অভিযাত্রী: দিল্লিতে হিন্দি ভাষার লেখকদের সঙ্গে বৈঠকে রাহুল সাংকৃত্যায়ন (ডান দিক থেকে দ্বিতীয়)
অল্পবয়সি ব্রাহ্মণ ছেলেটি প্রাচীন ‘টোল’-এ পড়াশোনার সুযোগ পেলেন বারাণসীতে, আর বিহারের ছাপরার কাছে পারসা মঠে। এই মঠে তাঁর অন্তর্ভুক্তি হল ‘উদাসী’ সাধু রামোদর হিসেবে। ছিন্ন হল পরিবার, বাড়ির বাঁধন। পরে সংস্কৃত শাস্ত্রগ্রন্থাদি নিয়ে পড়াশোনা করবেন বলে দক্ষিণ ভারতের তিরুমিশি-র উদ্দেশে যাত্রা করলেন, সে যাত্রার অনেকটা অংশই স্রেফ পায়ে হেঁটে। মহাকাব্যিক এই যাত্রায় রাহুল বুঝতে পারলেন, ভারত হল নিরবশেষ এক ভূখণ্ডের নাম, যেখানে প্রতি চার ক্রোশ অন্তর মানুষের মুখের ভাষা পালটে যায়। আবার উত্তর ভারতে অযোধ্যায় তিনি আকৃষ্ট হলেন আর্যসমাজের প্রতি। লাহৌর আর আগরার ‘আর্য মুসাফির বিদ্যালয়’-এর বৌদ্ধিক ছত্রছায়ায় তিনি যেন পুনরাবিষ্কার করলেন ভারতের বৈদিক অতীতকে। ফিরলেন বৈষ্ণব দর্শনের পথ থেকে। এই সময়েই সংস্কৃত ন্যায় ও মীমাংসার পাঠের মাধ্যমে প্রবেশ করলেন ভারতীয় দর্শনের গভীরে।
তখন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও নতুন এক যুগের সূচনা হয়েছে। যে বিহারে এক দিন তিনি সন্ন্যাসী রূপে কাজ করেছেন, সেই বিহারেই রাহুল কাজ শুরু করলেন কংগ্রেসের কর্মী-প্রচারক হিসেবে। রাজনৈতিক সংযোগ ও কার্যকলাপের জেরে অচিরেই কারাবন্দি হলেন। বন্দিদশায় পড়লেন বৌদ্ধযুগের ভারতে ফা-হিয়েন’এর ভ্রমণবৃত্তান্ত, বর্মি লিপিতে লেখা পালি গ্রন্থ ‘মজ্ঝিমনিকায়’। পরবর্তী কালে ভারতে বৌদ্ধ পুনরুভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির মধ্যে প্রধান কাজ ছিল সংস্কৃত গ্রন্থগুলিতে উল্লিখিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলি খুঁজে বের করা। এই গ্রন্থগুলি হারিয়ে গিয়েছিল, ভারতে এগুলির কোনও খোঁজই ছিল না। বৌদ্ধশাস্ত্রে মহাপণ্ডিত রাহুল জানতেন, ভারতের লিখিত ইতিহাসে ১৫০০ বছরের একটি ছেদ আছে, যখন বিহার ও বাংলা থেকে বৌদ্ধধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল কাবুলে, দক্ষিণ ভারতে। রাহুল চার বার তিব্বত গিয়েছিলেন, কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ছাড়াই। দুঃসাহসিক এই চারটি যাত্রায় তিনি ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অনেকগুলি হারিয়ে যাওয়া পাতা উদ্ধার করতে পেরেছিলেন।
বৌদ্ধ ধর্মস্থানগুলিতে ভ্রমণের ফলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সমাজ পরিবর্তনের জন্য সক্রিয় ‘অ্যাক্টিভিজ্ম’ দরকার। সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লেখা তাঁর প্রচারপত্রটি তিনি লিখেছিলেন লাসা-য় বসে। ১৯৩৮ সালে তাঁর শেষ তিব্বত অভিযান থেকে ফেরার পর বিহারে কৃষকদের হয়ে কাজে সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেন তিনি। ‘অল ইন্ডিয়া কিসান সভা’-র সভাপতি নির্বাচিত হলেন, ১৯৩৯ সালে ফের কারাবন্দি হলেন। ১৯৪৩-এ হাজারিবাগ কারাগারে বসেই কথাসাহিত্যের আদলে লিখেছিলেন ‘ভলগা সে গঙ্গা’। এই বই লেখার সময় কাজে লাগিয়েছিলেন সেই একই ঐতিহাসিক তথ্য আর নোট, মানবসভ্যতার বিবর্তন নিয়ে লেখা তাঁর ধ্রুপদী মার্কসীয় গ্রন্থ ‘মানব সমাজ’ লেখার ক্ষেত্রেও যা ব্যবহার করেছিলেন।
১৯৩০ ও ’৪০-এর দশকে সোভিয়েত মধ্য এশিয়ার, এবং ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে চিন বিপ্লবের পর চিনের সঙ্গে সংযোগ তাঁকে কৃষিভিত্তিক ভারতবর্ষে পরিবর্তন সাধনের ভাবনায় প্রাণিত করেছিল। সাংস্কৃতিক ভারতের আরম্ভ ও তুঙ্গস্পর্শ কোনওটাই যে আধুনিক ভারতের নিজস্ব সম্পদ নয়, বরং বহির্ভারতের সভ্যতাগুলিতেও তার বিকাশ হয়েছিল, রাহুলের লেখা এ সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে। তিনি ব্যবহার করেন এক নদীর রূপক, অসংখ্য শাখানদীকে যে নদী নিজেতে মিশিয়ে নিয়ে বয়ে চলে। রাহুল বলেন, মিশ্র সংস্কৃতিগুলি এ ভাবেই একে অন্যের মধ্যে জড়িয়ে থাকে, স্থানে স্থানে তাদের দেখাসাক্ষাৎ হয়।
তাঁর ভাবনার ভারতবর্ষ পারস্পরিক সমতা ও সমানাধিকারের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এক রাষ্ট্র। এমন এক দেশ, যেখানে ‘প্রিভিলেজ’ শব্দটাই অপ্রয়োজনীয়, কারণ সমস্ত প্রতিভা, সকল দক্ষতা এই ভূমিতে নিজেদের মেলে ধরবার সমান ও পর্যাপ্ত জায়গা পায়।
এক বিশ্বাস থেকে আর এক বিশ্বাসে চলতে চলতেও, রাহুল সব সময় যেমন বুদ্ধের, তেমনই বুদ্ধির, মননেরও প্রকৃত অনুগামী। ‘মেরি জীবন যাত্রা’ বইয়ের ভূমিকায় বুদ্ধকে তাঁর শিক্ষক ও গুরু আখ্যা দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘‘নানান অভিমতকে আমি গ্রহণ করেছি একটা নৌকোর মতো, যাতে নদী পেরিয়ে বিপরীত তীরে যেতে পারি। কিন্তু সেই অভিমতগুলোকে এমন বোঝা করে তুলিনি, যাতে মনটাই পাষাণভার হয়ে যায়।’’