Advertisement
E-Paper

কালো সোনার দেশে

আক্রমণ করতে এসে  আলেকজান্ডার বুঝতে পারেন, আজারবাইজানের রাজধানী বাকুর মাটির তলায় আছে তেল। যা পরে কবজা করতে চেয়েছিলেন হিটলার। সেই শহর আজও জুগিয়ে যাচ্ছে আমার আপনার ঘরের জ্বালানি। আক্রমণ করতে এসে  আলেকজান্ডার বুঝতে পারেন, আজারবাইজানের রাজধানী বাকুর মাটির তলায় আছে তেল। যা পরে কবজা করতে চেয়েছিলেন হিটলার। সেই শহর আজও জুগিয়ে যাচ্ছে আমার আপনার ঘরের জ্বালানি।

শান্তিপদ গণ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৭ ০৮:১০
স্বর্ণভূমি: পাহা়ড়, কাস্পিয়ান সাগর ও মাটির নীচে চিটচিটে খনিজ তেল নিয়ে বাকু

স্বর্ণভূমি: পাহা়ড়, কাস্পিয়ান সাগর ও মাটির নীচে চিটচিটে খনিজ তেল নিয়ে বাকু

কাস্পিয়ান সাগরের তীরে বসে আছি। পায়ে এসে লাগছে জল। হাতের গ্লাভস খুলে এক আঁজলা জল তুললাম। জলটা কেমন ভারী ভারী, আঠা আঠা, চিটচিটে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে সহজে জল গলতে চাইছে না। ব্যাপারটা কী?

পাশ থেকে এক পুরুষকণ্ঠ বলে উঠল, ‘‘আশেপাশের মাঠে গিয়ে কোদালের এক কোপ দিন মাটিতে। দেখবেন, তরল কিছু একটা বেরিয়ে আসছে। এ রকমই চিটচিটে, আঠালো। ওটা জল নয়, তেল। পেট্রোলিয়াম।’’

কাস্পিয়ান সাগরের তীরে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেই শহরের নাম বাকু। আজারবাইজানের রাজধানী। পৃথিবীর কাছে তার পরিচয় তেলের আঁতুড় ঘর হিসেবে। বাকুতে তেলের আবিষ্কারের কথা বলতে গেলে ফিরে যেতে হবে সেই আলেকজান্ডারের যুগে। সম্ভবত আজারবাইজানের পথ ধরেই তিনি ভারতে এসেছিলেন। আলেকজান্ডারের বাহিনী বাকুর ভূগর্ভে থাকা এই চিটচিটে তরলের রহস্য বুঝে ফেলেছিল। শোনা যায়, শত্রুদের ভয় দেখাতে তাঁর বাহিনী বিশালাকায় আগুনের টর্চ ব্যবহার করত। সেই টর্চ আর কিছু নয়, তেলের কূপে আগুন লাগাত গ্রিক সেনারা। যা জ্বলত বছরের পর বছর।

অষ্টম শতাব্দীতে আজারবাইজানের লোকেরা তেল থেকে এক ধরনের ওষুধ তৈরি করতেন। মার্কো পোলোর লেখাতেও বাকুর উল্লেখ আছে। তিনি বাকুর অধিবাসীদের কাস্পিয়ান সাগর থেকে হাতে করে জল ও তেল তুলে ওষুধ ও জ্বালানির কাজে ব্যবহার করতে দেখছেন। যদিও সেই সময় তৈল শোধনাগার ছিল না। কী ভাবে কাঁচা তেল পরিস্রুত করা হত তা এখনও রহস্য।

ষোড়শ শতাব্দীতেই তেলের দৌলতে আর্থিক ভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু করেছিল কাস্পিয়ান সাগর তীরের এই জনপদ। জ্বালানির রূপান্তরের ইতিহাসে বাকুর মতোই তেলের জন্য বিখ্যাত এই শহরের কাছে আরও দু’টি জনপদ, বালাখানি ও বিবিহেবাত। আজারবাইজান কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বলছে, বালাখানিতে ১৫৯৪-এ প্রায় ৫০০ তেলের কূপ ছিল। বাণিজ্যিক ভাবে সেখান থেকে অপরিস্রুত তেল উত্তোলন এবং বিক্রি ও করা হত। খনিজ তেলের বাণিজ্যিক ব্যবহারের শুরু সেখান থেকেই।

১৮৭৫-এ নোবেল ভ্রাতৃদ্বয় লডভিগ ও রবার্ট তাঁদের সঙ্গী খ্যাতনামা আলফ্ৰেড নোবেলকে নিয়ে আজারবাইজানে একটি কোম্পানি খুলে ফেলেন এবং সেই কোম্পানি পৃথিবীর প্রথম তেল বহনকারী ট্যাঙ্কারও তৈরি করে।

বর্তমানে বহুজাতিক সংস্থাগুলি বাকুতে ও কাস্পিয়ান সাগরে স্থাপন করেছে অত্যাধুনিক অয়েল প্ল্যাটফর্ম। গড়ে উঠেছে তেল শোধনাগার। বাকু জর্জিয়া হয়ে বিশাল তেলের পাইপলাইনের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে তেল পৌঁছে যাচ্ছে। এখনও বাকু শহরের একশো বছরের পুরনো তেল খনন যন্ত্রগুলি কাজ করে চলেছে। বাকুতে দাঁড়িয়ে দার্জিলিংয়ের ছোট্ট জনপদ সিদ্রাপংয়ের কথা মনে পড়ে গেল। ১৮৯৭-এ এখানে এশিয়ার প্রথম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে। তার পর সেটি এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালে ভারত সরকারের সহায়তায় পুনর্জীবিত করা হয়েছিল। আর কাজটা হয়েছিল আমার উদ্যোগে।

আজারবাইজান আগে ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্গত। ১৯৯১ থেকে সে স্বাধীন রাষ্ট্র। কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিটলার বলেছিলেন, ‘‘বাকুর তেলের উপরে নিয়ন্ত্রণ না পেলে আমাদের যুদ্ধ জয়ের স্বপ্নটাই ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে।’’ স্তালিনের বাহিনী যদি হিটলারের বাহিনীকে হারিয়ে না দিত তা হলে জার্মানদের দখলে চলে আসত এই তৈল প্রদেশ। জার্মানিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে বাকুর তেল খনির উপরে নজর ছিল হিটলারের।

ফেরার পথে এক প্রবীণের কথাটিই কানে বাজছিল, ‘‘এক বার হিটলার বাকু দখল করে নিলে আমাদের এই জনপদটাকে ঘিরেই এত দিনে হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যেত। আর পারমাণবিক বোমায় আমাদের পুরো জনপদটাই যে পুরো ধ্বংস হয়ে যেত না, এমন কে বলতে পারে!’’

অনুলিখন: দেবদূত ঘোষঠাকুর

Baku Azerbaijan Capital Adolf Hitler আজারবাইজান বাকু
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy