Advertisement
E-Paper

স্মৃতির গলি-রাস্তায় হাঁটাহাঁটি

ওদের মফস্সল শহরের ওই চৌমাথাটায়, ওর ইস্কুল আর পাড়ার বন্ধুরা যেখানে বসে আড্ডা দেয় আর সিগারেট টানে, সেখানেই এসথারের সঙ্গে ওর প্রথম দেখা। প্রথম বার আলাপের সময়ই এসথার বলেছিল, ‘আমি তত কিছু সুন্দর নই। তবে আমার শরীরটা সুন্দর।

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০

ওদের মফস্সল শহরের ওই চৌমাথাটায়, ওর ইস্কুল আর পাড়ার বন্ধুরা যেখানে বসে আড্ডা দেয় আর সিগারেট টানে, সেখানেই এসথারের সঙ্গে ওর প্রথম দেখা। প্রথম বার আলাপের সময়ই এসথার বলেছিল, ‘আমি তত কিছু সুন্দর নই। তবে আমার শরীরটা সুন্দর। তোমরা ছেলেরা তো ওটাই প্রথম দেখো।’ মেয়েটার নীল দিঘির মতো গহন দু’চোখের দিকে তাকিয়ে পল বলেছিল, ‘আমি কিন্তু প্রথম মেয়েদের চোখই দেখি। হ্যাঁ, বুকও দেখি।’ পল তখন উনিশ, আর এসথার এই বছর চোদ্দো-পনেরো।

আর সে দিনের সেই পল ডিডেলাস এখন নামজাদা এক নৃতাত্ত্বিক। এত দিন ধরে লম্বা একটা গবেষণার কাজে তাজিকিস্তানে ছিল। এ বার পাততাড়ি গোটানোর পালা। যাওয়ার বেলায় তার এখানকার সঙ্গিনী, সহকর্মী মেয়েটি পলের ঘরে আসে। দুজনের আলতো আদর-আদর খেলার মুহূর্তেই মেয়েটি বলে ওঠে, তুমি আমার স্মৃতি হয়ে থাকবে। সামান্য এই এক টুকরো কথাই মাঝবয়সি পলের হৃদ্‌মাঝারে স্মৃতির গোপন হ্রদে কী ভাবে ঢেউ তোলে, তাই নিয়েই এই ছবি, যার মূল ফরাসি নামটার আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায়— ‘আমার যুবকবেলার তিনটি স্মৃতি।’

তিনটি পর্বে ছড়ানো পলের এই স্মৃতি-সফর তেমন গোছানো, পর পর ঘটে যাওয়া কোনও টানা ন্যারেটিভ নয়। আবার ছবির ফরাসি নাম-মাফিক হাতে-গোনা স্রেফ ‘তিনটে’ স্মৃতির গলি-রাস্তায় হাঁটাহাঁটিও নয়। আসলে পুরনো কথা ভাবতে গেলে যে রকম হয়, একসঙ্গে অনেক কিছু মনে পড়ে যায়, একটা স্মৃতি কিছুতেই বিশুদ্ধ ‘একলা’ থাকতে পারে না, গায়ে গায়ে লেপটে থাকে আরও কিছু স্মৃতি, আরও অনেক চরিত্র— এ ছবির গড়নটাও সে রকমই।

সত্যি বলতে, আগের দুটো এপিসোড আসলে ছবির মূল পর্ব ‘এসথার’-এ পৌঁছনোর জন্য আলগা করে রাখা সিঁড়ির মতো। তার শৈশব আর কৈশোরের কিছু খুচরো গল্প, যা উনিশ বছর বয়সের পল-কে জানতে, বুঝতে একটু সাহায্য করবে, বা করবেও না! তবে পল আর এসথারের গল্পও কিন্তু শুধুই ওদের দুজনের গল্প নয়। ওটা একটা সময়ের গল্প— আবার চোদ্দো থেকে উনিশ, ওই বয়সটারও গল্প। আশির দশকের একেবারে শেষের ওই সময়টায় কোথাও মুঠোফোন নেই। অঝোর বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া প্যারিসের এক টেলিফোন বুথের ভেতরে দাঁড়িয়ে পল ফোনের ও-ধারে এসথারের ভিজে, গাঢ়, মেঘলা-বিষাদমাখা উচ্চারণ শোনে। কোনও ই-মেল নয়, কাগজের বুকে কলমের ছোঁয়ায় ওরা ওদের ভালবাসার শব্দ ফোটায়। ক্যামেরার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এসথার ওর হৃদয়ের চিঠি পড়ে। বন্ধুদের সঙ্গে এক সন্ধ্যায় ওদের চোখের সামনেই টেলিভিশনের পরদায় ভেঙে যায় বার্লিন প্রাচীর! দেওয়ালের দু’ধারে ওদের মতোই কত কিশোর-মুখ! বয়ঃসন্ধি এক আশ্চর্য সময়— বিদ্রোহের, রোম্যান্সের, অজানা, অবুঝ মনখারাপের। বিছানায় তুমুল মিলনের পরেও এসথার তাই হঠাৎই মৃত্যুর ভয় পায়। পলের তরুণ দু’বাহু প্রবল আবেগে তখন নির্ভরতা দিতে চায়। আবার পলের প্যারিসে ফিরে যাওয়ার সময় এসথার যখন তীব্র কান্নায় খানখান হয়ে যেতে যেতে বলে, ‘তুমি চলে গেলে আমার ভীষণ ভয় করবে’, তখন কিন্তু পল তাকে কোনও সান্ত্বনা দিতে পারে না।

নিঃসঙ্গতা কাটাতে এসথার ওদেরই বন্ধু জাঁ পিয়েরের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়। এটা তো সেই বয়সও, মুহূর্তের উত্তেজনায় যখন সম্পর্ক মধু বা বিষ হয়ে যায়! প্রচুর ক্লোজ-আপ এখানে দর্শকের সঙ্গে চরিত্রের সম্পর্ককে উষ্ণতা দেয়। ছবির ট্রিটমেন্টের সারা গায়ে জড়ানো আধুনিক ফরাসি নবতরঙ্গের গয়না। সুরভিত, রোম্যান্টিক, ধূসর কৌতুকের মেজাজটা টের পাওয়া যায় আগাগোড়া। ছবির এপিলোগ পর্বে তাই সস্ত্রীক জাঁ পিয়েরের সঙ্গে পল ডিডেলাসের হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। আর এসথারের প্রসঙ্গ উঠতেই তাদের মধ্যবয়সি ভদ্রতা-সৌজন্যের মুখোশ খুলে কিশোরবেলার প্রেম-বিরহ-তিক্ততা সবটাই তীব্র আবেগে ফেটে পড়ে। ছবির একেবারে শেষে অবশ্য আমরা পল আর এসথারকে আবার সেই কবেকার আদরের নৌকোয় ভেসে যেতে দেখি। বর্তমানের রিক্ততায় দাঁড়িয়ে সোনালি স্মৃতির চেয়ে ভাল আশ্রয় কিছু আছে নাকি?

sanajkol@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy