দূরদর্শনের জন্য সত্যজিৎ রায়ের ইন্টারভিউ নিচ্ছেন পঙ্কজ সাহা। ১৯৮৬ সালের ছবি।
স্কুলজীবনে সন্তোষপুরে ‘লেকপল্লীর ছোটরা’ সংগঠনের তরফ থেকে দক্ষিণ কলকাতা শহরতলি শিশু উৎসব করছি, সত্যজিৎ রায়ের শুভেচ্ছাবার্তার জন্যে তাঁর বাড়ি চলে গেলাম। হাফপ্যান্ট পরা অচেনা কিশোরকে তিনি অবহেলা করলেন না। অনবদ্য হাতের লেখায় শুভেচ্ছাবার্তা লেখার আগে খুঁটিয়ে জেনে নিলেন সব কিছু। আমরা ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন নিয়েও ক্লাস করি জেনে বললেন, ‘দেশি-বিদেশি সব রকম ফিল্ম দেখবে, ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনাও করতে হবে।’
দূরদর্শনের শুরুর দিকেই বিভাস চক্রবর্তীর প্রযোজনায়, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় অসাধারণ সাক্ষাৎকার নিলেন সত্যজিৎ রায়ের। মানিকদা আমাকে দেখা করতে বলেছেন জেনে, এক দিন তাঁর বাড়ি গেলাম। বললেন, ‘সময় পেলেই টেলিভিশন দেখছি। তোমার ‘দর্শকের দরবারে’, ‘সাহিত্য সংস্কৃতি’ ভাল লাগছে। কিন্তু তোমার চোখের পাতা এত ওঠাপড়া করে কেন?’ জিজ্ঞেস করলাম, কী করা যায় মানিকদা? বললেন, ‘মিরর এক্সারসাইজ করো।’ সুফল পেয়েছিলাম। বললেন, ‘টেলিভিশনের অনেক পসিবিলিটি। বিশেষ কোনও অনুষ্ঠান করলে জানিয়ো।’ শঙ্খ ঘোষের স্ক্রিপ্ট অবলম্বনে ‘জন্মদিনের ধারা’ অনুষ্ঠানটির কথা তাঁকে জানালাম। পর দিন ফোনে বললেন, ‘শঙ্খবাবুর স্ক্রিপ্ট, তোমাদের অনুষ্ঠান ভাল লেগেছে, কিন্তু তোমাদের ক্যামেরার শট এত কাঁপে কেন!’ বললাম, মানিকদা, আমাদের তো কোনও ক্যামেরা স্ট্যান্ডই নেই। বললেন, ‘তবে তো হয়েই গেল!’
মানিকদা ব্রিটেনে শ্রেষ্ঠ বিদেশি ফিল্ম ডিরেক্টর হয়েছেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া রেকর্ড করতে গেলাম। বললাম, একটা বোকা-বোকা প্রশ্ন নিয়ে এসেছি, আপনার কেমন লাগছে? ভাল লাগছে, সে তো জানা-ই। খুব হাসলেন। তার পর বললেন কোথায় ক্যামেরা প্লেস করতে হবে।
আমার বিবিসি লন্ডনের চাকরির জন্যে তাঁরা রেফারেন্স চেয়েছিলেন। আমি মানিকদাকে না-বলেই তাঁর নাম পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। জানতাম উনি আমার বিষয়ে ভাল লিখবেন। এক দিন ফোন এল বাড়িতে। আমি ছিলাম না। আমার ছোট্ট ভাইপো লুকু ফোন ধরে জিজ্ঞেস করল, কে বলছেন? ‘সত্যজিৎ রায় বলছি’, শুনে বলল, ধ্যাৎ, সত্যজিৎ রায় আবার কাউকে ফোন করে না কি! এ কথা মানিকদাই খুব হাসতে হাসতে আমাকে বলেছিলেন, পর দিন যখন তাঁর বাড়ি গেলাম। খুব বকুনি দিলেন আমায়। ‘তুমি এখানে ভাল কাজ করছ, তোমাকে বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়ার আইডিয়াটা কে মাথায় ঢোকাল!’ বললাম, পশ্চিমি দুনিয়ায় কেমন কাজকর্ম হচ্ছে, একটু দেখে আসতে চাই। বললেন, ‘যাও না, দেখে এসো, আমি যাচ্ছি না? আমি তো নিয়মিত বিদেশে যাচ্ছি।’ বললাম, আপনি তো সত্যজিৎ রায়। আমি সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে, পরীক্ষা দিয়ে, ইন্টারভিউ দিয়ে বিবিসি লন্ডনে চাকরি পেয়েছি। বললেন, ‘শোনো, আমাকে তো কত বার হলিউড ডেকেছে, আমি কি গেছি? যদি ভাল কাজ করতে হয় তবে এই মাটিতে বসেই ডাল-ভাত খেয়ে খোলা চোখ-মন নিয়ে কাজ করতে হবে। ও-সব বিদেশ-ফিদেশ গিয়ে কিস্যু হবে না।’ অনেক কথার পর বললেন, ‘ঠিক আছে যখন এত চাইছ, যাও। আমি তো তোমার সম্পর্কে ভাল লিখে দেব, কিন্তু ফিরে এসে দেখবে, কেউ তোমাকে কোথাও ঢুকতে দিচ্ছে না। তখন কিন্তু আমার এখানে এসে বসে থাকবে না, বলবে না, মানিকদা, আমার জন্যে আপনি কাউকে সুপারিশ করে দিন।’
লন্ডনে গিয়েই ‘ঘরে বাইরে’ দেখলাম ‘অ্যাকাডেমি’ সিনেমায়। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম স্টাডিজের কোর্সে যখন ভর্তি হলাম, সহপাঠীদের দেখিয়েছিলাম ক্যাসেটে ‘পথের পাঁচালী’। হাতে হাতে ঘুরত সেই ক্যাসেট।
দেশে এসে কলকাতার তিনশো বছর উপলক্ষে বিবিসি-র জন্যে মানিকদার ইন্টারভিউ করতে গেলাম। চলচ্চিত্রজগৎ থেকে একমাত্র তাঁরই ইন্টারভিউ নেব, শুনে চিন্তিত হয়ে কলকাতার অন্য এক বিখ্যাত পরিচালকের নাম করে বললেন, ‘সে তো তোমার উপর রেগে গিয়ে আবার যা-তা লিখবে।’ আমি বললাম, কিন্তু মানিকদা, বিলেতে তো ওঁরা কলকাতা বলতে বোঝেন মাদার টেরেজা আর সত্যজিৎ রে। মানিকদা বললেন, ‘তা-ও বটে, তুমি আর কী করবে!’
বিদেশে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ফিল্মটির নতুন করে প্রিন্ট হয়েছিল। মানিকদার কথামত তার কপি নিয়ে এসেছিলাম ওঁর জন্যে। ব্রিটেনের ফিল্ম সোসাইটি সেই সময়ে মানিকদাকে ব্রিটেনে আমন্ত্রণ জানাতে চাইছিল। আমাকে প্রাথমিক কথাবার্তা বলতে বলেছিল। মানিকদাকে প্রস্তাবটি জানাতে তিনি বললেন, ‘শোনো, ওঁদের বলবে আমাকে প্লেনে সামনের সিট দিতে হবে, আমার লেগ স্পেস লাগে। আমি তো আর একা যেতে পারব না। তোমার বউদিকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। আমাকে দিনে এতগুলো ওষুধ খেতে হয়, ও-ই তো সব ঠিক সময়ে এগিয়ে দেয়।’ লন্ডনে ফিরে ওঁদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম সব, কিন্তু সে বার আর মানিকদার লন্ডন যাওয়া হয়নি।
pankajsaha.kolkata@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy