্পর্ক এবং কৃষ্ণের সঙ্গে পাণ্ডবদের সখ্য অচিরেই এক শক্তিশালী রাজনৈতিক জোটের জন্ম দিল। বোন সুভদ্রার সঙ্গে অর্জুনের বিবাহ নিশ্চিত করে এই জোটকে আরও শক্ত ভিত্তিতে স্থাপন করলেন কৃষ্ণ। কুরুরাজ্য ভাগ করে পাণ্ডবরা যে খাণ্ডবপ্রস্থ লাভ করলেন, খাণ্ডববন ধ্বংস করে কৃষ্ণ ও অর্জুন সেখানে গড়ে তুললেন সমৃদ্ধ ইন্দ্রপ্রস্থ। হারানো মথুরার অদূরে রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন ঘটল কৃষ্ণের। পাণ্ডবদের সাহায্যে জরাসন্ধ-বধ ঘটল যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আগেই। আর যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞেই অভ্যাগতদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে কৃষ্ণের নাম ঘোষণা করলেন ভীষ্ম। এ কি জরাসন্ধ-বধের পর কৃষ্ণের বাসুদেবত্বের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা? তাই কি এই ঘোষণায় প্রবলতম আপত্তি ছিল শিশুপালের?

শিশুপালের বক্তব্য অযৌক্তিক ছিল না। শিশুপাল প্রশ্ন তুলেছেন, রাজা না হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা কি সমবেত রাজাদের অপমান করা নয়? অন্য দিকে ভীষ্মের প্রতিযুক্তিও অনেকটাই মনে করিয়ে দেয় জৈন পরম্পরার বাসুদেবের সংজ্ঞা— কৃষ্ণ জ্ঞানে ব্রাহ্মণদের থেকেও শ্রেষ্ঠ, শক্তিতে সমস্ত ক্ষত্রিয়ের থেকেও; তিনি সর্বগুণসম্পন্ন। শিশুপালের আপত্তি কৃষ্ণের বাল্য-কৈশোরের কিংবদন্তিগুলি নিয়ে বক্রোক্তি থেকে শুরু করে ছুঁয়ে গেছে কংসবধ-জরাসন্ধবধের সমালোচনা, রুক্মিণীহরণ নিয়ে কৃষ্ণ ও শিশুপালের পরস্পরকে আক্রমণ। অবশেষে কৃষ্ণের হাতে শিশুপালের মৃত্যু হয়তো কৃষ্ণের বাসুদেবত্বে সাময়িক সিলমোহর দিয়েছে।

কৃষ্ণের পরবর্তী কার্যকলাপের মধ্যেও রয়েছে জরাসন্ধপন্থী পূর্ব ও মধ্যভারতের লুণ্ঠনজীবী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে লড়াই। কখনও তিনি হারিয়েছেন বেদে বার বার উল্লিখিত দুর্ধর্ষ যাযাবর জাতি শাল্বদের, কখনও সম্পদ ও নারী লুণ্ঠনকারী অসমের নরকাসুরকে হত্যা করে লুণ্ঠিত সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন, বিবাহ করেছেন অপহৃত নারীদের। জরাসন্ধ-শিবিরও নিষ্ক্রিয় থাকেনি। কৃষ্ণের বিপরীতে তাঁরাও অন্য এক বাসুদেবের সৃষ্টি করেছেন। তিনি পুণ্ড্র (উত্তরবঙ্গ) অধিপতি। বঙ্গ, পুণ্ড্র ও কিরাতরা তাঁর অনুগামী। বিষ্ণুপুরাণ অনুসারে তিনি নিজের বাসুদেবত্বের দাবি জানিয়ে কৃষ্ণকে বাসুদেবত্ব ত্যাগের নির্দেশ দিলে কৃষ্ণের হাতে তাঁর মৃত্যু ঘটে। সুরক্ষিত হয় কৃষ্ণের বাসুদেবত্ব।

বাসুদেবত্ব কি তবে শুধুই সামরিক ও কূটনৈতিক কৃতিত্ব? জরাসন্ধ যখন ৮৬ জন বন্দি রাজার প্রাণনাশের মাধ্যমে তাঁর কর্তৃত্বপ্রতিষ্ঠা করতে চান, কৃষ্ণ চান তাঁদের মুক্তি দিতে। শিশুপাল যখন বারংবার কৃষ্ণের ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করেন, কৃষ্ণ তাঁর একশো অপরাধ ক্ষমা করতে প্রস্তুত। বাসুদেব তিনিই, যাঁর চাওয়ার কিছু থাকে না, অথচ তিনি অটল থাকেন প্রবৃত্তিমার্গে— ফলের আশা ছাড়া কর্মের যে মন্ত্র গীতায় অর্জুনকে তিনি শুনিয়েছেন, তার উদ্‌যাপনেই হয়তো প্রতিষ্ঠিত হয় কৃষ্ণের বাসুদেবত্ব, তিনি হয়ে ওঠেন সকল জীবের আশ্রয়।

(উল্লিখিত বন্ধনীভুক্ত সংখ্যাগুলি মহাভারতের ‘ক্রিটিক্যাল এডিশন’ অনুসারে শ্লোকসংখ্যা)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Vasudeva Lord Krishna

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy