তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
উত্তমকুমারের লিপে ‘মর্যাদা’ ছবিতে তাঁর প্লেব্যাক কার্যত ইতিহাস। কারণ, সিনেমাতে উত্তমকুমারের লিপে সেটাই প্রথম প্লেব্যাক গান। সে দিক থেকে উত্তমকুমারের প্রথম প্লেব্যাক সিঙ্গার তিনিই। সেই সঙ্গে তখনকার দিনের মিউজিক কোম্পানির বেস্টসেলার শিল্পী। আর তাঁকেই কিনা রোম্যান্টিক গান গাইতে দেবেন না সুরকার নচিকেতা ঘোষ! সুরকার গোঁ ধরেছেন, আর শিল্পী পড়েছেন ফাঁপরে। একে তো গৌরীপ্রসন্ন ঘোষকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন দু’টো গান, পুজোতে গানের রেকর্ডের রিলিজ, এ দিকে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নচিকেতা ঘোষকে কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারছেন না।
আরও পড়ুন: স্ত্রীর শ্রাদ্ধেও বাড়ি যাননি তিনি
ভদ্রলোক বন্ধুমহলে বেশ জনপ্রিয়। স্ত্রীকে যেমন ভালবাসেন, তেমনই সমঝেও চলেন। এক বার তাঁর স্ত্রী তো পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে রীতিমত অভিযোগ করে বসলেন, গীতিকাররা ভাল ভাল গান অন্য শিল্পীকে দিয়ে দেন আর তাঁর স্বামী গীতিকারদের ভাল বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও ভাল গান পান না। পুলকবাবু বন্ধুপত্নীকে আর বুঝিয়ে উঠতে পারেন না যে, সব গান সবার গলায় মানায় না। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
১৯৬৯ সালে একটি গান পুজোয় সুপারহিট হওয়ার পর গায়ক স্থির করলেন, তিনি পরের বার পুজোতেও রোম্যান্টিক গান গাইবেন। তখনকার দিনে গান নির্বাচনের বিষয়টা কিছু ক্ষেত্রে শিল্পীদের উপর ছেড়ে দেওয়া হতো, তাঁরা ইচ্ছেমত গান নির্বাচন করতে পারতেন। যদিও সুরকারদের কথাই ছিল দিনের শেষে চূড়ান্ত। তা গায়ক যেমন ভেবেছিলেন, তেমনই গৌরীপ্রসন্নবাবুর লেখা দুটো রোম্যান্টিক গান লিখে পৌঁছলেন নচিকেতা ঘোষের বাড়ি। বললেন, এই গানে সুর করে দিতে হবে। গানের কথা শুনে নচিকেতা ঘোষ বলে উঠলেন, ‘‘অসম্ভব! এই গান তোমাকে দিয়ে হবেই না।’’ শুনে শিল্পী আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, ‘‘এগুলোই পুজোয় গাইব ভাবলাম... গত বার এ রকম গানটাই তো হিট করল, তাই ভাবলাম...’’ নচিবাবু বললেন, ‘‘সে হতে পারে, কিন্তু এ গান এ বছর আর তোমাকে দিয়ে হবে না।’’
সুরকারকে যতই কারণ জানতে চাওয়া হয়, নচিবাবু বলেন না। শেষে পীড়াপীড়ি করতে যা বললেন, শুনে শিল্পী থ! নচিবাবু বললেন, ‘‘এ তো রোম্যান্টিক গান। তোমার মাথাজোড়া টাক, এই টাকে ওই প্রেমের গান হবে না। টাক না থাকলে এই গান গাওয়াতাম।’’
নচিকেতাবাবুর মজা ধরতে না পেরে হতাশ শিল্পী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ঘণ্টা কয়েক পর, নচিবাবু সুর করছেন, হঠাৎ জানলায় এক অচেনা মুখ বলল, ‘‘এই দেখ, এতে চলবে?’’ জানলার কাছে গিয়ে নচিবাবু দেখলেন, সেই শিল্পী দাঁড়িয়ে, কিন্তু টাক উধাও! ‘‘নিউমার্কেট গিয়ে এই উইগটা কিনে আনলাম,’’ শিল্পী বললেন, ‘‘এই তো টাক ঢেকে ফেলেছি, এ বার ওই গান গাওয়া যাবে তো?’’ নচিকেতা ঘোষ সহ ঘরের সবাই হাসিতে ফেটে পড়লেন। নির্মলা মিশ্র এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘ওই গান থেকেই দাদা উইগ পরা চালু করলেন।’’ ১৯৬৯ সালের ‘চলো রিনা ক্যাসুরিনা’-র পর ‘নীলাঞ্জনা’ গানটাও সুপারহিট হল উইগ পরে।
সদাহাস্যময় এই শিল্পীর জন্য কবি শৈলেন রায় লিখেছিলেন ‘কত কথা প্রাণে জাগে’। শিল্পীকে বলতেন, ‘‘তোর নামটা ভারী সুন্দর। এই নামটা তোকে বুড়ো হতে দেবে না। বুড়ো বয়সেও লোকে বলবে তরুণদাদু। বুড়ো হয়েও তুই তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ হয়েই সবার হৃদয়ে থাকবি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy