Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৫ ০০:০৪

এক বার এক আরব বণিক মরুভুমির বুক চিরে হাঁটা দিল অন্য পারের বেরাদরদের সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে নিল দুধ, ছাগলের পাকস্থলী দিয়ে তৈরি এক থলেয় (সেই জমানায় পশুর কোনও অংশ ফেলে দিয়ে নষ্ট করার দস্তুর ছিল না)। সন্ধেবেলা ক্লান্ত আরব থলে থেকে দুধ বার করতে গিয়ে দেখল দুধ নষ্ট হয়ে গিয়েছে— পরিবর্তে সেখানে আশ্চর্য এক দলা সাদা মণ্ড পড়ে আছে জলের মধ্যে গা ডুবিয়ে। খিদেয় তার পেটে ছুঁচো কুচকাওয়াজ করছে, আর সেই জনমানবশূন্য মরুভূমিতে খাবার জোগাড় করারও কোনও উপায় নেই। অগত্যা সেই সাদা বস্তুতেই কামড় বসাল সে। আর জলটায় চুমুক দিল তেষ্টা মেটাতে। খুবই সুস্বাদু! এই ভাবেই জন্ম হল চিজ-এর। এই মণ্ডটা ছিল ছানা— যার বিদেশি নাম কটেজ চিজ।

আরবরা যতই এই গল্প করে চিজের মালিকানা দাবি করুক, এই বণিক ঠিক কবে হাঁটা লাগিয়েছিল জানা যায় না। বরঞ্চ এটা জানা যায়, মিশরীয়রা চিজ বানানোর কায়দা আজ থেকে চার হাজার বছর আগে দেওয়ালে লিখে রেখেছিল। রোমে চিজ এতই প্রিয় ছিল যে, রইস লোকেদের বাড়িতে চিজ রাখার জন্য আলাদা ঘর অবধি থাকত, যাতে অন্য খাবারের সঙ্গে থেকে তার স্বাদ আর বাস নষ্ট না হয়ে যায়। গ্রিকরা চিজের ব্যাপারে ছিল আর এক কাঠি সরেস। চিজ তাদের কাছে এতটাই দেবভোগ্য খাবার ছিল, চিজ বানানোর কৃতিত্ব মানবজাতির হাতে না রেখে তারা সটান সে কৃতিত্ব প্রদান করেছিল অ্যাপোলো-পুত্র অ্যারিস্তিউসকে। ওল্ড টেস্টামেন্ট-এ অবধি লেখা আছে সে কথা। জ্যেষ্ঠ প্লিনি তাঁর ৭৭ খ্রিষ্টাব্দে লেখা ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি’-তে পুরো এক পরিচ্ছেদ লিখেছিলেন চিজের রকমফের নিয়ে, সাম্রাজ্যের কোথায় কী চিজ পাওয়া যায় তার বিশদ বিবরণ দিয়ে। তবে চিজের ব্যাপারে বাকি সব দেশকে টেক্কা দিয়েছে পোল্যান্ড। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে হালে জানা গিয়েছে, আজ থেকে সাত হাজার বছর আগেও পোল্যান্ডের অধিবাসীরা চিজ তৈরি করত!

চিজ তৈরির কৃতিত্ব আসলে আলাদা করে কোনও একটা দেশকে দেওয়া মুশকিল, কারণ এই কৃতিত্বটা সমগ্র মানবজাতির। সভ্যতার সঙ্গে পরের ধাপ হিসেবে এসেছিল পশুপালন— আর সেইখানেই চিজের জন্ম। ৮৫০০ খ্রিস্টপূর্বে ভেড়া-ছাগল পালন শুরু হয় পশ্চিম এশিয়ায়, দক্ষিণ আমেরিকায় লামাদের পোষ মানানো হয় ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বের আশেপাশে, তিব্বতিরা ইয়াক আর ভারতীয় উপমহাদেশ মোষ পুষতে শুরু করে ২৫০০ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ। এদের দুধ হয়ে ওঠে অন্যতম পানীয়। আর ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, এই সব জায়গায় চিজও একই সময় এসেছে। কারণ দুধ নষ্ট হলেও ফেলা যেত না, আর সেই ছানা থেকেই চিজের জন্ম। আদ্যিকালে চিজ বলতে লোকে ছানাই বোঝাত। সেই ছানার ওপর কারিকুরি করতে করতেই বিশ্বের সব নামী চিজ তৈরি হয়েছিল। এই গবেষণাগুলো মূলত হত মনাস্ট্রির উঁচু পাঁচিলের ভেতর। সে রকম এক মনাস্ট্রি থেকেই জন্ম নিয়েছে গরগঞ্জোলা, ইতালির পো নদীর পাড়ে ৮৯৭ সালে। রক্‌ফর্ত ১০৯৭ সালে ফ্রান্সে। আর শেডার ১৫০০ সালে ইংল্যান্ডে, পারমেশান ১৫৯৭ সালে ইতালিতে, গউডা ১৬৯৭ সালে নেদারল্যান্ডসে।

এখনকার চিজ কিন্তু আবার এশিয়া মহাদেশে অচেনা ছিল— আমরা ছানার ডালনা আর পনির বাটার মসালা নিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছি বছরের পর বছর। চিজের স্বাদ পেতে শুরু করেছি এক্কেবারে হালে— যখন খাবারও বিশ্বায়নের আওতায় চলে এল।

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

স্যর, ভূমিকম্প কিন্তু ব্যভিচার, হিন্দু-মোসলমানের বিয়ে, এ সবের জন্য হয় না।’ লোকটা হাত দুটো পিছনে নিয়ে গলা উঁচু করে দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘোষণাটা দিল। ভাবটা যেন হাইকোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষুদিরাম বোস। এ রকম অনেক ছিটেল আকাশবাণীতে আসে, আমি এড়িয়ে যাচ্ছি, সে বলল যাবে না, কথা আছে, ‘আপনার সঙ্গে কথা কইব বলে ভোর পাঁচটায় রওনা দিয়ি বেলা তিনটেতে পৌঁছলাম।’ বলি, ‘কোথা থেকে এসেছেন?’ ‘বেগুনখালি, হিঙ্গলগঞ্জ থানা। আজ আর ফেরা হবেনি, সন্‌ঝের পর ভুটভুটি বন্ধ। রেতে হাসপাতালে থেকি যাবানে।’

‘হাসপাতাল কেন’ জিজ্ঞাসা করলে শুনি, ‘আরে, কলকাতা এলি তো ওখানেই শুই, আস্তায় ঝামেলি খুব। হাসপাতালে উগির নোকজন শুয়ি থাকে, ওদের সঙ্গেই শুয়ি যাই, সিঁড়িতে। কেউ কিছু বলে না। দরকার হলি তো কলকেতা আসতিই হয়, যেমন আজ এলাম।’

২০০১, জানুয়ারি। আমি তখন আকাশবাণীর বিজ্ঞান সংক্রান্ত অনুষ্ঠানগুলো করি। সে বার ২৬ জানুয়ারি গুজরাতে প্রবল ভূমিকম্প হল। ভুজ শহরটা ধ্বংসস্তূপ।

লোকটাকে বলি, ‘বলুন কী দরকার।’ সে ঘাড় উঁচু করে বলে, ‘গোমাংস খেলে পৃথিবী কাঁপে না।’ আমি বলি, ‘এ সব নতুন কথা কী?’ লোকটা বলে, ‘এক মস্ত সাধু এ কথা কয়েছেন, কাগজে নিকেছে।’ আমি বলি, ‘রেডিয়ো থেকে তো এ সব বলা হয়নি, তো আপনি এত কষ্ট করে এখানে এলেন কেন?’ সে বলল, ‘এ সব বলেননি রাইট কথা, কিন্তুক, একটা ভুল কয়েছেন। কয়েছেন, ঝড়-বৃষ্টির মতো ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়।’ ‘ঠিকই তো বলা হয়েছে...পারি না তো।’ ক্ষুদিরামের মতোই ধুতি-হাফ শার্ট পরা লোকটা মাথা উঁচিয়ে বলে, ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর।’

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকাই। সে বলে, ‘শুনুন স্যর, পৃথিবীটা কচ্ছপের উপর বসানো, কচ্ছপ নাড়াচাড়া করলি পৃথিবী কাঁপে— এটা বাজে কথা। বলি, কচ্ছপ কার উপর বসি আছে? আসল কথাটা হল, মা ধরিত্রীর কষ্ট হলি ভূমিকম্প হয়। এই পিরথিবীটা মায়ের মতো। গভ্‌ভে রয়েছে গলানো পদার্থ। তার উপর পাঁচখানা থালার মতো পঞ্চ মহাদেশ ভাসতিছে। মা ধরিত্রীর পঞ্চ মহাদেশের সংসার ঝ্যানো পাঁচটি ছেলে। মায়ের মাসিক ধম্মো হয়, তখন এট্টু বিশ্রাম করতি মন চায়। সংসারটা সামলি দিতি পারেন না। থালায় থালায় ধাক্কা লাগে। ধাক্কা লাগলে থালা কাঁপে। একটা কাঁসার থালায় টোকা দিয়ে উপরে ক’টা মুড়ি ছড়ায়ে দিয়ি দেকিচি, মুড়িও কাঁপে।’

‘টেক্‌টনিক প্লেট শিফ্‌ট’-এর এই আশ্চর্য সরল ব্যাখ্যা অবাক করল। আরও অবাক হলাম, লোকটা যখন বলল, ‘থালার কাঁপন মুড়ির মতো আমি আগে আগে টের পাই স্যর, মা কালীর দিব্যি। ২৬ জানুয়ারি সকালে, রেডিয়োতে লালকেল্লার প্যারেড শোনাচ্ছিল, আমি কিন্তু ভোরবেলাতেই টের পেলাম। গা শিরশির, চোখের সামনে রসগোল্লা। শিবকাশীতে ভূমিকম্প হল দু’বছর আগে, ডেটটাও বলে দিচ্ছি, ২৮ তারিখ, মার্চ, রাতের বেলাই বুঝে গেছিলাম। তার পর মনে হল, গাংচেঙো-র মতো আমার একটা এস্‌পেশাল অঙ্গ আছে। গাংচেঙো বোঝেন স্যর? ভাঁটির দিকে কাদায় থাকে, গুলে মাছের মতো দেকতি, গুটলি গুটলি চোখ। নদীতে বড় স্টিমার আসার আগেই ওরা হুটোপাটি করি পাড়ের দিকি ধেয়ে আসে। আমিও স্যর, ট্রেন আসার দু’তিন মিনিট আগেই বুঝে যাই, বডি শিরশির করে। কিছু প্রাণী আছে শুনিচি, এস্‌পেশাল অঙ্গ আছে, সেই অঙ্গে কাঁপন বোঝে। চিন দেশে শুনিছি কী রকম গিরগিটি আছে, ভূমিকম্প আসার আগেই হুটোপুটি করে। আমি তো চিন দেশে যাইনি, গাংচেঙো দেকিচি। গাংচেঙোর অঙ্গ আমার বডিতে কোথাও লুকোনো আছে স্যর।’

বলি, ‘কী নাম? কী করেন?’ ‘কালোমণি সাঁপুই। পূর্বপুরুষের শেখানো কাজই করতি হয়। ধেনো। গুড়-ভাত চোলাই করি। কিন্তু স্যর, শুঁড়িখানাতেই লোকশিক্ষে হয়। কত রকমের লোক, কত কী শুনি। কিছু রাখতি হয়, কিছু ফেলতি হয়। তা বাদে কত রকমের বই পড়ি। কামাখ্যা তন্ত্র, কাক চরিত্র, জেনে রাখা ভাল... তবে একটা কথা জেনে রাখেন স্যর— মায়ের শরীল খারাপ হলেই মা বেসামাল। কখনও কখনও থালায় থালায় ঠোকাঠুকি হয়ে যায়। সেই কাঁপন মাটির তল থিকে উপরে আসতে টাইম লাগে, কিন্তু ঠোকাঠুকি হলেই আমি টের পাই স্যর। বলি কী, ভূমিকম্পের ডিপাটমেনে আমাকে নিতি বলেন, আমি আর গাংচেঙোরা মিলে ভুঁই কাঁপার আগেই বলে দেব।’

বলে ফেলেছিলাম— প্রমাণ চাই তো... ভূমিকম্পের আগেই ফোনে জানাবেন। মিলে গেলে হইহই পড়ে যাবে। তার ফোন পেলাম বছর খানেক পর। বলল, আসছে স্যর। আসেনি। আলিপুরে ফোন করে জানলাম কোথাও কিছু হয়নি। আবার গভীর রাত্রে আর এক বার। বকাবকি করলাম খুব। বললাম, আর কক্ষনও ফোন করবেন না। লোকটা বলল, ঠিক আছে স্যর, করব না, তবে মাসের শেষ দিকটা খেয়াল রাখবেন।

২০০৪ সালে ভূমিকম্প হল। সঙ্গে সুনামি। ২৬ ডিসেম্বর। সে দিন নেপালে। ২৫, ২৬ এপ্রিল। কিন্তু লোকটা হারিয়ে গেল।

robibasoriyo magazine magazine khana tollasi filmi dialogue sada kak naya sanglap
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy