Advertisement
E-Paper

জেড প্লাস নিরাপত্তায় এল বাংলা বই

ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে খুঁজে পেয়েছিলাম কামিনী দেবীর ‘মনোত্তমা’। বাঙালি নারীর লেখা প্রথম বাংলা উপন্যাস। অদ্রীশ বিশ্বাসবাংলা ভাষায় বাঙালি মেয়ের লেখা প্রথম মৌলিক উপন্যাস ‘মনোত্তমা’। প্রকাশিত হয় ১৮৬৮ সালে, যার তিন বছর আগে ১৮৬৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশ করেন।

শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০

বাংলা ভাষায় বাঙালি মেয়ের লেখা প্রথম মৌলিক উপন্যাস ‘মনোত্তমা’। প্রকাশিত হয় ১৮৬৮ সালে, যার তিন বছর আগে ১৮৬৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশ করেন। মানে প্রায় একই সময়ে এক জন মহিলা ‘মনোত্তমা’ লিখছেন। কিন্তু এই তথ্যটা আমরা সম্পূর্ণ না জেনে একটা অন্ধকার অবস্থায় ছিলাম। কে প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক, তাঁর নাম ও বইয়ের কোনও হদিশ দিতে পারেননি স্বয়ং সুকুমার সেনও!

বছর কয়েক আগে একটা ফেলোশিপ পেয়ে লন্ডনে যাই ও ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে কাজ করতে থাকি। শুনেছিলাম ‘মনোত্তমা’র একটাই মাত্র কপি নাকি সেখানে আছে। ক্যাটালগ ঘেঁটে দেখি, ওই নামে কোনও বই নেই। যিনি দায়িত্বে ছিলেন তাঁকে বললাম, বাংলায় লেখা প্রথম মেয়ের উপন্যাসটা শুনেছি এখানেই আছে, কিন্তু ক্যাটালগে তো নেই। আমি সেটা উদ্ধার করে দেশে নিয়ে যেতে চাই। এটা আমাদের ইতিহাস, আমাদের সম্পদ। যাঁকে বলছি, তিনি কিন্তু বাঙালি নন। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর কোনও দায়বদ্ধতা থাকার কথা নয়। কিন্তু সহযোগিতা আর সংরক্ষণ কী, সেটা ওঁদের কাছে শেখার। উনি আমায় বললেন, কিছু ‘রেয়ার’ বইয়ের চব্বিশটা ভলিউম আছে, যার ভেতরে কী আছে তার নাম জানি না, আপনি সেগুলো দেখুন।

রাজি আমি। কিন্তু সেগুলো খুবই রেয়ার বই বলে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে। আজ বললে কাল আসবে। আমি চব্বিশটা ভলিউমের অ্যাপ্লিকেশন করলাম। যেহেতু তার ভিতরে কী আছে কেউ জানে না, সেটার ক্যাটালগ নেই। এটাই বলার ও দেখার যে, ওঁরা ভাষা না জেনেই বইকে এত সুন্দর ভাবে সংরক্ষণ করেন; তার ফলে বইয়ের ভাগ্যেও জোটে মহারানির মতো জেড প্লাস নিরাপত্তা। পর দিন তাই বইগুলো এল বড় ভ্যানে চড়ে, সেখানে রাইফেল সহ পুলিশ ও সামনে-পিছনে পাইলট কার। আমি হতবাক হই এই মহৎ দৃশ্যে। ওঁরা আমাকে চব্বিশটা ভলিউমই এনে দিলেন। এক-একটা ভলিউমে কুড়িটা করে বই, কোনওটারই ক্যাটালগ নেই। কেন? তা হলে বইগুলো চুরি হয়ে যেতে পারে, লুঠ হতে পারে। তাই রেয়ার বুক কিন্তু ক্যাটালগহীন। আমি এক-একটা করে ভলিউম ওলটাই, কিন্তু ‘মনোত্তমা’ পাই না। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ একটায় সেই উনিশ শতকের ভাঙা সিসার হরফে দেখি লেখা ‘মনোত্তমা’। মুহূর্তে আমার শিরা জুড়ে আনন্দের রক্তপ্লাবন হয়। গোটা বইটা ফোটোকপি করি। তার পর ফের জেড প্লাস নিরাপত্তায় ফিরে যায় বইগুলো, ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে।

দেশে ফিরে গবেষণার কাজ শুরু করি। লেখাটা ছদ্মনামে, ‘হিন্দুকুল-কামিনী প্রণীত’। সাল ১৮৬৮। কে এই হিন্দুকুল-কামিনী? জানি না। কোথাও কি আগে বেরিয়েছিল? জানি না। কোনও প্রকাশক নেই, মুদ্রকের নাম আছে। অনেকগুলো বাধা পেরোতে হবে আমায়। শুরু হল উনিশ শতকের বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখা। ‘নবপ্রবন্ধ’ পত্রিকায় খোঁজ মিলল। ১৮৬৭-তে প্রায় এক বছর ধরে এই মাসিক পত্রিকায় ‘মনোত্তমা’ ধারাবাহিক বের হয়।

উপন্যাসের কাহিনিটা একদম আলাদা। উপন্যাসের যা নাম ‘মনোত্তমা’, কাহিনির নায়িকাও সে। বলা যায়, এই বই একই সঙ্গে এক নারীর লেখা ও এক জন নারীর কাহিনি। সেই মেয়ে, মনোত্তমার বাবা তাঁকে পড়াশোনা শিখিয়ে বড় করেন। পড়াশোনার দাম অনেক, সেই বার্তাই বাঙালি নারীর প্রথম উপন্যাসে দিয়ে যাওয়া হয়েছে।

শিক্ষিত মনোত্তমার সঙ্গে বিয়ে হয় অশিক্ষিত একটা ছেলের। এটা নতুন ঘটনা। কী সমাজে, কী সাহিত্যে উনিশ শতকে প্রথম শিক্ষিত হত ছেলেরা, তার পর তারা অশিক্ষিত মেয়েদের বিয়ে করে শিক্ষিত করে তুলত। কৈলাসবাসিনী দেবী থেকে ঠাকুরবাড়ির একাধিক বিয়েতে সেই উদাহরণ আছে। আর সাহিত্যেও তা-ই।

মনোত্তমা কিন্তু অন্য গল্প শোনাচ্ছে আমাদের। কী সেটা? মনোত্তমা তার স্বামীকে পড়াতে শুরু করে। স্বামীর সম্মানে লাগে। স্বামী তখন আর একটা বিয়ে করে বউকে জব্দ করতে। মনোত্তমা কোনও বিদ্রোহ করে চলে যায় না। মনোত্তমা শ্বশুরবাড়িতে থেকে তার নতুন সমস্যাকে শিক্ষা দিয়ে মোকাবিলা করে। সে পড়াতে শুরু করে, নতুন বউয়ের বাচ্চাদের। সঙ্গে পাড়ার বাচ্চাদের। তার ‘আলোকিত’ হয়ে ওঠার সেই অস্ত্র কাজ দেয়। সংসারে ঝগড়ার বদলে প্রশংসা লাভ করে। এই মন জয় করার ভারতীয় শ্রদ্ধাভক্তির পদ্ধতিটা একদম নতুন ঘটনা। অথচ এই সামাজিক রূপটা আমরা জানতাম না। অনেক পরে আলোকপ্রাপ্ত নায়িকাদের গল্প-উপন্যাস লেখা হয়। কিন্তু সেটা যে প্রথম উপন্যাসেই ঘটে গিয়েছে, তার হদিশ ছিল না আমাদের। ফলে ‘মনোত্তমা’ চমকে দেয় অনেক দিক থেকেই।

ছদ্মনামে লেখা এই হিন্দুকুল-কামিনীর খোঁজ পেতে কালঘাম ছুটে গিয়েছে। কারণ, যে সমস্ত গ্রন্থপঞ্জিতে খোঁজ পাওয়া যেতে পারে, তাতে নেই। শেষে পুলিশের কাছে গিয়ে একটা ক্যাটালগ পাই, তাতে দেখি ‘মনোত্তমা’র নাম, লেখিকা কামিনী দেবী, হুগলিতে বাড়ি। পাঁচশো কপি ছাপা হয়েছিল, সেই তথ্যও লেখা আছে। এখন পুলিশ কেন এমন ক্যাটালগ পেল, এটা প্রশ্ন। যখন ইংরেজরা শাসন করছে তখন মহাবিদ্রোহ হয়। বহু বাঙালি বুদ্ধিজীবীর তাতে সমর্থন ছিল, অথচ ব্রিটিশ গোয়েন্দা পুলিশ তার খোঁজ পায়নি। গোয়েন্দাদের নজরে যাতে সব থাকে, সে জন্য তখন ওরা একটা আইন করে, সমস্ত প্রকাশিত বই দু’কপি করে জমা দিতে হবে। তারা পড়ে দেখবে, তার মধ্যে বিদ্রোহের কোনও বারুদ আছে কি না। আর সেই প্রকাশিত বইগুলোর একটা ক্যাটালগ বানায়। দু’কপি বইয়ের মধ্যে এক কপি এ দেশে রাখে, আর এক কপি ওদের দেশে নিয়ে যায়। সেই বইটাই এক কপি ‘মনোত্তমা’, যা দিয়ে ওঁরা ব্রিটিশ লাইব্রেরি ও মিউজিয়াম সাজিয়েছেন। আশ্চর্য সেই সংগ্রহ আর সংরক্ষণ মহিমা। তার বলেই দেশে ফিরে ‘আনন্দ’ থেকে পুর্নমুদ্রণ করা গিয়েছিল সেই বই। বাংলা ভাষায় লেখা বাঙালি মেয়ের প্রথম উপন্যাস ‘মনোত্তমা’।

Original Novel
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy