Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

অন্য জন্মদিন

রিহ্যাব-এ পালন করা হয় নেশামুক্তির জন্মদিন। ড্রাগের নেশার টান সাংঘাতিক, তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারার তৃপ্তিও দারুণ।রিহ্যাব-এর দেওয়ালে আজ ঝুলছে বেলুন, যিশুর ছবিতে টুনি বাল্‌ব। টেবিলে রাখা বার্থডে কেক ঘিরে অনেকে দাঁড়িয়ে। পঁচিশ-ছাব্বিশের বিবেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন আজ। কেকের চারপাশে লাল-নীল মোমবাতি। কিন্তু মোমবাতির সংখ্যা মাত্র পাঁচ কেন? চঞ্চলদা রিহ্যাবের কর্মকর্তা। হাসলেন।

‘দম মারো দম’ ছবির একটি দৃশ্য

‘দম মারো দম’ ছবির একটি দৃশ্য

শাশ্বতী নন্দী
শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

রিহ্যাব-এর দেওয়ালে আজ ঝুলছে বেলুন, যিশুর ছবিতে টুনি বাল্‌ব। টেবিলে রাখা বার্থডে কেক ঘিরে অনেকে দাঁড়িয়ে। পঁচিশ-ছাব্বিশের বিবেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন আজ। কেকের চারপাশে লাল-নীল মোমবাতি। কিন্তু মোমবাতির সংখ্যা মাত্র পাঁচ কেন?
চঞ্চলদা রিহ্যাবের কর্মকর্তা। হাসলেন। বললেন, ‘পাঁচ বছর ধরে বিবেক নেশার বাইরে। তাই এটা নেশামুক্ত পাঁচ বছরের জন্মদিন। যে দিন থেকে আমরা নেশা ছেড়ে দিই, সে দিনটাই আমাদের নতুন জন্মদিন।’
বিবেক লেকটাউনের এক ধনী পরিবারের ছেলে। এক সময় ছিল কলকাতার নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। সেকেন্ড ইয়ারে উঠতেই ড্রাগের নেশায় ডুবে যায়। বাবা-মা প্রচণ্ড ভেঙে পড়েন। বাবা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে ভর্তিও হন নার্সিং হোমে। এক দিকে অসুস্থ স্বামী আর অন্য দিকে নেশায় চুর ছেলে নিয়ে মা পড়েন অকূল পাথারে। ছেলেকে নিয়ে গেলেন কাউন্সেলিং সেশনে। তেমন লাভ হল না। শুরু হল ছুটোছুটি। ডিটক্সিফিকেশন সেন্টার, রিহ্যাব, সঙ্গে মন্দির, মসজিদ, গির্জাতে ধর্না। বার তিনেক রিহ্যাব থেকে বেরিয়ে এসেও আবার নেশা ধরে ফেলল বিবেক। শেষমেশ এই রিহ্যাবে এসে, এখন সুস্থ।
অরিন্দমের বাবা-মা দুজনেই ডাক্তার। বেশ আধুনিকমনস্ক। ছেলেকে ‘স্পেস’ দেওয়ায় বিশ্বাসী। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করতেই অরিন্দমের পকেট-মানি জমা পড়ে যেত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। মদ নিয়ে বাড়িতে কারও শুচিবাই নেই। কিন্তু ড্রাগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তাতে যেন কৌতূহলটা আরও বেড়ে যায় ওর। ‘এক বার করে দেখাই যাক না জিনিসটা কী, জাস্ট অ্যান এক্সপেরিমেন্ট’, এবং ‘জীবনে সব কিছুরই এক্সপিরিয়েন্স থাকা ভাল’— ভেবে, সে এক দিন চলে গেল বন্ধুদের নেশার ঠেকে। যেহেতু টাকার ফ্লো ভালই ছিল তার কাছে, নেশাটা আর ছাড়া গেল না। এবং এ ব্যাপারে বিশেষ সহায়তা করল বন্ধুবর্গ। ‘এক বার শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে বসে আমরা নেশা করছি। চত্বরটা ভীষণ নোংরা। হিসি, গু, জঞ্জালের মধ্যে আমরা বসে আছি, কুকুরের দঙ্গল আবার তার মধ্যে খাবার খুঁটে বেড়াচ্ছে। অসহ্য দুর্গন্ধ, কিন্তু আমাদের হুঁশ নেই। মৌতাত পিক পয়েন্টে। হঠাৎ খুব কাছ থেকে একটা বাচ্চার কান্না শুনতে পেলাম। দেখি, ময়লার মধ্যে একটা প্লাস্টিকে জড়ানো বাচ্চা। একদম ছোট্ট। কান্নার শব্দে কুকুরগুলোও থমকে গেছে। কিন্তু আমরা তখন সম্পূর্ণ আউট। বাচ্চাটাকে যে উদ্ধার করতে হবে, তা নিয়েও কোনও হেলদোল নেই। খানিক ক্ষণ পর অবশ্য পুলিশের কাছে খবরটা পৌঁছে যেতে, তারা বাচ্চাটাকে নিয়ে গেল।’

রিপন স্ট্রিটের ইউনিস মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। উচ্চ মাধ্যমিকে অংক আর ফিজিক্সে লেটার পেয়ে নামী কলেজে চান্স পেয়েছিল। ছোট থেকেই খুব মুখচোরা। পাশের বেঞ্চে বসা লম্বা বিনুনি করা শ্যামলা রঙের মেয়েটিকে কত বার চিঠি লিখে প্রোপোজ করতে চেয়েছে, হয়ে ওঠেনি। ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ওকে বলল, ‘তোর এই লো-প্রোফাইল ভাবটাকেই তাড়াতে হবে। আমার সঙ্গে এক জায়গায় চল। দু-চার বার ধোঁয়া টানবি, ভেতর থেকে একটা কনফিডেন্স আসবে। তখন আর লাভ লেটারে আটকে থাকবি না। অনেক কদম এগিয়ে থাকবি।’

এগিয়ে কি যেতে পেরেছিলে?

উত্তরে ইউনিস ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। হাসিটা কান্নার চেয়েও করুণ। বলল, ‘নেশা করতে করতে এমন অবস্থা হল, প্রতিবেশীরা একঘরে করে দিল আমাদের। আত্মীয়স্বজন সম্পর্ক ছাড়ল। বাথরুমে ঢুকে জলের কল ছেড়ে মা কান্না চাপত। শুনতে শুনতে প্রতিজ্ঞা করতাম, যে ভাবেই হোক বেরিয়ে আসব। কিন্তু সেটা কয়েক ঘণ্টার প্রতিজ্ঞা মাত্র। নেশার বাইরে থাকলেই শরীরে অসহ্য কষ্ট শুরু হত। মনে হত একটা তেঁতুলবিছে সারা শরীরটায় হুল ফোটাচ্ছে। ঘাড়ে মাথায় খুব যন্ত্রণা। ছুটতে হত আবার নেশার ঠেকে। পয়সা হাতে না থাকলে ঘরের জিনিস বিক্রি করতাম, বাবার সই নকল করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতাম, এমনকী মন্দিরের সামনে খুলে রাখা ভক্তদের জুতো চুরি করেও বেচেছি।’

বেহালার প্রিয়ম বলল, অনেক সময় স্কুল-কলেজে ‘অড ওয়ান আউট’ হওয়ার ভয়েও কেউ কেউ নেশা করা শুরু করে। অর্থাৎ, নেশা করাটা ফ্রেন্ডস সার্কেলে একটা স্টেটাস সিম্বল। স্মার্টনেস।

অনেকের ধারণা, এই কম্পিটিশনের বাজারে, ইঁদুরদৌড়ের জমানায়, ড্রাগের নেশা করলে অনেকটা টেনশন রিলিজ হয়। সত্যি? দমদমের পলাশ পাল টানা দশ বছর ব্রাউন সুগারের নেশা করেছে, এখন তা কাটিয়ে একটা অফিসে লিফ্‌টম্যান। আমার প্রশ্ন শুনে হেসে বলল, ‘আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। আমার জীবনে কোনও ইঁদুরদৌড় ছিল না। তবে হ্যাঁ, নেশা করলে মনে হত শরীরে-মনে একটা জোশ এসেছে। দাদার কাছ থেকে ধার করা বাইকের পেছনে বান্ধবীকে চড়িয়ে সিগনাল ভেঙে একের পর এক রোড ক্রস করতাম। পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি চলত।’

সেই বান্ধবী এখনও টিকে আছে?

‘ধুর, নেশাখোর ছেলেকে কেউ বিয়ে করে?’

প্রীতমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নেশাটা কি মানুষ একাকিত্ব থেকে করে? প্রীতম বলল, ‘ওটা আমাদের ঢাল। অজুহাত। আমার বাবা তো কোন ভোরে বেরিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রাতে বাড়ি ফেরে। কিন্তু বাবার সঙ্গ পায় না বলে তো আমার মা-কে কখনও নেশার দ্বারস্থ হতে দেখিনি। বেশ তো সংসার সামলে, পাড়া বেড়িয়ে, কখনও পিএনপিসি করে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে।’

রিহ্যাবের কর্ণধার চঞ্চলদা এক সময় নিজেও অ্যাডিক্ট ছিলেন। কিন্তু নেশামুক্ত জীবনের স্বাদ পেয়ে তার মনে হয়েছিল, এই নিয়েই কাজ করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যাক।

জন্মদিনের কেক কাটার পর বিবেক শোনাল তার নিজের কথা। ‘এক দিন মনে হল আর টানা যাচ্ছে না। এ বার নিজেকে শেষ করে ফেললেই হয়।’ কিন্তু মা-বাবার গালে শুকিয়ে থাকা কান্নার দাগ বার বার চোখে ভেসে উঠছিল। তখনই ও ঠিক করে, পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে অন্তত একটা দিন ওঁদের কথা রাখবে। একটা গোটা দিন ড্রাগ ছাড়া থাকবে। প্রথমটায় অসম্ভব ঠেকলেও, কী ভাবে যেন সফল হয়ে গিয়েছিল কাজটায়। নেশা ছাড়া চব্বিশ ঘণ্টা! নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না। তখন মনে হল, তা হলে আর একটা দিন ট্রাই করা যাক। এ ভাবেই দিনের সংখ্যা বাড়তে লাগল।

বিবেক হাসছিল যুদ্ধ-জেতা সৈনিকের মতো। বলল, ‘জীবনের যেটুকু অপচয় হয়ে গেছে, তার জন্য দুঃখ করি না। এখনও তো পড়ে আছে অনেকখানি।’ অন্যদেরও পজিটিভ ভাবনাগুলো ওরই মতো। আমার মনে পড়ল, ২৬ জুন মাদক-বিরোধী দিবসে, রাসবিহারী মোড়ে একটা কিয়স্ক-এ প্রথম ওদের দেখেছিলাম। মাইকে কেউ কেউ বলছিল নিজের অ্যাডিকশনের কথা, তা থেকে বেরিয়ে আসার কথা। কেউ লিফলেট বিলি করছিল। তখনই মনে হয়েছিল, নিজের চেষ্টায় এমন একটা সর্বনাশের কবল থেকে বেরিয়ে এসে, এদের মধ্যে যেন একটা বাড়তি জোর এসেছে। কেকের পাশে মোমবাতির সংখ্যা বেড়ে চলবে বলেই মনে হয়।

saswati_sph@yahoo.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE