দু’জনে: মহারানি ভিক্টোরিয়ার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মুনসি আবদুল করিম
অস্কারের মনোনয়ন পাওয়া কনসোলাটা বয়েল দু’মাসের একটু বেশি সময় নিয়েছেন এই পোশাকগুলো বানাতে। ওঁর দলে ৪০ জন পোশাকশিল্পী, কেউ সেলাই করছেন, কেউ এমব্রয়ডারি। অ্যালান ম্যাকডোনাল্ড এমন সেট বানিয়েছেন, পুরনো যুগটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
পরের তিন মাসে সেই জায়গাগুলোয় গেলাম, যেখানে গল্পের মূল ঘটনাগুলো ঘটেছিল— অসবর্ন হাউস থেকে একেবারে ভারতের আগরা অবধি। বই লেখার প্রায় দশ বছর পর অসবর্নে ফিরে খুব ভাল লেগেছিল। অসবর্ন হাউসের ‘দরবার হল’, ইন্ডিয়ান করিডরেই শুটিং হয়েছিল। আগরার দৃশ্যগুলোও ছবিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘এক্সট্রা’র ভূমিকায় শত শত মানুষ, ব্রিটেনের শুটিঙের থেকে একেবারে আলাদা। ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে আগরা জেল-এর কারাবন্দি ও পুলিশ অফিসারদের ছবি পেয়েছিলাম। সেই সব ছবি দেখেই কনসোলাটা পোশাক তৈরি করলেন। আগরার একটা কলেজকে কারাগার বানানো হয়েছিল। ছাদে ওড়া ইউনিয়ন জ্যাক, শেকলে বাঁধা বন্দিদের দেখে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। আগরা জেলে বন্দিদের গালিচা বোনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত, ছবিতেও সেই সব সযত্নে রাখা হয়েছে। গ্রামে গিয়ে অ্যালান পুরনো আমলের তাঁত খুঁজে বার করেছিলেন। উনিশ শতকের শেষ দিকের আগরার রাস্তাঘাট, ধুলো, গরমের তাত— সব ধরা হয়েছে অপূর্ব রঙে, রূপে। ছাদের উপর দিয়ে দেখা যেত তাজমহলকে। এখানেই এক ভোরে আবদুল করিমের গল্প শুরু হয়েছিল।
রানির বিশ্রামভবন অসবর্ন হাউসের ইন্ডিয়া করিডরে ঝোলানো একটা ছবিতে যে দিন আবদুল করিমকে দেখি, সে দিনই অন্য একটা অনুভূতি হয়েছিল। ভিক্টোরিয়া যে ‘কারি’ খেতে ভালবাসতেন, আর তাঁর যে কয়েক জন ভারতীয় রাঁধুনি ভৃত্য ছিল, আমি তা জানতাম। অস্ট্রিয়ান শিল্পী রুডল্ফ সোবোদা-র আঁকা ছবিতে করিম এক সুদর্শন তরুণ, হাতে একটা বই, চোখের দৃষ্টি আনমনা। তাঁকে দেখে ভৃত্য একেবারেই নয়, নবাব বলে মনে হয়। অসবর্নে ভিক্টোরিয়ার ড্রেসিং রুমে রানির স্কটিশ শিকার-অনুচর জন ব্রাউন আর আবদুল করিমের ছবি উপর-নীচে টাঙিয়ে রাখা। গাইড আমাকে বলেছিলেন, স্বয়ং রানি ওগুলো দেওয়ালে টাঙিয়ে গিয়েছেন। বুঝতে পারছিলাম, ব্রাউন যেমন, করিমও তেমনই প্রিয়পাত্র ছিলেন ভিক্টোরিয়ার। আমার মনে হল, আরও জানার আছে, আরও জানতে হবে।
আরও পড়ুন:শিল্প থেকে রাজনীতি একাকার তাঁর লেখায়
পরের চার বছর ধরে টুকরো টুকরো গল্পগুলো জুড়লাম। উইন্ডসর কাস্ল-এ ভিক্টোরিয়ার জার্নাল— ‘হিন্দুস্তানি জার্নাল’— পড়লাম। খুব কম জনই জানেন যে বর্ষীয়সী রানি আবদুলের থেকে উর্দু পড়া, লেখা শিখেছিলেন; তেরো বছর ধরে ডায়েরি লিখেছেন। আশ্চর্যের কথা, এগুলোর কখনওই অনুবাদ হয়নি। পড়তে পড়তে এক অসাধারণ বন্ধুতার সম্পর্ক যেন আমার সামনে খুলে গেল। রানির ডাক্তার, স্যর জেমস রিড-এর ডায়েরি পড়লাম; রাজপ্রাসাদের সদস্যদের, ইন্ডিয়ার ভাইসরয়ের, রানির নিজের চিঠিপত্র পড়লাম। সব কিছু থেকেই একটা জিনিস পরিষ্কার, আবদুল করিমের উপস্থিতি দরবারে বেশ মাথাব্যথারই কারণ হয়েছিল। মনে হল, আরও জানতে হবে ওঁকে নিয়ে। আগরা যেতে হবে, যেখানে ওঁর বাড়ি ছিল।
২০০৬-এর শীতে আগরা গিয়ে দেখি, আবদুল করিমের নামই কেউ শোনেনি। তবু মনে হল, এত গুরুত্বপূর্ণ এক জন মানুষ, নিশ্চয়ই ওঁর একটা বড় সমাধি থাকবে! স্থানীয় এক সাংবাদিকের সহায়তায় তিন দিন পর খুঁজে পাওয়া গেল সেই সমাধি। ছন্নছাড়া একটা কবরস্থান, কাঁটাঝোপে ভর্তি, কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। বুড়োটে এক পাহারাদার দেখভালের দায়িত্বে। জায়গাটা দেখে বোঝা যায়, এক কালে বিরাট আর দামি সব পাথরে সাজানো ছিল এই কবরস্থান। সব লুঠ হয়ে গিয়েছে। সমাধিফলক খুঁজে পেলাম, তাতে ‘রানির মুনসি ও শিক্ষক’-এর নামে প্রশস্তিবাক্য লেখা। যত সম্মান আর খেতাব পেয়েছিলেন, তার লিস্টি। বিস্মৃত, হতশ্রী জায়গাটা দেখেই আরও মনে হল, করিমের গল্প আমাকে বলতেই হবে।
আগরার কেন্দ্রস্থলে রানি ভিক্টোরিয়া একটা জমি দিয়েছিলেন আবদুলকে, সেই জমির উপর বানানো বাড়িটাও খুঁজে পেলাম। সেখানে এখন এক হিন্দু পরিবার থাকে। শুনলাম, দেশভাগের পর আবদুলের পরিবার পাকিস্তানে চলে যায়। আবদুলের কোনও সন্তান ছিল না, বংশরক্ষা হয়নি তাই। ২০১০-এ বইটার হার্ডব্যাক সংস্করণ বেরনোর পর অন্তত ভেবেছিলাম, গল্পটা বেরোল, এ বার নিশ্চয়ই করিমের পরিবারের কেউ যোগাযোগ করবেন। এক মাসের মধ্যেই একটা ফোন পেলাম। সম্পর্কে আবদুল করিমের এক নাতি, ভারতে থাকেন। তিনিই জানালেন, আবদুলের ডায়েরি রাখা আছে করাচিতে ওঁর পরিবারের কাছে। পাকিস্তানে গেলাম, পেলাম সেই ডায়েরি। হাতে নিতেই, সেই পরিচিত হাতের লেখা! মনে হল, যেন ওঁর কণ্ঠস্বর খুঁজে পেয়েছি। এ বার বলা যাবে ওঁর গল্প।
‘ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আবদুল’ বইটা প্রকাশের পর অনেকগুলো স্টুডিয়োর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম এর ছবি-সত্বের জন্য। নাট্যকার লি হল (বিলি ইলিয়ট) বিবিসি রেডিয়ো-ফোর’এ আমার অনুষ্ঠান শুনেছিলেন, গল্পটা ওঁকে নাড়া দিয়েছিল। ‘ওয়ার্কিং টাইট্ল’ সংস্থা খুব আগ্রহ দেখালেন ছবি প্রযোজনার ব্যাপারে, ‘ক্রস স্ট্রিট ফিল্মস’-এর বিবান কিডরনও। পরে যোগ দিল ‘বিবিসি ফিল্মস’-ও। স্বপ্নের দল হল একটা। ছবির পরিচালক স্টিফেন ফ্রিয়ার্স, রানি ভিক্টোরিয়ার ভূমিকায় জুডি ডেঞ্চ। ঠিক হল, আবদুল করিমের চরিত্রে অভিনয় করবেন বলিউড-অভিনেতা আলি ফজল।
বইয়ের মতোই, ছবির শুরুও ১৮৮৭ সালে, যে বছর ভিক্টোরিয়া তাঁর শাসনামলের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ উদ্যাপন করছেন। তাঁর সাম্রাজ্য তখন খ্যাতি ও সমৃদ্ধির শীর্ষে, পৃথিবীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ জুড়ে তার বিস্তৃতি। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভেবেছিলেন, এই উৎসবে কিছু ভারতীয় ‘প্রিন্স’কে আমন্ত্রণ জানালে বেশ ভাল হয়। রানির পার্টিতে সারা বিশ্বের সামনে সাম্রাজ্যের রবরবা তুলে ধরা যাবে।
রানি এক বার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, ভৃত্যদের মধ্যে কয়েক জন ভারতীয় হলে বেশ হত। সে জন্যই আবদুল করিম ও মুহাম্মদ বক্সকে রানির কাছে পাঠানো হয়, ‘জুবিলি উপহার’ হিসেবে। তাঁদের কাজ ছিল খাওয়ার টেবিলে রানির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা, প্রয়োজনমতো কাজকর্ম করা।