Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ইহুদি স্ত্রীকে বাঁচাতে দেশ ছাড়লেন বিজ্ঞানী

১৯৩৮ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেলেন এনরিকো ফের্মি। তখন ইতালিতে চালু বর্ণবিদ্বেষী আইন। নোবেলপ্রাপ্তির অজুহাতে তাই সস্ত্রীক পাড়ি দিলেন আমেরিকায়। ১৯৩৮ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেলেন এনরিকো ফের্মি। তখন ইতালিতে চালু বর্ণবিদ্বেষী আইন। নোবেলপ্রাপ্তির অজুহাতে তাই সস্ত্রীক পাড়ি দিলেন আমেরিকায়।

দম্পতি: স্ত্রী লরা-র সঙ্গে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মি। ছবি: গেটি ইমেজেস

দম্পতি: স্ত্রী লরা-র সঙ্গে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মি। ছবি: গেটি ইমেজেস

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মাসকয়েক আগের কথা। ১৯৩৮ সালে সুইটজারল্যান্ডের লুগানোয় বসে আমেরিকার বাসিন্দা তাঁর এক সহকর্মীকে চিঠি লিখলেন পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মি। চিঠিটা বড় জরুরি। সেটা লিখতেই তো রোম থেকে এতটা উজিয়ে আসা। কারণ, লুগানো থেকে পাঠানো চিঠিতে সরকারি নজরদারির সম্ভাবনা কম।

তিনি যা করতে চলেছেন, সরকার বিন্দুমাত্র টের পেলেই, তাঁর সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। তাই এমন লুকোচুরি।

চিঠিতে ফের্মি যা লিখলেন, তার সারমর্ম— গত বসন্তে তোমরা যে অ্যান আরবর শহরে চাকরির প্রস্তাব আমাকে দিয়েছিলে, সেটা গ্রহণ করতে না-পারার জন্য আমার এখন অনুশোচনা হচ্ছে। কারণ শেষ বার তোমাকে যখন চিঠি লিখেছিলাম, তার পর থেকে এখানে অনেক কিছুই পালটে গিয়েছে। মনে হচ্ছে, আগামী বছরগুলোয় একটা কঠিন সময় আসতে চলেছে। আমার স্ত্রী ইহুদি বংশোদ্ভূত বলে আমার ছেলেমেয়েদের কাছে পরিস্থিতিটা অপ্রীতিকর হয়ে উঠতে পারে। তোমাকে লেখার কারণ, আমেরিকায় আমার জন্য যদি কোনও উপযুক্ত পদ থাকে, তা হলে আমি খুশিমনেই সেটা গ্রহণ করব। তবে, এটা খুব জরুরি কিছু নয়। ইচ্ছে হলে আমি অনায়াসেই আরও কিছু দিন অপেক্ষা করে যেতে পারি।

ঠিকই আঁচ করেছিলেন ফের্মি। সেই সময় দ্রুত বদলাচ্ছিল ইতালির পরিস্থিতি। হাওয়ায় ইহুদি-বিরোধী গন্ধ স্পষ্ট। যে বছর ফের্মি পদার্থবিদ্যায় পেলেন নোবেল পুরস্কার, সেই ১৯৩৮-এই ১৪ জুলাই ইতালিতে প্রকাশিত হল ফ্যাসিস্ট ‘ম্যানিফেস্টো অব রেস’। অনেকটা হিটলারের জার্মানির সুরেই এখানে বলা হল, ইতালীয়দের শরীরে বইছে খাঁটি আর্য রক্ত, কিন্তু ইহুদিরা এর মধ্যে পড়েন না। এর আরও কয়েক সপ্তাহ পরেই ইতালিতে চালু হবে প্রথম বর্ণবিদ্বেষী আইন। প্রথমে বিদেশি ইহুদিরা পড়বেন এই আইনের আওতায়। কিন্তু সামান্য পরেই দেশের ইহুদিরাও এই আইনের বলি হবেন।

স্ত্রী ইহুদি, তাই ফের্মিও বুঝতে পারছিলেন, ইতালি আর তাঁর পরিবারের কাছে নিরাপদ নয়। অথচ, এই ভাবে লুকিয়েচুরিয়ে রাতারাতি দেশ ছাড়ার কথা ছিল না তাঁর। ১৯২৭-’২৮ সাল নাগাদ রোম বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়োরেটিক্যাল ফিজিক্স বিভাগের অধ্যাপক পদে নির্বাচিত হন তিনি। এর দু’বছর পরেই ইতালির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনিটো মুসোলিনি তাঁকে রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব ইতালি-র সদস্যপদ দিয়েছিলেন। ফের্মি পেয়েছিলেন ‘এক্সেলেন্সি’ খেতাব, সঙ্গে দুর্দান্ত মাইনে এবং একটি ইউনিফর্ম। তত দিনে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সকে গবেষণার প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে বেছে ফের্মি ইতালি তো বটেই, গোটা ইউরোপের বিজ্ঞান-জগতের চোখের মণি।

তার পর গোটা তিরিশের দশক জুড়েই তাঁর একের পর এক কৃতিত্বের ছড়াছড়ি। এই সময়ই পরমাণু গবেষণায় ফের্মি তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি শুরু করেন। বোঝেন যে, পরমাণুর কণা নিউট্রনকে ধীরগতিও বানানো যায়। ‘স্লো নিউট্রন’। এই কাজের সূত্রেই আসে নোবেল প্রাইজ।

তত দিনে ফের্মি বিয়ে করেছেন লরা ক্যাপন-কে। তাঁর বই ‘অ্যাটমস ইন দ্য ফ্যামিলি: মাই লাইফ উইথ এনরিকো ফের্মি’-তে লরা লিখেছেন, এনরিকোর সঙ্গে তাঁর প্রথম মোলাকাতের দিনটি। ১৯২৪ সালের এক রবিবারে বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটতে বেরনোর কথা তাঁর। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেখা গেল, বন্ধুদের সঙ্গে এসেছেন আরও এক জন কালো স্যুট, কালো টুপি পরিহিত মানুষ (ইতালিতে কালো পোশাক মানে নিকটাত্মীয় কেউ মারা গিয়েছেন। পরে লরা জানতে পারেন, সদ্য মা’কে হারিয়েছিলেন এনরিকো)। বন্ধুরা আলাপ করিয়ে দিলেন সেই প্রতিভাবান তরুণ পদার্থবিদের সঙ্গে, মাত্র ২২ বছর বয়সেই যিনি রোমের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। লরা তখন ষোলো।

তার পর লরা-র স্মৃতি জুড়ে শুধুই সেই মানুষটি। বসন্ত সমাগমে এক রবিবাসরীয় বিকেলে তাঁর সঙ্গে কাটানো কিছু সময় আর এনরিকোর নেতৃত্বে প্রথম ফুটবল খেলা। ফুটবলের কিছুই জানতেন না লরা। অথচ জীবনের প্রথম ম্যাচেই এনরিকো দিলেন তাঁকে গোলকিপারের দায়িত্ব। এনরিকোর মতে, ওটাই নাকি সবচেয়ে সহজ কাজ। গোলের কাছে বলটা যেতে চাইলেই আটকে দিতে হবে, ব্যস। দিব্যি চলছিল খেলা। হঠাৎ এনরিকোর জুতোর সোলটা খুলে ঝুলতে থাকল জুতো থেকে। ব্যালান্স হারিয়ে ঘাসের ওপর দড়াম আছাড় খেলেন বিজ্ঞানী। আর এই সুযোগে তাঁর শরীর টপকে বল দৌড়ল গোলের দিকে। হেরেই যেতেন এনরিকো। কিন্তু হারতে দেননি লরা। গোলে ঢোকার আগেই আটকে দিতে পেরেছিলেন বলকে।

এর পরের সাক্ষাৎ দু’বছর বাদে। তখন মুসোলিনির কড়া মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ নীতির ফলে ফ্রান্সে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনাটি সদ্য ভেস্তে গিয়েছে লরা আর তাঁর পরিবারের। ইতালির বাজারে বিদেশি মুদ্রার আকাল। ফরাসি আল্পসের বদলে তাই বাক্স-প্যাঁটরা বেঁধে লরা-রা চললেন সান্টা ক্রিস্টিনা-য়। সেখানেই দেখা তাঁর সেই ফুটবল ম্যাচের বন্ধুদের সঙ্গে, আর এনরিকোর সঙ্গে। মাঝের সময়টা এনরিকো ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। কিন্তু এ বার তাঁর রোমে ফেরার পালা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবেন থিয়োরেটিক্যাল ফিজিক্সের অধ্যাপক হিসেবে। মুহূর্তে উৎসুক লরা-ও। তিনি নিজেও সেই সময় ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী। ফিজিক্স আর অংক নিয়ে পড়তে চাইছেন। কিন্তু ফের্মি তাঁর শিক্ষক হবেন না, কারণ তিনি অন্য বিভাগে পড়ান। তবে বন্ধু হতেই পারেন।

দ্রুত লরা বুঝে যাবেন, তাঁর এই ভাবী বন্ধুটি শারীরচর্চায় ভারী উৎসাহী। সঙ্গে খেলাধুলো আর পাহাড় চড়াতেও বেজায় আসক্তি। ম্যাপ হাতে এনরিকোর ছুটি কাটানোর প্ল্যান তৈরি, ‘...কাল আমরা যাব অল্প কিছুটা হাঁটতে, পর দিন একটু বেশি হাঁটব। তার পর শুরু করব পাহাড়-চড়া।’ একই দিনে ছ’মাইল পাহাড় চড়ে ফের অতটা নেমে আসা তাঁর কাছে মোটেই তেমন কঠিন কাজ নয়। ছোটদেরও সেখানে সঙ্গী হওয়া উচিত। কারণ তাঁর মতে, ‘নতুন প্রজন্মকে নেকুপুষু নয়, বরং শক্তপোক্ত আর সহিষ্ণু হতেই হবে। ছোটরা এর চেয়েও বেশি দূরত্ব হাঁটতে পারে। তাদের আলসেমিতে উৎসাহ দেওয়া উচিত কাজ নয়।’ লরা বলছেন, এনরিকোর ব্যাপারটাই ছিল এমন। তিনি বলবেন, অন্যরা অনুসরণ করবে, নিজেদের ইচ্ছেকে তাঁর সঙ্গে মিলিয়েমিশিয়ে। আর ছিল অদ্ভুত প্রাণশক্তি। নিজের তো বটেই, ক্লান্ত হয়ে পড়া মেয়েদের পিঠের বোঝাও নিজের কাঁধে তুলে এক বিরাট বোঁচকা-সহ অনায়াসে, না হাঁপিয়ে পাহাড় ভাঙতে পারতেন তিনি। এমন যে মানুষ, তাঁর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়?

সত্যিই আশ্চর্য মানুষ ছিলেন এনরিকো ফের্মি। সারা জীবন বিজ্ঞানকে রাজনীতির ময়দানের বাইরে রাখতে চেয়েছিলেন। প্রথম নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর-এর উদ্ভাবন তাঁরই হাতে, আমেরিকায় থিতু হওয়ার পর তিনি যোগ দিয়েছিলেন ম্যানহাটন প্রজেক্টে, আণবিক যুগের নির্মাতা বলা হয় তাঁকে, অথচ প্রথম যখন হাইড্রোজেন বোমা তৈরির কথা ওঠে, তীব্র প্রতিবাদ করেন তিনি। তাঁর কাছে এই বোমা ‘গণহত্যার অস্ত্র’ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অবশ্য পরে তিনি সুপারবম্ব তৈরির কাজে যোগ দেন। কিন্তু সেটা প্রধানত বৈজ্ঞানিক কারণেই, প্রতিশোধস্পৃহা বা নিছকই নিরীহ মানুষকে খুনের তাড়নায় নয়।

ঠিক এই কারণেই ইতালিতে থাকাকালীন মুসোলিনির আমলে যথেষ্ট সম্মান পেয়েও মাথা নিচু করেননি ফ্যাসিস্ট শক্তির কাছে। ১৯২৯ সালে তিনি ফ্যাসিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেটা কোনও রাজনৈতিক আবেগ থেকে নয়, বরং কিছু অতিরিক্ত স্টাইপেন্ডের আশায়, যা তিনি গবেষণায় ব্যবহার করতে পারবেন। ইতালিতে বর্ণবিদ্বেষী আইন চালু হওয়ার পর তিনি তাঁর তীব্র সমালোচনা করেন। শুধুমাত্র স্ত্রী লরা-র কারণে নয়, এই আইন তাঁর গবেষণার সঙ্গে যুক্ত থাকা অনেক মানুষের চাকরি কেড়ে নিয়েছিল।

ভবিষ্যৎ তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ফের্মির কাছে। তিনি যত বড় বিজ্ঞানীই হন না কেন, তাঁর ইহুদি স্ত্রী-কে বাঁচানোর পক্ষে সেই পরিচয় যথেষ্ট নয়। ঠিক এই সময় নোবেল পুরস্কার তাঁর কাছে ফ্যাসিস্ট জন্মভূমিকে ছেড়ে যাওয়ার এক চমৎকার অজুহাত এনে দেয়। স্টকহলম-এ পুরস্কার নেওয়ার পর আর পিছনে তাকাননি ফের্মি। পাকাপাকি ভাবে স্ত্রী-সন্তান সহ আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। তিনি যে কতটা দূরদর্শী ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় লরা-র বাবা-মায়ের শোচনীয় পরিণতিতে। অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও লরা-র বাবা অগাস্টো ক্যাপন রোম ছাড়েননি। কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিল, ইতালীয় নেভি-র অফিসার হওয়ায় তাঁর গায়ে কোনও আঁচ আসবে না।

অউশভিৎজ-এর গ্যাস চেম্বার অবশ্য সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE