Advertisement
E-Paper

সুবর্ণপত্তনে গরম এক বাটি মোহিঙ্গা

কলকাতার আশেপাশে আজও আছে কয়েকটি বর্মা কলোনি। শহুরে মূলস্রোতে মিশে গিয়েছেন সেখানকার মানুষ। রেস্তরাঁয় বর্মি খাবার শুধু মনে করিয়ে দেয় অতীতের স্মৃতি। অমিতাভ পুরকায়স্থ ক্রিস্টোফার বেলি ও টিম হার্পার রচিত ‘ফরগটেন আর্মিজ়’ বই থেকে নেওয়া অংশটুকু বাংলা অনুবাদে এমনটাই দাঁড়ায়।

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৯ ০০:০৫
সুবর্ণপত্তন-এর প্রবেশ তোরণ।

সুবর্ণপত্তন-এর প্রবেশ তোরণ।

স্মরণাতীত কালের মধ্যে অসমের প্রজাপতিরা অত সুন্দর হয়নি। পথের দুধারে বিক্ষিপ্ত মৃতদেহের থেকে পুষ্টি আহরণ করে তারা উজ্জ্বল নানান বর্ণের ছটায় ভরিয়ে তুলেছিল মৃত্যু উপত্যকা। পোর্টারেরা সেই সব মৃতদেহ ছুঁত না। তাই পথের ধারেই অসংখ্য প্রজাপতি ঘিরে থাকত ইতস্তত পড়ে থাকা নারী পুরুষ ও শিশুদের শব, যত ক্ষণ না মেডিকেল স্টাফেরা এসে কেরোসিন দিয়ে জ্বালিয়ে সেগুলির সদ্গতির ব্যবস্থা করতেন...।’

ক্রিস্টোফার বেলি ও টিম হার্পার রচিত ‘ফরগটেন আর্মিজ়’ বই থেকে নেওয়া অংশটুকু বাংলা অনুবাদে এমনটাই দাঁড়ায়। আসলে এর মধ্যে ধরা আছে জাপানি আক্রমণের মুখে বর্মা (এখনকার মায়ানমার)থেকে বিতাড়িত ভারতীয় শেকড়ের মানুষদের দেশে ফিরে আসার যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতার বয়ান। ভয়ঙ্কর সেই যাত্রাপথের কথা ছড়িয়ে আছে আরও নানা লেখায়। জাপানি আক্রমণের সামনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রজাদের নিরাপত্তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভারতে ফিরিয়ে নেওয়ার এই প্রক্রিয়া আসলে পরিণত হয়েছিল এক মৃত্যুমিছিলে। তা সত্ত্বেও ইতিহাসের এই অধ্যায়টি নিয়ে বেশি আলোচনা হয়নি। যেমন আলোচনা হয়নি স্বাধীনতার পরেও দু-তিন দশক ধরে বর্মা থেকে ফিরে আসা ভারতীয়দের হালহকিকত নিয়ে, অথবা ভারত নামের দেশটার মূলধারায় তাঁদের নিজেদের অস্তিত্বকে মিশিয়ে দেওয়ার সংগ্রাম নিয়ে।

বিশ্বযুদ্ধের সেই বিভীষিকা কাটিয়েও তৎকালীন বর্মায় থেকে গিয়েছিলেন অনেক ভারতীয়। প্রায় তিন-চার পুরুষের বাস যে দেশে, সেখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে আসা তো সহজ নয়। তাঁদের কারও কারও পূর্বপুরুষ উনিশ শতকের গোড়া থেকেই বর্মার অধিবাসী। ঊনবিংশ শতকের গোড়া থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিজস্ব প্রয়োজনে নানা পেশার ভারতীয়দের বর্মায় আসতে উৎসাহিত করা হয়। বিহার, যুক্তপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, মাদ্রাজ, অবিভক্ত বাংলা ইত্যাদি জায়গা থেকে দলে দলে আসতে থাকেন ভারতীয়রা। কাজও জুটে যায়— খেতখামারে বা বন্দরে। ছোট ছোট ব্যবসা করার সুযোগও মেলে। এ ছাড়া ঔপনিবেশিক প্রশাসনের কাজেও যোগ্যতা অনুসারে নিয়োগ করা হতে থাকে ভারতীয়দের।

বর্মি খাবার মোহিঙ্গা

তবে বর্মার স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী অধ্যায়ে জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থানের ফলে ভারতীয়দের জীবন ধারণের সুযোগসুবিধাগুলো ক্রমশ সঙ্কুচিত হতে থাকে। স্থানীয় মানুষ ভারতীয়দের দেখতে শুরু করেন সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অংশ হিসাবেই। তাঁদের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ভারতীয় পরিচালনাধীন ব্যবসায়িক সংস্থার রাষ্ট্রীয়করণ ঘটে। প্রশাসনিক কাজে সুযোগের ইতিও সেই নীতি থেকেই। ফলে নিরাপত্তার অভাবে আর আর্থ-সামাজিক দিক থেকে ক্রমে কোণঠাসা হয়ে পড়ে ফের শুরু হয় তাঁদের ভারতে প্রত্যাগমন। ১৯৬২ সালে বর্মায় সামরিক সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তো ভারতীয়দের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে। এর পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারের উদ্যোগে বর্মা-প্রত্যাগত ভারতীয়দের নিয়ে একের পর এক জাহাজ আর প্লেন ভিড়তে থাকে কলকাতা, মাদ্রাজ, বিশাখাপত্তনম শহরে। সব হারিয়ে আবার ‘নতুন’ দেশে নতুন করে জীবন যাপনের সংগ্রাম শুরু হয়।

সাধারণ ভাবে এই ফিরে আসা নিয়ে তেমন আলোচনা না হলেও, সারা ভারতের বিভিন্ন শহর ও শহরতলিতে ‘বর্মা কলোনি’, ‘বর্মা বাজার’, ‘বর্মা নগর’ প্রভৃতি নামের জায়গাগুলি কিন্তু সত্তরের দশক পর্যন্ত বর্মা থেকে ফিরে আসা ভারতীয়দের এই ভুলে যাওয়া গল্পটাই নিঃশব্দে শুনিয়ে যায় এখনও।

দু’পাশে দুই ভূখণ্ড, মধ্যিখানে শুধু নাফ নামে নদীটি। তুলনামূলক সহজ যোগাযোগ হেতু বিশেষত অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ সহজেই বর্মায় আসতেন রোজগারের আশায়। কিন্তু ভারতীয় বিতাড়নের জোয়ারে সেই জনসমষ্টির বাঙালি অংশকে ফিরে আসতে হল ভারতে— পশ্চিমবঙ্গে। যে ভাবে তামিল, বিহারি, উত্তরপ্রদেশীয় শেকড়ের মানুষদের পাঠানো হয় তাদের ভাষাভিত্তিক রাজ্যে। আর এই ভাবেই কলকাতা শহর বা তার উপকণ্ঠে খিদিরপুর, কামারহাটি, বারাসতের মতো এলাকায় কয়েকশো ‘ঘর’-ছাড়া বাঙালি গড়ে তোলেন বেশ কয়েকটি বর্মা কলোনি।

প্রথমে অস্থায়ী ক্যাম্প। সেখান থেকে সামান্য সরকারি সাহায্য আর অনেকটা মনের জোর সম্বল করে শুরু হল নতুন জীবনসংগ্রাম। সত্তরের দশকের শেষ পর্যন্ত অনেকে জমি পেয়েছেন বারাসত সদরের কিছুটা দূরে। সেখানেই তারা গড়ে তুললেন নিজেদের উপনিবেশ। যার পোশাকি নাম হল ‘সুবর্ণপত্তন’।

আজকাল অবশ্য বর্মা কলোনি বললে বাসের কন্ডাক্টররাও অনেক সময় বুঝতে পারেন না। বেশি চলে সুবর্ণপত্তন নামটাই। সেটাও হয়তো মূলধারায় অঙ্গীভূত হয়ে যাওয়ার আর এক লক্ষণ। অধিবাসীদের পুরনো বর্মি সাং‌স্কৃতিক পরিচয় অনেকটাই মুছে গিয়েছে আজ। কিছুটা পারিপার্শ্বিক চাপে, কিছুটা হয়তো স্বেচ্ছায়।

আজ থেকে বছর দশেক আগেও টাকি রোডে বাস স্টপে পর পর অনেকগুলো বর্মি খাবারের দোকান ছিল। রাস্তার দোকানে বসে অনেকেই ‘মোহিঙ্গা’ আর ‘খাওসোয়ে’ খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে বর্মি ভাষায় আলাপ চালাতেন। কিন্তু আজ সুবর্ণপত্তনে বর্মি ভাষা বলার মতো মানুষ হাতে গোনা। দু’-চারটি দোকান বাদে বর্মি খাবারও নিরুদ্দেশ।

তবু কোনও শ্রাবণী বিকেলে সুবর্ণপত্তনের রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে চোখে পড়বে একটা প্রাইমারি স্কুল, যেখান থেকে যাত্রা শুরু করে এই উপনিবেশের অনেকে নিজেদের সামাজিক অবস্থার উন্নতি করেছেন। সেই উন্নতির পরিচায়ক দোতলা, তিনতলা বাড়ি। তার মধ্যেই দেখা যাবে সেই গোড়ার দিকের সরকারি সাহায্যে তৈরি কয়েকটা একতলা বাড়ি, মাথায় এখনও ঢালাই পড়েনি। দেবী চট্টেশ্বরীর নামে প্রতিষ্ঠিত সুন্দর কালীমন্দিরের ফলকটিও ফিরিয়ে আনবে তাঁদের আদি বাসভূমি, সুদূর চট্টগ্রামের স্মৃতি।

ঘুরতে ঘুরতেই হয়তো দেখা যাবে, সন্ধে হলে কোনও বাড়ির নীচে খুলে যাচ্ছে বর্মি খাবারের দোকান। বসতবাড়ির সামনের ঘরটাই খাওয়ার জায়গা, ওটাই রান্নাঘর। খাদ্য তালিকার দিকে চোখ বুলিয়েই প্রথমে মনে হবে, কই, গন্ধের জন্য কুখ্যাত বর্মার ‘ঙাপ্পি’ তো নেই! তবে তার পরিবর্তে আর যে পদগুলো আছে, সেই বা কম কী?

গৃহকর্ত্রী নিজেই দু’হাতে সামলাচ্ছেন রান্না, পরিবেশন আর ক্যাশবাক্স। অতিথির সঙ্গে গল্প করতে করতেই তৈরি করে দিচ্ছেন গরম গরম মোহিঙ্গা। সুস্বাদু এই বর্মি খাবারের রেসিপিটাও বলাই যায় একটু। গ্যাসের বার্নারে ফুটছে মাছের স্যুপ। সেই ফুটন্ত মাছের স্যুপ আর নুডল দিয়ে তৈরি এই পদটি বর্মার প্রায় জাতীয় খাবার বলা যায়। তার মধ্যে দেওয়া হয় ছোলাসেদ্ধ, পেঁয়াজ, শশাকুচি। সেদ্ধ ডিম টুকরো করে উপরে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয় অতিথির সামনে। নিজের পছন্দ অনুযায়ী টক আর ঝাল মিশিয়ে খেতে শুরু করে দেওয়াটা সময়ের অপেক্ষা।

গল্প চলতে থাকে। আসলে এই মোহিঙ্গা বানানোর স্যুপ তৈরি করা উচিত মাগুর মাছ দিয়েই। কিন্তু সে ক্ষেত্রে খাবারের দামটাও বাড়াতে হয়। আর তাতে ক্রেতা পাওয়াটা মুশকিল হয়ে যায়। এ ছাড়াও অনেক উপাদান যোগ করা যায় স্বাদ বাড়াতে। যেমন এক ধরনের কলার থোড়। সেই থোড় মোহিঙ্গাতে মেশালে স্বাদ আরও খোলতাই হয়। তবে ও সব পাওয়াও ঝামেলা, আবার দামও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এই একই খাবার যখন

ঝাঁ-চকচকে রেস্তরাঁয় দেওয়া হবে, তখন তার দাম বেড়ে যায় বহু গুণ। কিন্তু স্বাদ কি একই হয়? প্রশ্নটা সহজ, উত্তরও তো জানা।

খাওসোয়ে তৈরির জন্য ফুটন্ত নারকেলের দুধ নাড়তে নাড়তে গল্প চলতে থাকে। স্থানীয় মানুষই এই দোকানের মূল ক্রেতা। সারা দিন ঘরের কাজ সামলানোর পর সন্ধের সময় দোকান খোলা হয়। সপ্তাহের অন্য দিন একটু কম থাকলেও, শনি-রবিবার বেশ ভালই সমাগম হয় খাদ্যরসিক মানুষের। প্রচারের কোনও ব্যবস্থা নেই, মুখের কথাই ভরসা। তা শুনেই শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকে চলে আসেন ‘আসল’ বর্মি খাবারের স্বাদ পেতে।

আগে এখানকার স্থানীয় মানুষের মধ্যে এই বর্মি খাবারের প্রচুর চাহিদা ছিল। তাই দোকানে সংখ্যাও ছিল বেশি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের খাদ্যরুচিরও পরিবর্তন হয়েছে। তেলেভাজা, চাইনিজ় আর মোগলাই খাবারের দোকান সংখ্যায় অনেক বেড়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে বর্মি খাবারের দোকান। রাস্তার ধারে যে দু-একটি দোকান আছে, তাদের মেনুতেও মিশে গিয়েছে স্থানীয় খাদ্যাভ্যাসের প্রভাব। ফুলুরি, পেঁয়াজিও পড়ছে বর্মি খাবারের মধ্যে!

এখানে শেষ পাতে কোনও মিষ্টি জাতীয় পদের আয়োজন নেই। বস্তুত বর্মি পদের সম্ভারে মিষ্টির দেখা প্রায় পাওয়া যায় না বললেই চলে। যা মিষ্টি পাওয়া যায়, সবই প্রায় চিনা প্রভাবিত। বাঙালিদের মধ্যে বর্মি খাবার তেমন জনপ্রিয় না হওয়ার কারণ এই মিষ্টিহীনতা— হলেও

হতে পারে।

ফেরার পথে সুবর্ণপত্তনের মূল তোরণ ছাড়িয়ে টাকি রোডে উঠলেই হরেক যানবাহন আর দোকান-বাজারের ব্যস্ততা আছড়ে পড়ে মহানাগরিক জীবনে। এই ভিড় আর হট্টগোলের মধ্যে পুরনো বর্মা কলোনিকে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়তো মনে পড়তে পারে বর্মি প্যাগোডার কথা। সেই কবে লর্ড ডালহৌসি বর্মা থেকে জাহাজে করে নিয়ে এসেছিলেন; মাঝে তার অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গেলেও, এখন সুন্দর ভাবে সংস্কার করে, সযত্নে তাকে রাখা রয়েছে ইডেন উদ্যানে। ‘বর্মা কলোনি’র সংস্কৃতিটাকেও কি এমন করেই সংরক্ষণ করা যেত না? সতিই তা করা গেলে আমাদের শহরের সাংস্কৃতিক ক্যালেইডোস্কোপটা হয়ে উঠত আরও বর্ণময়, বৈচিত্রমুখর। দেখা যেত, দুঃখ আর শোকের

সঙ্গে লড়াইয়ের মধ্যেও জীবনের অনুপম রং চয়ন করেছিলেন এখানকার মানুষ। ঠিক সেই রঙিন প্রজাপতিদের মতোই।

কৃতজ্ঞতা: সুশীল সাহা

Burmese Kolkata
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy