পাবনা শহর। ‘পড়িলিখি আদমিকে’ চিরকুট বাড়িয়ে একটু পড়ে দিতে বললেন এক ঠেলাওয়ালা। কিন্তু উর্দু জানা নেই সেই ‘আদমি’র। এই সূত্রেই মৌলানা মুইনদ্দীন দর্দাঈয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং উর্দুতে দড় হওয়া। পরে শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে ‘গালিব: নির্বাচিত কবিতা’ সম্পাদনা, ‘কৈফি আজমির কবিতা’র অনুবাদও করেছেন তিনি। শেষোক্ত বইটির জন্য সাহিত্য অকাদেমির অনুবাদ পুরস্কার (উর্দু) প্রাপ্তি। লিখেছেন গজলও। শুধু উর্দু নয়, বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, হিন্দি, মৈথিলী, পালি, আরবি, ফারসি, নেপালি, ওড়িয়া, ফরাসি, স্প্যানিশ-সহ মোট ১৮টি ভাষায় বিচরণ তাঁর! তিনি জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনের মাস্টারমশাই জ্যোতিভূষণ চাকী (১৯২৫-২০০৮)।
জ্যোতিভূষণের জন্ম মামার বাড়ি দিনাজপুরে। বাবা অহিভূষণ, মা জ্যোৎস্নারাণী। পড়াশোনা দিনাজপুর জেলা স্কুল, সংস্কৃত সাম্মানিক নিয়ে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভাষাশিক্ষা পণ্ডিত দুর্গাপ্রসন্ন বিদ্যাভূষণ, মুইনদ্দীন সাহেব, মোহম্মদ আন্তোনিও উবের কাছে। জ্যোতিভূষণ ভাষা-ভাবুক, অনুবাদক, বৈয়াকরণ, অভিধানকার, প্রাবন্ধিক, ছড়াকার, সঙ্গীতজ্ঞ! কিন্তু বিদ্যাচর্চার ইমারতে পাণ্ডিত্যকে আড়াল করে রাখে জ্যোতিভূষণের জীবন ও শব্দ-রসিকতা। তাই বোধহয় তাঁর কাছে পণ্ডিতের ব্যাসবাক্য— ‘যিনি পণ্ড করেন!’
শব্দ-খেলার অনন্য রূপ জ্যোতিভূষণের ‘বাগর্থকৌতুকী’ বইটি। তা পড়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উক্তি, লেখক ‘বিদ্যাচঞ্চুর দিগ্গজ খোলস ছেড়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান পায়ে ঘুঙুর বাঁধা এক হরবোলা বহুরূপী’ হিসেবে। ভাষার বহুরূপের সন্ধান জ্যোতিভূষণের ‘শব্দ যখন গল্প বলে’, ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’, ‘শুদ্ধ লেখো ভাল লেখো’ প্রভৃতিতেও রয়েছে। মুখশব্দের অশ্রুত বঙ্গানুবাদেও তিনি সিদ্ধহস্ত। ‘রুমাল’ শব্দটি সম্পর্কে তাই বলেছেন, ‘চৌকো এক টুকরো লিনেন বা সিল্ক যা কারও শেষকৃত্যের সময় চোখের জলের অভাব ঢাকবার কাজে লাগে’! এই মানুষটি স্বপ্নেও যে ‘ছাপাখানার ভূত’-এর সঙ্গে গল্প জুড়বেন,সেটাই স্বাভাবিক!
জ্যোতিভূষণ আদতে জীবন-রসিক। ৮১ নম্বর কাঁকুলিয়া রোডের এই প্রবীণকে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির একতলার ঘর থেকে বেরিয়ে অশক্ত শরীরে বাসে করে বাড়ি ফিরতে দেখা যেত প্রায়ই। কেমন আছেন, জিজ্ঞাসা করলে উত্তর, ‘মাঝে মাঝে একটু টলে’! অর্থাৎ বয়সের ভারে পা টলে যায়! নন্দন চত্বরে এক দিন সাহিত্যিক হর্ষ দত্তের সঙ্গে তাঁর দেখা। হর্ষ দত্তের জিজ্ঞাসা, কেমন আছেন? উত্তর, ‘বলতে পারেন ভাল-মন্দ মিশিয়ে।... ভাম অবস্থান। ভালর ‘ভা’ আর মন্দর ‘ম’...।’
তাঁর জেঠুনের রসিকতার সাক্ষী ভাইপো পথিকও। তাঁর স্মৃতিতে রয়েছে বাড়ির লোকজনকে জ্যোতিভূষণের দেওয়া বিভিন্ন নাম— বাবুরাম, ভ্যাসাদা, জ্ঞানদা, পেনদা, আপালা প্রভৃতি। আসলে জ্যোতিভূষণ আজীবন ছোটদের কাছে বড়দের জগৎটা মেলে ধরে তাদের মনে স্বপ্ন দেখার বেপরোয়া সাহস বুনতে চেয়েছেন। এই ভাবনারই ফসল ‘সোনাঝুরি’, ‘ছড়া পিদ্দিম জ্বলে’, ‘টগবগিয়ে নতুন দেশে’, ‘পায়ে পায়ে এতদূর’, ‘বই তো পড়ো, টই পড়ো কি?’, ‘ঢ্যাম্ কুড়্ কুড়্’ প্রভৃতি বই বা তাঁর সম্পাদিত ছোটদের মাসিক সংবাদপত্র ‘হরকরা’।
রসিকতার আড়ালে শুদ্ধ ভাষা-চর্চার যুক্তিতেই আস্থাবান জ্যোতিভূষণ। তাই চিন্তিত হয়েছেন ভাষা-আগ্রাসন দেখে। পছন্দ করেননি হাঙ্গামা, ধামাকার মতো বাজারখ্যাত শব্দ। ব্যঙ্গ করেছেন বানান নিয়ে গা-এলানো ভাবকেও— ‘বানান মানেই হ’ল বানানো/ বানানে মিথ্যে মাথা ঘামানো/ হ্রস্ব ই দীর্ঘ ঈ/ যা আসে তাই সই/ বানানে যা চার তাই চারশো/ সব কিছু আৰ্ষ!’ কখনও বা বিরক্তিতে বলেছেন, ‘বানান ভুল নিয়ে একটা মেগা-সিরিয়াল হয় না কেন?’
আসলে জ্যোতিভূষণ বিদ্যাচর্চায় যুক্তিকে সঙ্গী করেছেন। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্যে ‘নূতন এক দিগন্ত’ অনুধাবনের সঙ্গেই সেখানে দেখেছেন সাধু-চলিতের মিশ্রণ, বাক্যের গঠনগত, প্রয়োগগত ত্রুটি। নিজের ত্রুটিও মানতে জানতেন মানুষটি। চাকী মহাশয়ের হাতের লেখা দুষ্পাঠ্য। ছাপাখানার অপারেটর তাই ‘লেখা ভাল করার চেষ্টা করুন’ বললে বিনীত ভাবে প্রবীণ মাস্টারমশাই বলেছেন, ‘চেষ্টা তো করি, কিন্তু হাতের লেখা ভাল করার বয়স যে আর নেই।’ যুক্তিনিষ্ঠার উজ্জ্বল পরিচয় জ্যোতিভূষণের সংস্কৃত সাহিত্যের অনুবাদগুলি। কালিদাস, ভাস, ভারবি থেকে জয়দেব-সহ নানা জনের সৃষ্টির টীকা, ব্যাখ্যার বিষয়ানুগত্য-সহ প্রাঞ্জল অনুবাদ বাংলা ভাষায় দুর্লভ। এই সূত্রেই অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেছেন, জ্যোতিভূষণ আমাদের শিখিয়েছেন অনুবাদের গোড়ার কথা — “ধ্রুপদী পটভূমিকে আয়ত্ত করে নিতে না পারলে আধুনিকতার কোনো মুক্তি নেই।”
শুধু সাহিত্য নয়। জ্যোতিভূষণের জ্যোতি সঙ্গীতজগতেও ছড়িয়ে। এখানে তাঁর গুরু অরুণেন্দু নন্দী, পূর্ণেন্দু নন্দী, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। জ্যোতিভূষণ সামলেছেন ‘মল্লার’ সঙ্গীত-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পারফর্মিং আর্টস ফর চিলড্রেন-এর অধ্যক্ষের দায়িত্বও। তিনি মূলত মার্গসঙ্গীতে প্রশিক্ষিত শিল্পী, তবে তাঁর চর্চায় থেকেছে পল্লিগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত। কলকাতা বেতার কেন্দ্র অনুমোদিত গীতিকার জ্যোতিভূষণের লেখা গানের সঙ্কলন, ‘আজকের দিনের গান’। রয়েছে বেশ কিছু নৃত্যনাট্যও। আকাশবাণী, দূরদর্শন, দিল্লির নেটওয়ার্ক প্রোগ্রাম-সহ নানা জায়গায় তাঁর সৃষ্ট নানা কিছুই প্রচারিত হয়েছে অজস্র বার। শিক্ষা মন্ত্রক আয়োজিত ‘জাতীয় সংহতি শিবির’ পরিকল্পনায় পঞ্জাব, কাশ্মীরে বাংলার প্রতিনিধিত্বও করেছেন। আমৃত্যু যুক্ত থেকেছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, সাহিত্য অকাদেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি, পশ্চিমবঙ্গ উর্দু অ্যাকাডেমির মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। যুক্ত ছিলেন বেঙ্গল কাউন্সিল অব এডুকেশন-এর ‘জাতীয় অভিধান’-এর কাজের সঙ্গেও। বিদ্যাচর্চার এমন ‘প্রতিষ্ঠান’কে ডি লিট সম্মান জানিয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।
তবে ছাত্রদের থেকেই শ্রেষ্ঠ সম্মান পেয়েছেন জ্যোতিভূষণ। তখন তিনি পার্ক সার্কাসের মডার্ন স্কুলের শিক্ষক। আগে পড়িয়েছেন পাবনা গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনেও। মডার্ন স্কুলের ছাত্রেরা অবাক চেয়ে দেখে, বাংলার শিক্ষক জ্যোতিভূষণ পণ্ডিতমশাই না এলে সংস্কৃত, মৌলবি না এলে উর্দু, আরবি, আবার কখনও বা হিন্দি, সবই একই রকম দক্ষতায় পড়িয়ে চলেন। কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের রুগ্ণ চেহারা দেখে গুজব: তিনি যক্ষ্মা আক্রান্ত! পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন জ্যোতিভূষণ। যোগ দিলেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে। মাস্টারমশাই সম্পর্কে তাঁর ছাত্র, এখন স্বনামধন্য অধ্যাপক চিন্ময় গুহের বক্তব্যটি স্মরণীয়— ‘এক মেঘের মতো মানুষ প্রচণ্ড দ্রুত বেগে হেঁটে যাচ্ছেন আর চারপাশে উড়ছে আলোর ফুলকি।... অদৃশ্য এক বাঁশি ছিল শিক্ষক জ্যোতিভূষণের হাতে। স্কুল ছেড়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশ বিভুঁই কোথাও অমন বাঁশিওয়ালা আর দেখিনি তো।’
জীবন-বাঁশির সুর কাটল ৭ ডিসেম্বর, ২০০৭-এ, স্ত্রী প্রকৃতিদেবীর মৃত্যুতে। অসুস্থ শয্যাশায়ী স্ত্রীর দু’হাত ধরে বসে থাকতেন জ্যোতিভূষণ। সেই অনন্ত বসে থাকায় পূর্ণচ্ছেদ পড়ার রেশ ধরেই ২০ মার্চ, ২০০৮-এ জ্ঞান হারালেন এক নিঃসঙ্গ মাস্টারমশাই। পিজি হাসপাতালের এক চিকিৎসক রোগী দেখে দোতলার বারান্দায় বললেন, ‘এমন হার্ট সহজে দেখা যায় না।’ পাশ থেকে অন্য এক চিকিৎসকের বক্তব্য, ‘হৃদয় বলুন, হৃদয়!’
‘হার্ট’-এর স্পন্দন থামল ২৭ তারিখ, ভোর ৪টে ৫-এ। আর মাস্টারমশাইয়ের হৃদয়পুরের বিস্তৃতি বোঝা গেল শেষ যাত্রায়— প্রাক্তন উপাচার্য, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাইকেল মিস্ত্রি, কে নেই সেখানে। তাঁদের মধ্যেই এই বেতাল-বেসুরো সময়ে চিরঞ্জীব হয়ে আছেন চির উন্নতশিরশিক্ষক জ্যোতিভূষণ।
তথ্যঋণ: ‘দেশ’, ‘বইয়ের দেশ’, ‘জ্যোতিভূষণ চাকী শতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ’: সম্পাদনা শুভাশিস চক্রবর্তী (বইওয়ালা বুক ক্যাফে)
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)