Advertisement
E-Paper

স্বাধীনতা তুমি...

রা গলে নিজেকে সামলাতে পারে না রত্না। প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে আরও দাউদাউ করে উঠল রাগ! দরজার কাছে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে ছবি, রমা, ছুটকি, চুমকি, শেফালীরা। সকলেই এ বাড়ির আশ্রিত। নারীত্ব আর পুরুষত্বের সীমাহীন দোলাচলে, এক অনিশ্চিত অস্তিত্বের শিকার।

সঞ্জয় দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

রা গলে নিজেকে সামলাতে পারে না রত্না। প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে আরও দাউদাউ করে উঠল রাগ! দরজার কাছে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে ছবি, রমা, ছুটকি, চুমকি, শেফালীরা। সকলেই এ বাড়ির আশ্রিত। নারীত্ব আর পুরুষত্বের সীমাহীন দোলাচলে, এক অনিশ্চিত অস্তিত্বের শিকার। সমাজের মূল ধারা থেকে নির্বাসিত ছিন্নমূল। রত্নাদির এই বাড়ি ছাড়া ওদের আর যাওয়ার কোনও জায়গা নেই! তাই কারওরই সাহস নেই এগনোর। ওর এই রুদ্রমূর্তি ওরা আগেও দেখেছে দু’এক বার।

‘কী রে? কথা না বললে আজ তোকে জুতিয়ে লাল করে দেব। বল কেন পালিয়ে এলি? গার্ড যখন ডাকল, গেলি না কেন?’

‘ডর লাগল, দিদি।’

বাকি সবাই রত্নাদি বলে ডাকলেও, সিলেট বরাবরই তাকে দিদি বলে। ছেলেবেলা থেকেই। বুলাকিদাই শিখিয়েছিল হয়তো।

‘ডর! কীসের ডর?’

‘আকেলা ছিলাম, দিদি। পাবলিক খেপে ছিল। কই সমঝলো না বুলাকিদার কী হল! চিত্তরঞ্জনে পুলিশ এল। হিজড়া পতা চললে মারত আমাকে। জানে মেরে দিত দিদি! বুলাকিদা...’

গলা ধরে এল সিলেটের। চোখের কোনায় চিকচিক করছে জল। যেমন দপ করে জ্বলে উঠেছিল রত্না, তেমনই ফস করে নিভে গেল রাগ। বুলাকিদার মৃত্যুতে সে যেমন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে ভিতরে ভিতরে, সিলেটও নিশ্চয়ই তাই। বুলাকিদাই তো কোলেপিঠে করে বড় করেছে ওকে!

গত রাতে অবিন্যস্ত, ধূসরিত অবস্থায় যখন বাড়িতে এসে ঢুকেছিল, তখন ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাসই করতে পারেনি রত্না। শুধুই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল ছেলেটা। ওর অসংলগ্ন কথাবার্তা থেকে ঘটনাটা বুঝে উঠতে সময় লেগেছিল রত্নার। বুঝতে যখন পারল, তার পর সারা রাত ঘুমোতে পারেনি সে!

ভাইয়ের অসুখের খবর পেয়ে পটনায় গিয়েছিল বুলাকিদা। ভাইয়ের সংসার ও-ই টানত। আর ফিরবে না লোকটা! বুলাকিদা, বুলাকিলাল!

‘আরে খোকা, রো রহে হ্যায় কিঁউ? কাঁনছো কেন?’

কত দিন আগেকার কথা! একহারা লম্বা মানুষটা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রত্নার কাঁধে একটা শীর্ণকায় হাতের কোমল স্পর্শ।

‘হারিয়ে গেলে না কি? বাড়ি কোথায় আছে তোমার?’

‘বাড়ি নেই আমার, বাড়ি নেই গো,’ বলে হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিল অনাহার-বিধ্বস্ত বালক।

হ্যাঁ, তখনও তো বালকই সে!

তার গলার স্বরের আর্তিতে, হঠাৎ কেঁদে ফেলার অতর্কিত বিষণ্ণতায়, কিছু একটা বুঝতে পেরেছিল বোধহয় বুলাকিদা।

‘খুধা লেগেছে তোমার? হামার কাছে মুড়ি আছে, খাবে?’

কাঁধের ঝোলা খুলে মুড়ির প্যাকেট আর জলের বোতলটা যখন বার করছিল বুলাকিদা, রতনের মনে হয়েছিল, এ লোকটা দেবদূত!

এত দিন খাওয়া জোটেনি তা নয়, কিন্তু পেট ভরে খাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনি। জল খেয়ে পেট ভরিয়েছে। বহু দিন পর তাকে পেট ভরে খাওয়াল কেউ। একটু একটু করে তাকে শান্ত করেছিল বুলাকিলাল।

মানুষটার কথা বলার ধরনটাই ছিল আন্তরিক। মিষ্টি একটা হিন্দি-ভাঙা বাংলা, মৃদু স্বর, গলায় কোমলতার স্পর্শ।

‘বাড়ি না আছে, কিন্তু কুথাও থেকে তো আসছ! কুথা থেকে আসছ তুমি বাবা?’

‘কৃষ্ণনগর।’

কৃষ্ণনগর! তার শৈশব, কৈশোরের ঘূর্ণী! এঁটেল মাটি, ভিজে মাটি। নানা ধরনের, নানা রঙের পুতুল। জলঙ্গি নদীর এ পাড় ও পাড়! ভরা বর্ষার জল-টলটলে জলঙ্গি, খাঁ-খাঁ বৈশাখের শীর্ণতোয়া জলঙ্গি, শরৎ-হেমন্তর মিঠে হাওয়ার জলঙ্গি। এখনও ছবির মতো মনে পড়ে। চোখ বুজলে জলঙ্গির ভিজে হাওয়ার স্পর্শ পায় আজও, এত দিন পরেও।

সেই যে তেরো বছর বয়সে কৃষ্ণনগর থেকে ট্রেনে উঠে বসেছিল, তার পর ফিরে গিয়েছিল এক রাতের জন্য— তখন তার বয়স পঁচিশ। মনে তখনও দগদগে ক্ষোভ। হাতে প্রচুর টাকা! বাড়ি ছেড়েছিল বারো বছর বয়সের এক দিশেহারা কিশোর। ফিরেছিল এক পূর্ণ যুবতী, সালঙ্কারা, সুন্দরী!

প্রথমে তো চিনতেই পারেনি মা-বাবা। চিনতে চায়ওনি হয়তো। কিন্তু ব্যাগ থেকে টাকা বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই পরিবেশ বদলে গিয়েছিল।

কোনও দিন সাংঘাতিক বড়লোক ছিল না রত্নারা। সচ্ছল ছিল না, তবে অভাব-অনটনও তেমন ছিল না তাদের। রত্নার বাবা ছিল মৃৎশিল্পী। বংশপরম্পরায় কুমোর। কত পুরুষ, কেউ জানত না। হিসেব রাখার প্রয়োজনও কেউ বোধ করেনি কোনও দিন। রত্না বড় হয়েছে কৃষ্ণনগরের পুতুলপট্টিতে। জলঙ্গি নদীর তীরে, বহু কালের ওই পাড়াটার নাম ঘূর্ণী। রত্না অবশ্য তখন রত্না ছিল না। তার নামটা তো বদলে দিয়েছিল বুলাকিলাল। বাড়িতে তার নাম ছিল রতন। ফুটফুটে ছেলে, তিন ভাই-বোনের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে বড়। তার দু’বছরের ছোট বোন, পুতুল। আর এক্কেবারে ছোট্ট একটা ভাই গুবলু, দেড় বছর বয়সেই যে ভীষণ দুরন্ত।

বাবা হারান— হারানচন্দ্র পাল— মাটির কাজ করত। সারা বছর ধরে বানাত মাটির সরা, কলসি, ভাঁড়, আর নানা ধরনের নানা চেহারার মাটির পুতুল। পুজো-পার্বণে দেবদেবীর মূর্তি— জগদ্ধাত্রী, সরস্বতী, কালী। বছরে একটা বাঁধা পুজোয় দুর্গাঠাকুরের মূর্তি। সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ। মা দুর্গার সিংহ, দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে থাকা মহিষাসুর। তার পর গণেশের ইঁদুর, মা লক্ষ্মীর পেঁচা, কার্তিকের ময়ূর। অনেক কাজ। শ্রাবণ মাসের শেষ দিক থেকে কাঠামো বাঁধা শুরু করতে হত। দুর্গাঠাকুর তৈরির কাজটা দারুণ লাগত রতনের। বাবার সঙ্গে থাকত নব, রতনের খুড়তুতো দাদা। নব’র বাবা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল, রতনের জন্মের আগেই।

রতনকেও একটু একটু করে কাজ শেখাতে আরম্ভ করেছিল বাবা। মাটি কী ভাবে তৈরি করতে হয়। বেশি শক্ত হলে এঁটেল মাটিতে কাজ হবে না। বেশি নরম হলেও নয়। সে সব কী ভাবে বুঝতে হয়। মাটি থেকে কাঁকর, বালি কী ভাবে বার করে নিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হয় মাটি। কাজটা ভাল লাগত রতনের। যে কোনও নতুন বিষয়, চট করে ধরে নিতে পারার একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল তার। সে হাতের কাজই হোক বা মাথার। তাই ইস্কুলেও সে খুব ভাল ছাত্র ছিল। দিদিমণি বলতেন, অঙ্ক আর ইংরেজিতে খুব পরিষ্কার মাথা তার। এক বারের বেশি দু’বার বোঝাতে হয় না। আর বাংলা তো তার নিজের ভাষা। যে ছেলে ইংরেজি ধরে ফেলছে চটপট, সে তো বাংলায় ভাল করবেই! এই সব কারণে ছোটবেলায় বাড়িতে, ইস্কুলে খুব আদর ছিল রতনের। পাড়াতেও ভাল ছেলে বলে সুনাম ছিল।

গোলমালটা শুরু হল আট-ন’বছর বয়স হওয়ার পর। পাড়ার ছেলেরা, ইস্কুলের বন্ধুরা, রতনকে খেপাতে শুরু করল তার মেয়েলি হাবভাবের জন্য। বাড়িতে প্রথম প্রথম কোনও সমস্যা হয়নি। মা খুব একটা পাত্তা দেয়নি বিষয়টা। কিন্তু একটু একটু করে মায়ের চোখেও ধরা পড়তে লাগল রতনের অদ্ভুত হাবভাব। নব আর তার দিদি বকুল রতনদের বাড়িতেই থাকত। বিধবা কাকিমাও থাকতেন তাদের সঙ্গে।

বকুলকে রতন ডাকে দি’ভাই বলে। অনেকটাই বড় বকুল, রতনের থেকে। পনেরো পার হয়ে ষোলোয় পড়বে। মাঝে মাঝেই হারান বলে, এ বার তার বিয়ের জন্য পাত্রের খোঁজ শুরু করতে হবে। রতন প্রায়ই বকুলের জিনিস ঘাঁটে। বিশেষ করে বকুলের চুলের ফিতে, সস্তার পাউডার, কাঁচপোকার টিপ, এ সবের দিকে খুব নজর তার। মাঝে মাঝেই বকুলের ফ্রক পরে ফেলে। বাড়ির সবাই হাসাহাসি করে তাই দেখে।

‘তোর মেয়ে হওয়ার এত শখ কেন রে?’

এক দিন বকুল ধমকেছিল তাকে দেখে। পাড়ায় বেরিয়েছিল দি’ভাই। ফিরে এসে দেখে, তার স্নো, পাউডার মেখে আয়নায় নিজেকে দেখছে রতন। ঠোঁটে লিপস্টিক। কপালে টিপ। বকুল সবাইকে ডেকে ডেকে জড়ো করেছিল সে দিন। সবাই হেসেছিল তাকে দেখে। শুধু কাকিমা রতনের থুতনি ধরে একটু আদর করে মা’কে বলেছিল, ‘কী সুন্দর দেখতে লাগছে দেখেছ বড়দি? তুই মেয়ে হয়ে জন্মালি না কেন রে?’

এই কাকিমাই আর একটা জিনিস লক্ষ করেছিল এক দিন। মা’কে বলেওছিল কথাটা রতনের সামনেই। মা তেমন পাত্তা দেয়নি। সে দিন জলঙ্গির ঘাটে কাকিমার সঙ্গে স্নান করতে গিয়েছিল রতন। ইস্কুল ছুটি থাকলে কাকিমা প্রায়ই তাকে নিয়ে যেত সঙ্গে করে। ডাঁই করা বাসি কাপড় নিয়ে ঘাটে বসত, কাপড় কেচে, নিজে স্নান করে, রতনকে স্নান করিয়ে বাড়ি ফিরত। নিজে বয়ে আনত দু’বালতি কাচা কাপড়, রতনের হাতে দিত একটা ছোট বালতি।

সে দিন একটু একটু মেঘ করেছে। ঘাটে তারা দুজন ছাড়া লোক নেই। কাকিমার হাতে জামাকাপড়ের স্তূপ অন্যান্য দিনের মতো ভারী না। অল্প সময়েই কাপড়চোপড় সাবান-কাচা করা হয়ে গেল। এ বার স্নানের পালা। রতন জানে, আগে কাকিমা তাকে স্নান করাবে, গায়ে হাতে পা’য় ভাল করে সাবান ঘষে। স্নানের জন্য আলাদা সাবান কেনার পয়সা তাদের নেই, কাপড় কাচার লম্বামত নীল সাবানটাই তার গায়ে ঘষবে কাকিমা। নিজেও ওটা দিয়েই স্নান করবে।

‘আমার হিসি পেয়েছে,’ কথাটা শুনে থমকে গেল কাকিমা। রতনকে খুব ভালবাসত কাকিমা। ছোটবেলা থেকে কাকিমাই শিখিয়েছিল, এই নদী পবিত্র। জলঙ্গি গঙ্গার শাখা নদী। নদীতে নামার আগে প্রাকৃতিক কাজকর্ম সেরে নিতে হবে। জলঙ্গিকে কলুষিত করতে নেই। ঘাটে এসে হিসি পেলে একটু দূরে গাছগাছালির আড়ালে যেখানে একটু আগাছা ভরা জঙ্গল, সেখানে ঝোপের আড়ালে গিয়ে করে আসতে বলত কাকিমা। কিন্তু সে দিন সাবান মাখানো হয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় দূরে পাঠানো যায় না। ফাঁকা ঘাটে এদিক-ওদিক দেখে নিয়েছিল কাকিমা।

‘আগে বলতে পারলি না, ঢ্যামনা? যাক, এখানেই সেরে নে।’

হিসি করতে গিয়ে রতন দেখেছিল, হঠাৎ চোখ সরু করে কী যেন লক্ষ করছে কাকিমা। সে দিন বাড়ি ফিরেই মা’কে বলেছিল, ‘জানো বড়দি, আজ একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করলাম। রতন ব্যাটাছেলেদের মতো দূরে পেচ্ছাপ ফেলতে পারে না! পা দিয়ে গড়িয়ে পড়ে।’

‘কী যে বলো যা তা! কথার কোনও মাথামুন্ডু নেই তোমার।’ মা মুখঝামটা দিয়ে উঠেছিল, ‘বলি এতখানি বেলা হল, ভাত চাপানো হয়নি, সে খেয়াল আছে? আজ আবার রোববার। উনি এই এলেন বলে! আমার হয়েছে যত জ্বালা...’ গজগজ করতে করতে উঠোন পেরিয়ে দাওয়ায় উঠে গিয়েছিল মা। কাকিমাও মা’র মেজাজ দেখে দ্রুতপায়ে হাতের ভিজে কাপড় মেলে দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছিল।

রতন তো বরাবরই জানে, সে অন্য ছেলেদের মতো হিসি করতে পারে না! তার পা দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। সে যখন ক্লাস টু’তে, তখন থেকেই তো সে জানে। শিবেন আর পল্টু এক বার দেখে ফেলেছিল। ইস্কুল থেকে ফেরার পথে একটা নির্জন মাঠ পড়ত। মাঠের এক পাশ ঘেঁষে লম্বা হয়ে চলে গেছে বাঁধানো নর্দমা। সেই নর্দমায় লাইন দিয়ে হিসি করতে দাঁড়িয়েছিল তারা। শিবেন নিজের হিসিটা তাক করে ফেলেছিল নর্দমার একেবারে ওই দিকে। শিবেনের দেখাদেখি পল্টুও। শুধু সে পারেনি। তার হিসি অত দূরে যায় না। পা দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। সে তড়িঘড়ি পা মুছে ফেলে। পল্টু আর শিবেন তাকে অনেক দিন খেপিয়েছিল তার পর!

সেই থেকেই রতন আর কখনও বন্ধুদের সঙ্গে হিসি করতে দাঁড়ায় না। হিসি পেলে এদিক-ওদিক দেখে এমন আড়াল খুঁজে নেয়, যেখানে কেউ নেই! শুধু সে আর প্রকৃতি। তবে কাকিমার সামনেও যে হিসি করা যাবে না, এটা ভাবেনি সে। শিবেন আর পল্টুর মতো কাকিমাও তার নামে বলল! এ রকম কেউ বলে? খুব অভিমান হয়েছিল রতনের। আর কখনও সে কাকিমাকে কিছু বলবে না!

বলেওনি রতন। শুধু কাকিমাকে কেন? কাউকেই না। মা’কে না। দি’ভাইকে না। বাবাকে বলার তো প্রশ্নই নেই! এমনকী রন্টুকেও না। রন্টু পাড়ার ছেলে। তার প্রাণের বন্ধু। রতনদের দু’তিনটে বাড়ির পরেই ওদের বাড়ি। একই ক্লাসে পড়ে তারা। একসঙ্গে ইস্কুলে যায়। রন্টু লেখাপড়ায় রতনের মতো অতটা দড় নয়। প্রায়ই সে পড়া বুঝে নেয় রতনের কাছে। অনেক কথা হয় তাদের। অনেক খেলা। জলঙ্গির ঢেউয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার, পাড়া-বেপাড়ায় ঘুরে বেড়ানো, এ গলি-ও গলি দৌড়ে বেড়ানো কাটা ঘুড়ির সন্ধানে। কিন্তু রন্টুকেও সে বলেনি কখনও।

একটু একটু করে বড় হয়েছে রতন। একটু একটু করে নিজের মোহময় আর্তিগুলো সংগোপনে নিজের মধ্যে রাখতে শিখেছে। দি’ভাইয়ের অন্তর্বাস পরে দেখার তীব্র আর্তি! সবার অলক্ষে, শুধু নিজেকে আর আয়নাকে সাক্ষী রেখে। জানতে পারলে তো মেরে ফেলবে দি’ভাই। ক’দিন ধরেই বুকে তীব্র ব্যথা রতনের। কাউকে বলেনি! যত দিন গেছে, মাঝে মাঝে নিরালা প্রহরে নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়েছে রতন। বুকের দু’দিকে উচ্চাবচ দেহরেখা খুব প্রকট আকারে না হলেও স্পষ্টতই উপস্থিত। তখন দি’ভাই-এর ব্রা পরে কী আরাম! কেউ ঘুণাক্ষরেও জানত না। সে নিজেও খুব বেশি ভাবেনি ব্যাপারটা নিয়ে। শুধু কারও সামনে আর জামা ছাড়ত না। জামাপ্যান্ট বদলাতে হলে আড়াল খুঁজে নিত। বাড়ির লোকের চোখেও সেটাই তো স্বাভাবিক। বারোয় তো পড়েছে রতন! ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছে। পরের বছর সেভেন থেকে এইটে ওঠার পরীক্ষাতেও ফার্স্ট!

আর সেই রেজাল্ট নিয়ে যে দিন বাড়ি এল, সে দিন থেকেই জ্বরে পড়ল সে। প্রথম কিছু দিন কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। শীতকাল, জ্বর হয়েছে, সেরে যাবে। কিছু দিন শুয়ে থাকুক না। কিন্তু জ্বর কমে না কিছুতেই। চার দিন পর, জ্বরের ঘোরে যখন ভুল বকতে শুরু করেছে রতন, তখন বাবা পাড়ার হোমিয়োপ্যাথ ডাক্তার শিবনাথবাবুকে ডেকে নিয়ে এল। তাও মায়ের জোরাজুরিতে। শিবনাথ বাঁড়ুজ্যে অভিজ্ঞ ডাক্তার। বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কালো, শীর্ণকায়। চোখে পুরু কাচের চশমা। মাথার সামনের দিকে প্রশস্ত টাক। মুখ সর্বদা চলছে। পান-সুপুরি, খয়েরের রঙে ঠোঁট লাল।

‘আমি তো ভাল বুঝছি না, হারান। তুমি বরং কাল ওকে এক বার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাও।’ রোগীর পাশে বসে চোখ, জিভ, গলা দেখার পর আর বেশি সময় নষ্ট করলেন না শিবনাথবাবু।

‘ক’দিন ভুগছিস রে? অ্যাঁ, চার দিন জ্বর? না, কাজটা ভাল করোনি হে তোমরা। আগেই দেখানো উচিত ছিল। শুধু শুধু ক’দিন কষ্ট পেল বেচারা!’

‘কী হয়েছে ডাক্তারবাবু?’

‘মনে হচ্ছে পক্স, তবে ধরনটা ভাল মনে হচ্ছে না। স্মল পক্স তো আজকাল হয় না বলেই শুনি। উঠে গেছে নাকি দেশ থেকে! তুমি কাল ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। এখন আমি একটা ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি, তাতে জ্বরটা ধরবে।’

গুটিবসন্ত হয়নি রতনের। হয়েছিল চিকেন পক্স, জলবসন্ত। কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি রকমের। সদর হাসপাতালে এক জন মহিলা ডাক্তার রতনের অবস্থা দেখে তাকে আর বাড়িতে ফেরত পাঠাননি। একটা খালি বেডে ভর্তি করে নিয়েছিলেন। ছোঁয়াচে রোগের জন্য দোতলায় আলাদা ওয়ার্ড। সেখানেই বারো দিন ছিল রতন। মা, বাবা রোজ দেখতে আসত বিকেলবেলা। সঙ্গে কখনও দি’ভাই, কখনও কাকিমা। নবদাও এসেছে দু’এক দিন।

• (ক্রমশ) •

Mystery Novel
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy