Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০

হিং

পিনাকী ভট্টাচার্য

মহাভারতে পড়েছি, মাংসে ভাল ভাবে ঘি মাখিয়ে, হিং ছড়িয়ে খাওয়া হত। হিংয়ের সঙ্গে ভারতবর্ষের সম্পর্ক সেই আদ্যিকাল থেকেই মোটা দড়িতে বাঁধা। হিংয়ের আদি বাড়ি হল আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ পর্বতমালার পাদদেশ। আজও সেরা হিং সেখানেই মেলে। বিশ্বের কোণে কোণে সেখান থেকেই হিং পৌঁছয়। কিন্তু হিং বিশ্বজয় করল কী করে?

সৌজন্যে আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী। ভারতে আসার পথে ওদের সঙ্গে আনা সিল্‌ফিয়াম প্রায় শেষ। সিল্‌ফিয়াম না মাখিয়ে মাংস খাওয়া প্রায় আত্মহত্যার শামিল ছিল। কারণ মাংসের বোঁটকা গন্ধে যদি বমি করেও প্রাণ বেঁচে যায়, হজমের গোলমালে আর পেটের অসুখে প্রাণ যাওয়া প্রায় নিশ্চিত। ভারতের হাতার কাছে এসে খাওয়াদাওয়া নিয়ে অশান্তি চরমে ওঠে। সেনারা যখন দেশে ফেরত যাওয়ার কথা ভাবছে, ঘটনাক্রমে তখনই তারা হিন্দুকুশের পাদদেশে। সেখানে হিং পায় তারা। পেট আর প্রাণের দায়ে উগ্র গন্ধকেও মেনে নেয়। এই সৈন্যরাই ফেরার সময় দেশবাসীর জন্য হিং নিয়ে গিয়েছিল।

হিং প্রথম ইউরোপীয় মঞ্চে ঢুকেছিল সিল্‌ফিয়াম-এর প্রক্সি দিতে। সেটি মৌরির মতো দেখতে এক মশলা। রান্না থেকে চিকিৎসা, সব কিছুতেই কাজে লাগত। মাছ-মাংস খাওয়া হত সিল্‌ফিয়াম মাখিয়ে, আবার হজমের ওষুধ বা অন্য অসুখেও ব্যবহার চলত। হিপোক্রিতিসের লেখায় এর কথা আছে। সিল্‌ফিয়াম চাষ হত শুধু আফ্রিকার ক্রিয়েনের আশপাশের এলাকাতেই। জন্মাত অল্প। খ্রিস্টের জন্মের আগে অনেক শতক ধরেই গ্রিকরা ভেবেচিন্তে এর ব্যবহার করত। কিন্তু আমোদপ্রিয় রোমানদের হাতে পড়ে সিল্‌ফিয়াম ফুরোল। সে যুগের রোম চিকিৎসা, তুকতাক, কুসংস্কার সব গুলিয়ে ফেলেছিল। মাথার যন্ত্রণা কমাতে শেয়ালের অণ্ডকোষ কপালে বাঁধত, মৃগীরোগ সারাতে গাধার কলজে কাঁচা খেত। ভোগ-বিলাস-সম্ভোগের শিখরে তারা। সেই সময় ওদের ধারণা হয়, সিল্‌ফিয়াম জন্মনিয়ন্ত্রণের অব্যর্থ ওষুধ। লাগাম ছাড়া ব্যবহারের ফলে এক দিন তা বিলুপ্ত হয়ে গেল। গপ্পে আছে শেষ সিল্‌ফিয়ামটুকু খেয়েছিলেন সম্রাট নিরো। কোনও দরকার ছাড়াই।

সিল্‌ফিয়াম শেষ। টনক নড়ল ইউরোপের। গ্রিকরা কোঁচড় থেকে হিং বার করে দিল তাদের। এক বিশেষ রুটে হিং আসত রোমে। আফগানিস্তানের হিরাট প্রদেশ থেকে পূর্ব ইরানের মাশহাদ হয়ে কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল, সেখান থেকে বাগদাদ হয়ে ইউফ্রেটিস নদী দিয়ে পূর্ব সিরিয়া। উটের পিঠে মরুভূমি পার হয়ে ভূমধ্যসাগর। সেখান থেকে রোম ও অন্য ইউরোপীয় শহরে। হিংয়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘আসাফিটিডা’। ফারসি ‘আঝা’ আর লাতিন ‘ফয়েতিদা’ মিশিয়ে তৈরি, মানে ‘দুর্গন্ধওয়ালা বাকল’।

ভারতে হাজার হাজার বছর ধরে মাংস খাওয়ার চল। তাতে শাস্ত্রের অমত ছিল না। কিন্তু পেঁয়াজ আর রসুন ম্লেচ্ছ খাবার, তার ব্যবহার অশাস্ত্রীয়। এদের বদলে হিং দিলে, স্বাদটা প্রায় একই থাকত। খাবারে বোটকা গন্ধও হত না। মুঘল যুগেও হিন্দু রান্নায় উপুড়চুপুড় হিং পড়ত। ১৫৫০-এ ক্ষেমা শর্মার ‘ক্ষীমাকুতূহলম্‌’ ও ১৫৬৩-তে গার্সিয়া দ্য অরতা’র লেখায় ‘জেন্তু’ (হিন্দু) খাবারের কথায় হিং ঘুরেফিরে এসেছে।

গন্ধের জন্যে সাহেবরা হিংকে বলুকগে যাক ‘ডেভিল’স ডাং’! এই ডাং ইউরোপে গিয়ে রান্নাঘরে হিংটিংছট না করলে কী হত? ইউরোপীয় সভ্যতা হয়তো মহামারীর প্রকোপে দুই হাজার বছর আগেই সিল্‌ফিয়ামের পথে পা বাড়াত!

নেই-চোখ স্বাধীনতা

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

চাইবাসায় একটা বেতার কেন্দ্রে কর্মসূত্রে থাকার সময় বছর বারো আগে অগস্ট মাসের ৮/ ১০ তারিখ নাগাদ কর্মসূত্রেই রাঁচি যেতে হয়েছিল। রাঁচি দূরদর্শনে আমার এক বন্ধু কাজ করত। জানাল, কিরিবুরুতে, মুখ্যমন্ত্রী যাবেন পরশু সকালে, হেলিকপ্টারে, কিছু একটা উদ্বোধনে, ‘কভার’ করতে হবে। চ’ আমার সঙ্গে।

কিছু দূর যাওয়ার পর থামলাম। চা খাব। দোকানে গুলগুলা ভাজছে। গুড় মেশানো আটার বড়া। একটা কালো পোশাক পরা লোক, গলায় রঙিন কাচের মালা, হাওয়াই চটিতে লাল ধুলো, চা খাচ্ছে। পাশে রাখা মলিন কাঁথাকাপড়ের ব্যাগ থেকে উঁকি দিচ্ছে কয়েকটা রোল করা ক্যানভাসের মতো কিছু। কৌতূহল হল। ও কি জ্ঞানগুরু? ফকির-দরবেশ? তবে ব্যাগে গোটানো কাগজ কীসের? জিজ্ঞাসা করি, ‘ব্যাগে কী?’ বলে, উখানে যমরাজা বিরাজ করেন, তা বাদে সগ্গ আছে, লরক আছে, নাই চখ হড় আছে। বলি, ‘গুলগুলা খাবেন? গরম ভাজছে।’ বলে, দ্যান তবে দু’-চার। শালপাতার ডুঙিতে গুলগুলা দিলাম। নাম বলল, করলা পিটিয়া। কথা বলে বুঝলাম, লোকটা পটশিল্পী। যাচ্ছিল একটা লোধা বাড়ি, যে বাড়ির এক জন মারা গেছে ক’দিন আগে। এই অঞ্চলের কোনও কোনও সমাজের প্রচলিত প্রথায়, কোনও মৃতের বাড়ি গিয়ে পটচিত্রকর প্রথমে যমপট দেখায়। তার পর স্বর্গ-নরকে কী হয় দেখায় ও গান গায়, তার পর একটা চক্ষুহীন মানুষ দেখিয়ে রং-তুলি দিয়ে মৃত মানুষের নাম করে চোখ এঁকে দেয়। চোখ আঁকা হলে মৃত মানুষটি স্বর্গ কিংবা নরকে যাবে, নইলে ভূত হয়ে থাকবে। ওই অঞ্চলের কিছু সাঁওতালদেরও এ রকম একটা বিশ্বাস আছে।

সাঁওতালিতে হড় মানে মানুষ। নাই চখ হড় মানে চোখ না থাকা মানুষ। ছবিটা দেখাল। রঙিন কুর্তা পরা দু’দিকে দু’হাত ছড়ানো একটা মানুষের চোখের জায়গাটা সাদা। অথচ মাথায় মুকুট। নতুন কোনও চক্ষুদানের আগেই চোখ দুটো সাদা করে নিতে হয়। জানা গেল, ওর বাড়ি কাছেই, পটকা গাঁয়ে। ‘হাঁটলে চার বিড়ির পথ।’

বন্ধুটি বলল, সামনেই স্বাধীনতা দিবস। একটা ইউনিক প্রোগ্রাম নামিয়ে দেওয়া যায়। পটুয়াদের নিয়ে স্বাধীনতার পট... জিজ্ঞাসা করল, ‘স্বাধীনতার পট আঁকতে পারবে?’ ও বলে, ‘না আইজ্ঞা...’ ‘স্বাধীনতা ব্যাপারটা জানো তো?’ ‘গোটে পরব আইজ্ঞা... ঝান্ডা পরব।’ ‘এই পরব মানাও?’ ‘না আইজ্ঞা।’ ‘কী কী পট পারো?’ ‘যম, সগ্গলরক, সীতাহরণ, পিচলু হারাম, রিসা পট...’ ‘বীরসা পট পারো? গুড। ওতেই হবে। শোনাও তো’—

ও বলতে থাকে, ‘উলিহাতুরে জনম নেলা বিরসা মহারাজ/ বচপনে সে বুল্যে দিলেক হামি মুন্ডারাজ/ আংরেজি ইস্কুলে নানা বিদ্যা শিখিলেন/ কিন্তু আদিবাসী নিন্দা শুনে সাহেব মারিলেন।’

‘ওকে, ওকে। বাড়িতে পটটা আছে তো?’ হ আইজ্ঞা। বন্ধুটি বলে, ‘আমাদের গাড়িতে তোমার বাড়ি চলো। বিরসা পট গাইবে, আমরা ছবি তুলব। সাতশো টাকা পাবে। আধ ঘণ্টার কাজ। ফেরার সময় আবার এখানেই ছেড়ে দেব। লোধা বাড়ি যেও।

বড় রাস্তার ডান দিকের মোরাম ফেলা রাস্তায় চার কিলোমিটারের মতো ভিতরে পটকা গ্রাম। দশ-বারো ঘর পটুয়া থাকে এই গাঁয়ে। বোঝা গেল পটিকার থেকেই এই নাম। প্রত্যেকে রুগ্ণ, ভাঙা ঘরদোর। এখন পট দেখিয়ে রোজগার নেই আর। এ দিকের চল্লিশটা গ্রাম নিজেরা ভাগ করে নিয়েছে, কেউ মরলে চোখ-দান করে। চাষ জানে না। চলে কী করে? ‘বিপলা কার্ড আছে, আর মাটি কাটার কাজ।’ বিপলা মানে বিপিএল।

বসতির পিছনে হু-হু পাথুরে মাঠ, পাহাড়ের পাড় বসানো আকাশ। ভাল শুটিং স্পট। বন্ধু বলল, ‘যাও, বীরসা পটটা নিয়ে এসো। এই পোশাকেই শুট করব।’ করলা বলে, ইটা তো শুধু চক্ষুদানের কারণে পরা হয়। বন্ধু বলল, ‘তা হোক।’ পট নিয়ে এসে খুলে ধরে করলা। বাঃ, এই তো সাহেবের মুখে ঘুসি মারছে বীরসা, একদম ওটেনকে নেতাজি। মন্তাজ করে দেব। জমে যাবে। কিন্তু একটা ফ্ল্যাগ লাগে যে পিছনে। জাতীয় পতাকার তলায় দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা দিবসে বীরসা পট। কিন্তু পতাকা? ক্যামেরাম্যানকে হিন্দিতে বলল, কুইক, কাছেই হাতা নামে একটা গঞ্জ আছে। ওখানে পাওয়া যেতে পারে।

ক্যামেরাম্যান করিৎকর্মা। জাতীয় পতাকা খুঁজে পায়নি, কিন্তু ঝাড়খণ্ড মুক্তিমোর্চার পতাকা পেয়ে গেছে— সবুজ। বিজেপিরও পেয়েছে, গেরুয়া। ক্যামেরার ঢাকনায় সাদা কাপড় ছিল। একটা নাপিতকে পেয়ে ওর কাঁচি দিয়ে সাইজ মতো কাটিয়ে নিয়েছে, এবং গাড়িতে রাখা স্টেপলার দিয়ে আটকে একটা জাতীয় পতাকা বানিয়ে ফেলেছে। ঠিকই আছে, ওদের মতোই বিপলা।

লাঠির ডগায় পতাকা ফিট। ক্যামেরাম্যান ভিউ’তে চোখ রেখে বলল, ফ্ল্যাগ ঠিক নেহি লগতা। করলা উপরে তাকিয়ে বলল, চখ কই? পতাকার চখ? চখ ছাড়া ইটা তো মরা পতাকা। ‘চোখ দরকার নেই, পতাকাটা একটু আউট অব ফোকাস হলেই হবে। চলো।’

শুটিং শেষ। করলা বলে, ‘টাকা দিবেন বল্যেছিলেন যে...’ ‘চেক চলে আসবে। ঠিকানা নিলাম তো।’ ‘চেক কী বটে?’ ‘ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট নেই তোমার?’ ‘না আইজ্ঞা।’ ‘তবে তো রাঁচি গিয়ে ক্যাশ নিতে হবে। দিন পনেরো পরে চলে যেয়ো।’

বন্ধুটির কাছেই শুনেছি, লোকটি রাঁচি গিয়ে টাকা নেয়নি। হয়তো বাসভাড়াটাই জোগাড় হয়নি ওর।

নাই চখ জাতীয় পতাকা সমেত স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠানটা প্রশংসিত হয়েছিল।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy