Advertisement
E-Paper

ব্রিটিশ উর্দি, স্বদেশি পুলিশ

চাকরির সুবাদে কাছ থেকে দেখেছেন ব্রিটিশ পুলিশ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, ’৪৬-এর দাঙ্গা। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে লেখেন ক্রাইম উপন্যাস। পঞ্চানন ঘোষাল ছিলেন বাংলায় পুলিশ-ইতিহাস আর অপরাধবিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ।চাকরির সুবাদে কাছ থেকে দেখেছেন ব্রিটিশ পুলিশ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, ’৪৬-এর দাঙ্গা। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে লেখেন ক্রাইম উপন্যাস। পঞ্চানন ঘোষাল ছিলেন বাংলায় পুলিশ-ইতিহাস আর অপরাধবিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০

আইন অমান্য আন্দোলন চলছে। মহিলাদের দল পিকেটিং করছেন, তাঁদের জেলে ভরা হবে। কেউ কেউ সন্তানকে কোলে নিয়েই এসেছেন। এ দিকে জেলখানা থেকে বলা হয়েছে শিশুদের যেন পাঠানো না হয়। সাহেব অফিসার এক মহিলাকে বললেন, ‘‘খোকার বাবার নাম বলুন, তাঁর কাছে খোকাকে রেখে আসব।’’ ভদ্রমহিলা নারাজ। তিনি ছেলেকে নিয়েই জেলে যাবেন। অফিসারটি ভয় দেখানোর জন্য চেঁচিয়ে বললেন, ‘‘কে আছ! বাচ্চাটাকে ট্রামের তলায় ফেলে দাও।’’ ভদ্রমহিলা শিউরে উঠেই সামলে নিলেন। তার পর শান্ত গলায় বললেন, ‘‘তাই হোক। গোলামের সংখ্যা না-ই বা বাড়ল।’’ সাহেব চুপ।

কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামী নয়, এ এক পুলিশ অফিসারের স্মৃতিকথা। ‘পুলিশ কাহিনী’র দ্বিতীয় খণ্ডে ঘটনাটি লিখে রেখেছেন পঞ্চানন ঘোষাল। পেশায় তিনি পুলিশ, কিন্তু মনটি স্বদেশিয়ানায় পূর্ণ। এটুকু বললে অবশ্য তাঁর পরিচয়ের অনেকটাই বাকি থেকে যায়। বাংলার পুলিশ-লেখকদের ধারায় পঞ্চানন শুধু বিশিষ্ট নন, বহুমুখীও। এক দিকে এ দেশে পুলিশি ব্যবস্থার ইতিহাস লিখেছেন (পুলিশ কাহিনী প্রথম খণ্ড), স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে নিজের পুলিশজীবনের স্মৃতিকথা লিখেছেন (‘পুলিশ কাহিনী দ্বিতীয় খণ্ড’, ‘আমি যখন পুলিশ ছিলাম’, ‘আমার দেখা মেয়েরা’)। সেই সঙ্গে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে লিখেছেন একাধিক অপরাধকাহিনি (‘রক্তনদীর ধারা’, ‘পকেটমার’, ‘মুণ্ডহীন দেহ’, ‘খুন রাঙা রাত্রি’, ‘অন্ধকারের দেশে’)। লিখে রেখেছেন তাঁর নিজের তদন্ত করা বেশ কিছু চমকপ্রদ অপরাধ মামলার ইতিহাস (‘বিখ্যাত বিচার ও তদন্ত কাহিনী’, তিন খণ্ড)।

এতেও শেষ নয়। বাংলায় পঞ্চাননই অপরাধবিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ বলা যায়। নিজে মনোবিজ্ঞানের গবেষক, গিরীন্দ্রশেখর বসুর শিষ্য। আট খণ্ডে লিখেছেন বাংলায় অপরাধবিজ্ঞানের তত্ত্বকথা। চর্চা করেছেন কিশোর অপরাধী আর শ্রমিকবিজ্ঞান নিয়েও।

পঞ্চানন কিন্তু পুলিশ হতে চাননি। যদিও তাঁর পরিবারে পুলিশি চাকরির রেওয়াজ ছিল। পিতামহ রায়বাহাদুর কমলাপতি ঘোষাল প্রথম ভারতীয় পুলিশ সুপার ছিলেন, জেঠামশাই কালীসদয় ঘোষাল কলকাতা পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। পঞ্চাননের ইচ্ছে ছিল অধ্যাপনা আর সাহিত্যসেবা করেই জীবন কাটাবেন। গ্রহের ফের পুলিশে টেনে আনল।

তখন এমএসসি পাশ করে গিরীন্দ্রশেখরের কাছে গবেষণা শুরু করেছেন। জেঠতুতো ভাই হিরণ্ময় প্রেসিডেন্সির ছাত্র। ‘অগ্নিবীণা’ পড়ে দুজনেরই সাধ হল কবির সঙ্গে দেখা করার। কাউকে কিছু না বলে চললেন হুগলিতে কাজী নজরুল ইসলামের কাছে। জানা ছিল না, নজরুলের বাড়িতে পুলিশের ‘ওয়াচ’ আছে। ফিরতেই চেপে ধরলেন কালীসদয়। লালবাজারে খবর চলে গিয়েছে। পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট স্বয়ং কৈফিয়ত চেয়ে পাঠিয়েছেন। কালীসদয় বললেন, আর কখনও ওরা যাবে না। কিন্তু টেগার্ট অনড়, ‘‘দ্যাট ওন্ট সলভ দ্য প্রবলেম। পুট দেম ইনটু পুলিশ।’’ হিরণ্ময় শেষ পর্যন্ত টেগার্টেরই সাহায্যে ইউরোপ পাড়ি দিলেন। পরে তিনি ভাষাবিদ হয়ে পোল্যান্ডের ওয়ারশ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হন। দেশ স্বাধীন হলে মস্কোতে ভারতীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি। হিরণ্ময়ের লেখা ‘কুলটুরকাম্প’ বা ‘মহত্তর যুদ্ধের প্রথম অধ্যায়’-এর কথা অনেকেই মনে করতে পারবেন। পঞ্চানন কিন্তু দেশ ছাড়তে পারেননি। তাঁকে পুলিশেই ঢুকতে হল। সেটা ১৯৩০।

পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে তখন ব্রিটিশ অফিসাররা কথায় কথায় জাত তুলে গালি দেন। পঞ্চানন রেগেমেগে চাকরি ছেড়ে দিলেন। টেগার্ট ডেকে পাঠিয়ে সব শুনলেন। তার পর পেনসিলে লেখা একটা স্লিপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘কাল থেকে থানাতে জয়েন করবে।’’ এর পর থেকে ট্রেনিং স্কুলের পরিবেশ অনেকটা বদলাল।

টেগার্ট এমনিতে বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন দমন করে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছেন। পঞ্চাননের চোখে কিন্তু তাঁর অনেক গুণও ধরা পড়েছিল। যেমন টেগার্ট ঘুষখোরদের প্রশ্রয় দিতেন না। অপরাধীদের মধ্য থেকে চর সংগ্রহ করার রেওয়াজও তাঁর পছন্দ ছিল না। ঢাকুরিয়া লেক তৈরি হলে পুলিশের কিছু কর্মী প্রেমীযুগলদের ধরপাকড় শুরু করেছিল। টেগার্ট শুনেই হুকুম দিলেন, পুলিশের কাজ সমাজ সংস্কার করা নয়। পুলিশ বরং দেখবে, তরুণ-তরুণীরা যেন গুন্ডাদের হাতে নিগৃহীত না হয়।

বিপ্লবীদের ব্যাপারে অবশ্য টেগার্ট খুবই ধুরন্ধর ছিলেন। সেখানে তাঁর কৌশল ছিল দুই বিপ্লবী দল ‘অনুশীলন’ এবং ‘যুগান্তর’-এর মধ্যে রেষারেষি জিইয়ে রাখা। এক বার আটক হওয়া বিপ্লবীদের অভিযোগ স্বকর্ণে শুনতে চাইলেন টেগার্ট। বিপ্লবীদের এসকর্ট করার দায়িত্বে ছিলেন পঞ্চানন। এক তরুণ বিপ্লবী ভেদনীতির কথা তুললে টেগার্ট বললেন, ‘‘বাবু, এটা তোমাদেরই শাস্ত্র পড়ে আমরা শিখেছি। তোমাদের ব্রহ্মা তো এক বার দেবতাদের আর এক বার দানবদের পক্ষে কথা বলে উভয়কে লোভ দেখাতেন।’’

বড়বাজার থানা এলাকা। এক দিকে পিকেটিংয়ের ঢল সামলাতে পুলিশ নাজেহাল। অন্য দিকে পকেটমারেরা বলছে, ‘‘হুজুর হামকো পকেটমারিমে মত ভেজিয়ে, পিকেটিংমে দে দিজিয়ে। ইসমে ভি ছ মাহিনা, উসমে ভি ছ মাহিনা। লেকিন উসমে খানা আচ্ছা মিলতা।’’ তারই মধ্যে অ্যাংলো সার্জেন্টরা দশ-বারো বছরের ছেলেদের পেটাচ্ছে দেখে প্রতিবাদ করলেন পঞ্চানন। টেগার্টের ঘরে ফের তলব হল। ‘‘বাইরে থেকে শুনলাম, উনি মৃদু স্বরে বলছেন, টেম্পারামেন্ট বুঝে ঠিক লোককে ঠিক জায়গায় পোস্ট করতে পার না কেন? ট্রান্সফার হিম টু জোড়াসাঁকো থানা।’’ পরে টেগার্ট নিজে কালীসদয়কে বলেছিলেন, ‘‘গভর্নমেন্ট পলিসি আমার নিজেরও পছন্দ নয়। এরা যাদের ঠেঙাচ্ছে তারা তো ব্রিটিশবিরোধী হবেই। যারা দূর থেকে ওই ঠেঙানি দেখছে আর শুনছে, তারাও বিরোধী হয়ে যাচ্ছে।’’ এ সব কাহিনি কোনও পুলিশ অফিসার ছাড়া কে-ই বা নথিবদ্ধ করতে পারতেন?

পঞ্চাননের লেখা পড়লে বোঝা যায়, সামগ্রিক ভাবে পুলিশি ব্যবস্থার উপরেই আইন অমান্য আন্দোলনের বড় প্রভাব ছিল। দেশীয় অফিসারদের একাংশ নরম হয়ে পড়ছিলেন। পঞ্চাননের ভাষায়, ‘‘পুলিশ মহলে সিমপ্যাথেটিক শব্দটা তখন শোধনবাদীর মতোই ভয়ঙ্কর। তাড়া করে ধরতে বললে সিপাহীরা লাঠি ঠুকে কিছু দূর এগোয়, তার পর বলে নহী মিলি। ক্যা করু।’’ পঞ্চানন নিজে একটা শুকনো বেতের মাঝখানটা চিরে রেখেছিলেন। কর্তাদের হুকুমে যদি মারতেও হয়, বেশি লাগবে না, অথচ ফটাফট শব্দ হবে। ব্রিটিশরা তখন মরিয়া হয়ে মারকুটে অফিসারদের উৎসাহ দিতে থাকে। গাঁধী-আরউইন চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পরে কংগ্রেস নিষিদ্ধ হল কিছু দিন। তখন সাব-ইনস্পেক্টর ও তার উচ্চপদস্থ অফিসাররা কাউকে আদালতে না তুলে নিজেরাই সই করে জেলে পাঠানোর ক্ষমতা পেলেন। পঞ্চাননের মতে, ‘‘এত ক্ষমতা পুলিশকে আগে কখনও দেওয়া হয়নি।’’

জোড়াসাঁকো থানায় এসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ হওয়ার সুযোগ এল। হেমেন্দ্রকুমার রায় আর কালিদাস নাগের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তাঁদের সঙ্গেই এক দিন ঠাকুরবাড়ি গেলেন পঞ্চানন। কবির সামনে পুলিশের পরিচয় দিতে একটু সঙ্কোচ হচ্ছিল। নলিনী পণ্ডিত কবির কাছে পঞ্চাননের অন্য পরিচয়টাও দিয়ে বললেন, ‘‘এর ‘কল্লোল’-এ গল্প বার হয়েছে, দু’টি সামাজিক উপন্যাসও লিখেছে।’’ রবীন্দ্রনাথ তখন বললেন, ‘‘সামাজিক উপন্যাসের জন্যে তো আমি, শরৎ, অন্যেরা রয়েছি। তুমি কম্পিটিশনে পারবে? তুমি পুলিশে ঢুকেছ। ভারতীয় ক্রিমিনোলজি বিষয়ে গবেষণা কর। এর বাংলা হবে অপরাধ বিজ্ঞান। আর যদি উপন্যাসই লিখতে হয়, অপরাধীদের জীবনরীতি-ভিত্তিক ক্রাইম উপন্যাস লেখ।’’ পঞ্চানন সে কথা অক্ষরে অক্ষরে মান্য করেছিলেন। কিছু দিন পরে কলকাতা পুলিশ জার্নাল বার হবে। পঞ্চাননই সম্পাদক। রবীন্দ্রনাথকে লেখার জন্য অনুরোধ করলেন। কবি পুলিশের প্রতি কিছু উপদেশ লিখে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এমনই উপদেশ, ছাপার অনুমতি মিলল না।

রবীন্দ্রনাথের শেষযাত্রায় পঞ্চানন ডিউটিতে ছিলেন। কবির দাড়ি ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছিল বলে যা শোনা যায়, পঞ্চাননের মতে তা রটনামাত্র। এক যুবক ও রকম বলে বেড়াচ্ছিল। পরের অংশটুকু পঞ্চাননকেই উদ্ধৃত করা যাক: ‘‘ওই ছোকরার বাড়ি তল্লাশি করে ওগুলো আমরা সংগ্রহ করি। আসল না নকল বুঝা গেল না। ইংরাজ ডেপুটি সাহেবের নির্দেশে তা গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হল। নইলে ওগুলি আরও জাল হত এবং ভবিষ্যতে কবির যা দাড়ি পাওয়া যেত তার ওজন হত কয়েক টন।’’

পুলিশি চাকরির সুবাদে সে আমলে শিল্পী-সাহিত্যিকদের ঘিরে কত রকম ঘটনার সাক্ষী পঞ্চানন! নজরুলের বাড়ি তল্লাশি হবে। পঞ্চানন তখন শ্যামপুকুরে। একটি পুরনো তালাবন্ধ বাক্সের দিকে চোখ গেল এক গোয়েন্দা অফিসারের। ডালা খুলতে যেতেই কাজীসাহেব ছুটে এসে বললেন, ‘‘না না না...।’’ অফিসারের রোখ আরও বাড়ল। বাক্স ভেঙে উপুড় করে ফেললেন। নজরুলের চোখ দিয়ে জল পড়ছে। সবাই দেখলেন, মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে ক’টা খেলনা, ছোট জামা। পুত্র বুলবুলের মৃত্যুর পর এই প্রথম খোলা হল বাক্সটা।

শ্যামপুকুরে থাকার সময়েই খবর এল, বড় মাপের এক বিপ্লবী বাসা বেঁধেছেন বাগবাজারে। ভোররাতে ঘেরাও করা হল বাড়ি। নীচের ঘরে আলো জ্বলছে। হুড়মু়ড় করে ঢুকে দেখা গেল, দেওয়াল আর মেঝে জুড়ে অপূর্ব নকশা আর আল্পনা। ডেপুটি কমিশনার বলে উঠলেন, ‘‘এ তো টেম্পল! ওপেন ইয়োর শুজ়।’’ ‘মন্দিরের পুরোহিত’ যামিনী রায় তখন নিবিষ্ট চিত্তে চাদর গায়ে ছবি আঁকছেন!

আর এক বার শিব্রাম চক্রবর্তীর উপরে নজর রাখার হুকুম হল। সেই ঘটনার বিবরণ পঞ্চাননের ভাষাতেই থাক— ‘‘তাঁকে ফলো করে এক হোটেলে গেলাম, একসঙ্গে খেলাম। পরে তিনিই একদিন আমাকে ফলো করে থানায় এলেন এবং কিছু টাকা কর্জ চাইলেন। না পেয়ে আফশোস করে বললেন, তা হলে কাবুলিওয়ালার কাছে যেতে হয়। তার পর একদিন কাবুলিওয়ালা তাড়িত হয়ে থানায় আশ্রয় নিলেন। আমরা ওই কাবুলিওয়ালাকে চেপে ধরে হাজতে পুরলাম। কাবুলিদের চড়া সুদ ও তজ্জনিত অত্যাচারের ফিরিস্তি সহ প্রতিবেদন পাঠালাম। কিন্তু শিব্রামবাবু সাক্ষী দিতে চাইলেন না। তাঁর মতে ওরা জনগণের উপকারী বন্ধু। সেদিন পুলিশ বিরূপ করলেও ওরা টাকা দিয়েছে।’’

আরও একটা কথা লিখেছেন পঞ্চানন, ইতিহাস-অনুরাগীদের কাছে সেটাও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তখন অন্তরীণ। পঞ্চানন আর নীহার বর্ধন নামে আর এক জন অফিসারের দায়িত্ব ছিল, এলগিন রোডের বাড়ির উপরে নজর রাখার। ওঁরা প্রতিদিনই ‘হাজির’ লিখে দিতেন। নেতাজির প্রতি ভক্তিবশতই এটা করা হত। মহানিষ্ক্রমণের পরে সবাই ভয়ে জড়সড়। না জানি কী খাঁড়া নামে! কিন্তু আশ্চর্য, সে ভাবে কোনও ট্রেন, বিমান বা জাহাজে তল্লাশি হয়নি। কাউকে গ্রেফতার করে জেরা করা হয়নি। স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনার এসে বলেছিলেন, ‘‘আমি জানি উনি সাধু হয়ে চলে গিয়েছেন!’’

পঞ্চাননের স্মৃতিকথা এই রকমই ব্রিটিশ উর্দি থেকে উঁকি দেওয়া স্বদেশি মনের কাহিনি। আবার তিনি যখন অপরাধকাহিনি লিখছেন, সেখানে তাঁর মনোবিজ্ঞান চর্চার ছাপ পাতায় পাতায়। এই মেলবন্ধনেই তিনি বিশিষ্ট। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় থেকে হালে সুপ্রতিম সরকার— মধ্যমণি পঞ্চানন। তাঁর ভিলেনরা মূলত মনের জটিল সমস্যার শিকার। পঞ্চাননের দৃষ্টি তাদের প্রতি সমানুভূতিতে পূর্ণ।

পাগলা-হত্যাকাণ্ডের কুখ্যাত নায়ক অবিনাশ নন্দী ওরফে খোকা গুন্ডার কথাই ধরা যাক। নিষিদ্ধপল্লি থেকে উঠতি অভিনেত্রী ‘ছোট মলিনা’কে (মলিনা দেবী নন) ঘিরে এক ত্রিকোণ প্রেমে খোকার হাতে খুন হয় পাগলা। ‘রক্তনদীর ধারা’ ওই ঘটনারই উপন্যাসরূপ। খোকা প্রথমে সঙ্গীসাথী জুটিয়ে স্বদেশি বিপ্লবী দলই তৈরি করতে চেয়েছিল। সেটাই ক্রমে সাধারণ ডাকাতদলের চেহারা নেয়। তার ছিল দ্বৈত সত্তার সমস্যা। কয়েক মাস সে দিব্যি ভালমানুষের জীবন যাপন করত, গণ্যমান্য লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করত। বাকি মাসগুলো ফিরে যেত অপরাধীর জীবনে, তখন তার চেয়ে নৃশংস আর কেউ নেই। এক বার সে আত্মগোপনের জন্য শান্তিনিকেতনের অতিথিশালাতেও আস্তানা গেড়েছিল। প্রশাসনের নির্দেশ ছিল, খোকাকে গ্রেফতার করতে গিয়ে যেন আশ্রমের শান্তিভঙ্গ করা না হয়। পঞ্চানন সে বার তাকে ধরতে পারেননি। পরে দেওঘরে সে ধরা পড়ে। ফাঁসি হয় খোকার।

বৌবাজার শিশুহত্যা মামলার আসামি নানা রকম বয়ান দিচ্ছিল। কখনও বলছিল, ‘শিশুটিকে খুন করেছি।’ কখনও বলছিল, ‘লুকিয়ে রেখেছি।’ তার আচরণও ছিল অদ্ভুত। পঞ্চানন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তাকে গিরীন্দ্রশেখরের কাছে নিয়ে গেলেন। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে গিরীন্দ্রশেখর জানালেন— ‘‘আসামি নিজেকে স্ত্রীরূপে কল্পনা করে এবং মা হতে চায়... আপাতত সে ফরিয়াদীর স্ত্রীরূপে নিজেকে কল্পনা করছে। তাই সে নিজেকে অন্তঃসত্ত্বা রূপে কল্পনা করে ছেলেটিকে সরিয়ে দিয়েছে। দশ মাস দশ দিন পরে হয়তো সে ছেলেটিকে বার করবে..।’’ পঞ্চানন চেষ্টা করেছিলেন, লোকটিকে মানসিক হাসপাতালে পাঠাতে। কিন্তু আইন তাঁকে সে সুযোগ দেয়নি।

সে দিক থেকে বরং সাফল্য এসেছিল স্করপিওন গ্যাং-এর মামলায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই কলকাতায় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান একটি গ্যাং গাড়ি চুরি, পেট্রোল চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, অপহরণ-ধর্ষণে জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। এই দলে বহু যুদ্ধ-প্রত্যাগত যুবক ছিল, যারা বহু আগ্নেয়াস্ত্র হাতিয়ে নিয়ে ঘরে ফিরেছিল। অন্যতম প্রধান আসামি আলেক নিজের দোষ কবুল করলে পঞ্চানন তাকে রাজসাক্ষী হওয়ার সুযোগ দেন। চমকপ্রদ স্বীকারোক্তিতে আলেক বলেছিল, ‘‘বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে প্রায়ই ক্রাইম পিকচার দেখতাম। আমাদের মনে হয়েছিল, ইউরোপ-আমেরিকায় দুর্ধর্ষ অপরাধীদের গ্যাং আছে, অথচ আমাদের হতভাগ্য স্বদেশ— এখানে শুধু ছেঁচড়া চোর-ডাকাতই জন্মে। জন্মভূমির সুনাম রক্ষার্থে সিনেমায় নির্দেশিত পন্থা অনুযায়ী একটা ভারতীয় গ্যাং সৃষ্টি করতে মনস্থ করি।’’ আলেক ও তার সঙ্গীদের দেখে পঞ্চাননের মনে হয়েছিল, পৃথিবীতে যুদ্ধের পরিকল্পনার মধ্যে শুধু দৈহিক ও আর্থিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থাই করা হয়ে থাকে। কিন্তু নৈতিক, মানসিক ও সামাজিক পুনর্বাসনের স্থান থাকে না। সঙ্কটকালে সাহসী ভাবপ্রবণ যুবকদের মাথায় তুলে পরে দূরে ঠেলার ফল হয় এমনই ভয়াবহ।

এর কয়েক মাস পরে কলকাতা যে নারকীয়তার সাক্ষী হল, তাতে অবশ্য এই সব অপরাধই ফিকে হয়ে গেল। ১৯৪৬-এর হানাহানিতে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন পঞ্চানন নিজেও। এর আগে ১৯২৬ সালে সাম্প্রদায়িক অশান্তির পিছনে ব্রিটিশের কলকাঠি ছিল, এ কথা জেঠামশাই কালীসদয় নিজে জানতেন। সে সব কথা বলার জন্য
তাঁর প্রোমোশনও আটকে যায়। ’৪৬ নিয়ে পঞ্চাননের মতামতও তদনুরূপ। তাঁর মতে, ‘‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বাধানোর সুবিধার জন্য আমাদের মধ্যে বাছা বাছা কয়েক জনকে থানা থেকে সরিয়ে আনা হয়েছিল।’’ পঞ্চানন নিজে তখন ছিলেন স্পেশাল ব্রাঞ্চে। সেখান থেকেই রাস্তায় নেমেছিলেন, বহু মানুষকে বাঁচিয়েছিলেন।
এবং জোরের সঙ্গে দাবি করেছিলেন, কলকাতা পুলিশের দেশীয় অফিসারদের মধ্যে অন্তত ভেদভাব ছিল না। সাম্প্রদায়িক আমরা-ওরা তাঁদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করেনি।

১৯৬৩ সালে অবসর। ১৯৯০ সালে ৮৩ বছর বয়সে মারা যান পঞ্চানন। ১৯৯৩-এর মুম্বই বা ২০০২-এর গুজরাত তাঁকে দেখতে হয়নি।

Panchanan Ghoshal Writer Social Worker Criminologist পঞ্চানন ঘোষাল
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy