Advertisement
E-Paper

মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনের খটখট

কয়েক দশক আগেও বাঙালি অফিসপাড়ার অঙ্গ ছিল টাইপরাইটার।  টাইপিস্টের জীবন ঢুকে পড়েছিল ফুটপাত, পাড়ার রোয়াক থেকে বইয়ের পাতা, সেলুলয়েডেও। কয়েক দশক আগেও বাঙালি অফিসপাড়ার অঙ্গ ছিল টাইপরাইটার।  টাইপিস্টের জীবন ঢুকে পড়েছিল ফুটপাত, পাড়ার রোয়াক থেকে বইয়ের পাতা, সেলুলয়েডেও।

আবীর মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৭ ০৮:০০
ইতিহাস: কলকাতার ফুটপাতে টাইপিস্টদের ব্যস্ততা। ১৯৮৯ সালের ছবি।

ইতিহাস: কলকাতার ফুটপাতে টাইপিস্টদের ব্যস্ততা। ১৯৮৯ সালের ছবি।

গত সপ্তাহের শেষে কয়েক পাতা জুটেছিল। কার্বন-সহ বাংলা। সেই দিয়েই টেনেটুনে চাল-ডাল, শেষ বেলার বাজার। তার পর ফের যে কে সেই! পাড়ার দোকানে ধার বেড়েই চলেছে। সকাল-বিকাল বাড়িওয়ালার হম্বিতম্বি, ‘ভাড়া দিতে না পারলে ছেড়ে দিন।’ ছেড়ে আর যাই কোথায়! তিন-তিনটে পেট। আর যে চলে না! দেখি অন্য কিছু যদি...!’’ চশমার কাচ মুছতে মুছতে বলেন ষাট ছুঁই-ছুঁই গোপাল নস্কর।

রামগড় থেকে যাদবপুর যাওয়ার পথে বন্ধ গোলদাঁড়ি দোকানের সামনে গাল-ভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ির মানুষটি দু’দশকেরও বেশি সময় বসছেন নিজের টাইপমেশিনখানা নিয়ে। রোদ-জল সইতে সইতে ফিকে হয়েছে তার চাবিগুলো। ছাতার তলায়, পলকা কাঠের টেবিলে রাখা পুরনো যন্ত্রটার উপর কত মায়া! কত স্মৃতি! নড়বড়ে টুলে বসে খদ্দেরের অপেক্ষায় দিন কাটে গোপালবাবুর।

গ্রাম থেকে শহর, লাল থেকে সবুজ, ঝুপড়ি থেকে দালানকোঠা, দোকান থেকে মল— পরিবর্তনের এই বারমাসিয়া ছবি কেবল গোপালবাবুর একার নয়। সিউড়ি আদালত চত্বরের পরিমল দে, সুরঞ্জন চন্দ্র কিংবা বহরমপুরের সুখেনকুমার ঘোষ, শিলিগুড়ির সুবল ঘটক, শিয়ালদহের মফিজুলের মতো অগণিত টাইপিস্টের। অথচ, এই পেশাই ছিল এক সময় বাঙালির অবলম্বন। গড়পড়তা বাঙালির বায়োডেটায় লেখা থাকত টাইপিংয়ের স্পিড! ‘মিনিটে চল্লিশ শব্দ’-ই নির্ধারণ করে দিত ভবিতব্য। বাঙালি মেয়েদের বিয়ের আগে যেমন জোর করে বসিয়ে দেওয়া হত গানের মাস্টারের হারমোনিয়ামের সামনে দু’খানি রজনীকান্ত-অতুলপ্রসাদ-রবিঠাকুর তুলতে, ছেলেদের তেমনই ভর্তি করে দেওয়া হত মোড়ের মাথায় পাঁচুবাবুদের শর্টহ্যান্ড-টাইপ ইস্কুলে। পাড়ায় পাড়ায় খটাখট শব্দেই সকাল গড়াত, সন্ধে ঢলত রাতে।

রেমিংটন, ইম্পিরিয়াল, অলিভার, রয়্যাল কোম্পানির টাইপরাইটারে খটখটিয়েই সরকারি অফিসগুলোতেও চলত বাঙালি বাবুদের কাজ-কারবার। কয়েক দশক আগের বাংলা ছবিতে সরকারি-বেসরকারি অফিসের দৃশ্য মানেই খটাখট শব্দ অনিবার্য। মনে করুন সত্যজিতের ‘মহানগর’ ছবির কথা, লিফট থেকে নেমে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সহকর্মী এডিথ-এর সঙ্গে আরতির অফিস ঢোকার পথটুকুর আবহ। বাঙালি অফিসটোলার
কর্ম-কোলাহল।

‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’ ছবিতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

যখন প্রথম বাংলা টাইপরাইটার এল বাজারে, যন্ত্রের পেটেন্ট রেজিস্ট্রির খবর দিয়ে কাগজে লেখা হয়েছিল, ‘এ যন্ত্র বাঙ্গালা-সাহিত্য-ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা করবে।’ কেবল সাহিত্য কেন, গড়পড়তা মধ্যবিত্ত বাঙালির রুটি-রুজির সুনিশ্চিত পেশাই ছিল এই যন্ত্র-নির্ভর।

এ দেশে বাংলা টাইপরাইটার প্রথম বিক্রি শুরু করে ব্লিক টাইপরাইটার কোম্পানি। কলকাতার পেটেন্ট অফিসের নথি থেকে ১৯০১-এ হ্যামন্ড টাইপরাইটারের একটি পেটেন্ট নেওয়ার কথা মেলে। কিন্তু বাংলা টাইপের কথা পাওয়া যায় ১৯১৪-তে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ‘কলের লেখা’ শীর্ষক একটি লেখায়। সম্পাদক জানাচ্ছেন, ‘প্রায় ৭/৮ বছর পূর্বে কলিকাতায় রেমিংটন টাইপরাইটার কোম্পানির অধ্যক্ষ মিস্টার এ পি স্টকওয়েল-এর অনুরোধে শ্রীগণদেব গাঙ্গুলী তাঁর পিতা বেণীমাধব গাঙ্গুলীর উপদেশক্রমে বাঙ্গালা-লেখায় এইরূপ একটি কল-প্রস্তুতের বিশদ বিবরণী লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। শুনিতেছি, উক্ত কোম্পানি বাঙ্গালা লেখার এইরূপ কল আমদানী করিয়াছেন।’ ১৯১৯ সালের ‘প্রবাসী’-তে বাংলা টাইপের নমুনা ছাপা হয়েছিল। সিদ্ধার্থ ঘোষ তাঁর ‘কলের শহর কলকাতা’য় লিখছেন, ‘ময়মনসিংহের ধনকুড়া নিবাসী সত্যরঞ্জন মজুমদারের আবিষ্কৃত যন্ত্রে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানের কয়েক পঙক্তি’ ছাপা হয়েছিল। নানা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে নব্বইয়ের দশকের গোড়া পর্যন্ত এই যন্ত্রের রমরমা।

তার পর এক দিন কমে এল টাইপরাইটারের খটাখট। জায়গা দখল করে নিল কম্পিউটার। পেশা বদলে ফেললেন টাইপিস্টদের কেউ কেউ। মফস্‌সলের সরকারি দফতরের বাইরে কেউ কেউ এখনও অপেক্ষায়! ‘‘সেই ’৮৩ সাল থেকে পড়ে আছি এই কোর্ট চত্বরেই। ধার নিয়ে মেয়েটার বিয়ে দিয়েছি। দত্তপুকুরে ভাড়াবাড়িতে দিন যেন আর চলে না। আর কি সুদিন ফিরবে আমাদের! কোনও দিন ৫০, ১০০ হয়, কোনও দিন তা-ও হয় না। তবু রোজ আসি। যদি কেউ খোঁজ করেন!’’

অন্যের বয়ান টাইপ করতে করতেই বিচিত্র অভিজ্ঞতায় গোপালবাবু-পরিমলবাবুদের জীবন কখনও-সখনও হয়ে উঠেছে কাহিনির চরিত্র। সওদাগরি দফতর থেকে এই পেশা দিব্য জায়গা করে নিয়েছে সাহিত্যে, সিনেমায়। কেউ কেউ নিজের গল্পে লিখছেন অজানা, বিচিত্র রোজনামচা। ‘কত অজানারে’ গ্রন্থের সেই বেকার যুবক শংকর যেমন। কাজের সন্ধানে বিভূতিদা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন হাইকোর্টের উলটো দিকে হলদে রঙের টেম্পল চেম্বারে। সোঁদা গন্ধের, প্রাগৈতিহাসিক যুগের লিফটে উঠতে উঠতে যুবকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে লিফটম্যানকে বিভূতিদা বলেছিল, ‘‘এই যে বৃন্দাবন, সব খবর ভালো তো? সায়েবের নতুন বাবু।’’

সাহেব ব্যারিস্টার নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েল-এর অফিসে সে দিন কাজ জুটে গিয়েছিল সেই যুবার, আজকের লেখক শংকরের। টাইপিস্টের কাজ। নিছক উপার্জন নয়। আর পাঁচ জন বাঙালির মতোই শংকরের কাছে সে ছিল এক অন্য ভুবন। টাইপিস্টের কাজে প্রথম দিন চেম্বারে গেলে বিভূতিদা জানিয়েছিলেন, ষোলো বছর আগে তিনিও টেম্পল চেম্বারেই এক অ্যাটর্নির কাছে পাঁচ টাকা মাস মাইনেতে টাইপিস্টের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। এক দিন সাহেব ছুটির পর তাঁকে ডেকে কাজ দিয়েছিলেন। সস্নেহে বলেছিলেন, ‘‘মাই সন, কমলালেবু খাবে?’’ সামান্য টাইপিস্টের এই কদর শুনে বুঝি স্বপ্নে বুঁদ হয়েছিলেন শংকরও!

নিছক টাইপিস্ট নয়, এই জীবন দেখার সুযোগ মিলেছিল তাঁরও। কত মানুষ যে তাঁর সামনে দরজা হাট করে উজাড় করে দিয়েছে নিজেদের জীবনের গল্প! সেই কাজের অভিজ্ঞতাই পরে হয়ে ওঠে তাঁর সারা জীবনের অনন্য অভিজ্ঞতা। পরে তিনি লিখছেন, ‘যেন আনমনে হাঁটার পথে আচমকা হোঁচট খেয়ে চেয়ে দেখলাম, পায়ের কাছে কলসী বোঝাই মোহর।’ আইন-পাড়ার টেম্পল চেম্বারে শেষ বারের মতো দরজা বন্ধ করতে করতে শংকরের স্মৃতিতে জাগে টাইপিস্ট-জীবনের সেই সব কথা।

এ কাহিনি ১৯৫৩ সালের। পাতা ওলটাতে বেরিয়ে পড়ে কয়েক দশক পরের টাইপিস্ট-জীবন। জানুয়ারি ২০১৫-তে প্রকাশিত চন্দননগর কোর্টের টাইপিস্ট মলয় মণ্ডলের ‘গাছতলার টাইপিস্ট’। রোজকার জীবন ছুঁয়ে পাতায় পাতায় ‘আদালত জীবনের অজানা কথা’ চিত্রিত করেছেন মলয়। গোপালবাবু, পরিমল দে’র মতো দারিদ্রে ভরা জীবন হয়েও, এ কাহিনি নিছক টাইপিস্টের সুখদুঃখের বারমাস্যা নয়। বরং অজস্র মানুষের বয়ান টাইপ করতেই করতেই তিনিও যেন দেখে ফেলেন ভুবনডাঙা। তাঁরও লেখার মাঝে ভিড় করে এসে দাঁড়ায় তিস্তা, স্বাগতা, অচিন্ত্য, দীননাথ শর্মা, ষাট ছুঁই-ছুঁই প্রৌ‌ঢ়ার চরিত্র-মিছিল। গল্পের বাঁকে বাঁকে হাসে পুলিশ-দালাল চক্র, প্রোমোটার-রাজ, জ্যোতিষী!

এ-ও এক অন্য রকম জীবন। মুহুরি, পরে টাইপিস্টের লাইসেন্স পেয়ে মলয় ঢুকে পড়েন যে জীবনে। প্রথমে আদালতের বারান্দা, পরে তাঁর পরিচিতি হয় ‘গাছতলার টাইপিস্ট’ হিসাবে। সারা দিনে খেটেখুটে আয় ৪-৫ টাকা! গাছতলায় বসেই টাইপ করতে করতে জানতে পারেন, ‘আদালতে একপক্ষ আসেন বিচার চাইতে, আর একপক্ষ আসেন বিচার কিনতে।’ লিখছেন, অনেক সময় তাঁদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে টাইপ করতে হয়। সংশোধন করলে ফের বদলে দিতে হয়। কত যে রকমফের! এই হয়তো দেওয়ানি, ফৌজদারি মামলার আর্জি বা জবাব টাইপ করলেন। ঠিক তার পরেই হয়তো এল বর্গার চিঠি। কিংবা এফিডেভিট করে নাম বদলে নিল কেউ। কেউ আবার ডির্ভোসের চিঠিতে খোরপোশের অঙ্ক বসাচ্ছেন।

এক জন টাইপিস্টের কাছে কত যে বদ অনুরোধ আসে! মলয়বাবুর লেখাতেই তার হাজার কথা। টাইপ হয়ে সই-সাবুদও সারা। কেউ কেউ এর পরেই এসে আর্জি জানায়, দু’একটি শব্দ বাড়িয়ে দেওয়ার। স্রেফ প্রতারণার জন্য এই কাজ জেনেও বহু টাইপিস্ট পিছিয়ে যান। কেউ কেউ চাপে পড়ে করেন। দু’টো পয়সার জন্য করতে বাধ্য হন! মলয় লিখছেন, ‘কেউ কেউ কাগজে কলমে জ্যান্ত মানুষকে মৃত বানায়, আবার কেউ মৃতকে জ্যান্ত বানিয়েই ছাড়ে। সব ক্ষেত্রে না বলা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে আমরাও ঠিক থাকতে পারি না। দালালরাজে সবটাই সম্ভব।’

একটা পেশা কালান্তরে কেমন করে যেন ঢুকে পড়ল অফিস-পাড়া, ফুটপাত, পাড়ার রোয়াক থেকে বইয়ের পাতা, কাহিনি থেকে সেলুলয়েডেও! দু’মলাটে ‘টাইপিস্ট’ জীবন পড়তে পড়তেই ফ্রেম সরে যায়। হলিউডের ‘পপুলারিয়া’, ‘দি টাইপিস্ট’, বলিউডের ‘ওয়াজুদ’, টলিপাড়ার ‘লুকোচুরি’, ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’— টাইপিস্ট-জীবন ছুঁয়ে ছুঁয়ে আরও কত ছবি!

এন চন্দ্রার ‘ওয়াজুদ’-এ মলহার চরিত্র করেছিলেন নানা পটেকর। ছবিতে তাঁর বাবার চরিত্রটি ছিল হতদরিদ্র এক কেরানি-টাইপিস্টের। দিন-আনি-দিন-খাই সংসারে সে বাবার গঞ্জনা সয়েছে, জুতোর পেটা খেয়েছে, তবুও টাইপিস্টের জীবন বেছে নেয়নি। চৌকাঠ ডিঙিয়ে দৌড়ে পালিয়েছে।

এক সময় মলয়বাবুরও মনে হয়েছিল, তবে কি এই পেশা বন্ধ হয়ে যাবে! গোপাল নস্করের মতোই তিনিও ভেবেছেন ‘অন্যকিছু’-র, অন্য কাজের কথা। মাদ্রাজ মেলের টেইল ল্যাম্প বারওয়েল সাহেবকে নিয়ে হাওড়া স্টেশনের আউটারে মিলিয়ে যাওয়ার কয়েক দিন পরে শংকরেরও তো তেমনই মনে হয়েছিল! টাইপিস্টের পেশায় ইতি টেনে তিনি অবশ্য ছুটিই নিয়েছিলেন ল-পাড়া থেকে। ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের পথে বেরিয়ে পড়ে বলেছিলেন, ‘হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্‌খানে।’

টাইপরাইটার Typewriter Typist Personal assistant Bhanu Bandopadhyay ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy