Advertisement
E-Paper

দুর্দান্ত স্যুট পরতেন আমার বস গোয়েব্‌লস

ব্যবহারটিও ছিল মধুর। শৌখিন, হাতে ম্যানিকিওর করাতেন রোজ। মাঝে মাঝে অবশ্য একটু উদ্ধত মনে হত। স্মৃতি হাতড়ালেন ১০৬ বছরের বৃদ্ধা ব্রুনহিল্ড পোমসেল। হিটলারের বাঙ্কারে দিন কাটিয়ে আজও জীবিত। অমিতাভ গুপ্ত ব্যবহারটিও ছিল মধুর। শৌখিন, হাতে ম্যানিকিওর করাতেন রোজ। মাঝে মাঝে অবশ্য একটু উদ্ধত মনে হত। স্মৃতি হাতড়ালেন ১০৬ বছরের বৃদ্ধা ব্রুনহিল্ড পোমসেল। হিটলারের বাঙ্কারে দিন কাটিয়ে আজও জীবিত। অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০

জানি কেউ বিশ্বাস করবে না। তবু এটাই সত্যি যে আমি কিছু জানতাম না। কিচ্ছু না’— গত ষাট বছরে একান্তে, নিজের পরিচিতের গণ্ডিতে এ ভাবে নিজের হয়ে কত বার আকুল সওয়াল করেছেন ব্রুনহিল্ড পোমসেল, সেই হিসেব কেউ জানবে না। কিন্তু প্রকাশ্যে প্রথম বার বলেছিলেন গত বছর, তাঁকে নিয়ে তৈরি এক তথ্যচিত্রে। তথ্যচিত্রটির নাম, ‘আ জার্মান লাইফ’। তখন তাঁর বয়স একশো ছয় বছর।

সব ঠিক থাকলে এই বুধবার মিউনিখের বাড়িতে নিজের একশো সাততম জন্মদিন কাটাবেন ব্রুনহিল্ড। নিঃসন্তান, সেটুকুই স্বস্তি। তাঁর উত্তরাধিকার বওয়ার দায় নেই পরের প্রজন্মের। যখন বলেন, ‘একটাই ভাল খবর যে আমাকেও আর বেশি দিন এই দায় বইতে হবে না,’ বোঝা মুশকিল হয়, বিষণ্ণতা নাকি আসন্ন মুক্তির নিশ্চিত আশ্রয়, তার একশো ছয় বছরের ইতিহাস ধরে রাখা বলিরেখাকীর্ণ মুখে কোনটা বেশি ছাপ ফেলে।

নাত্‌সি শীর্ষনেতৃত্বের ঘনিষ্ঠবৃত্তের শেষ প্রতিনিধি এই ব্রুনহিল্ড পোমসেল। ১৯৪৫ সালে, বাঙ্কারে যখন আত্মহত্যা করছেন অ্যাডল্‌ফ হিটলার, আরও কয়েক জনের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত ছিলেন ব্রুনহিল্ড। তার আগে, নাত্‌সি জার্মানির মধ্যগগনে মিনিস্ট্রি অব প্রপাগান্ডা-য় বসে যখন মিথ্যে কথা বলাকে শিল্পের স্তরে তুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন জোসেফ গোয়েব্‌লস, ব্রুনহিল্ড সেখানেও উপস্থিত ছিলেন প্রতি দিন। গোয়েব্‌লস-এর প্রেস বিবৃতি, ভাষণ, সবই তাঁর হাত হয়েই যেত। হিটলারের মিথ্যার স্থপতি জোসেফ গোয়েব্‌লস-এর সেক্রেটারি ছিলেন ব্রুনহিল্ড।

তবুও জানতেন না কিচ্ছু? জানতেন না, কী ভাবে দেশ জুড়ে ইহুদি নিধনে মেতেছেন গোয়েব্‌লস আর তাঁর সর্বাধিনায়ক? জানতেন না, কী ভাবে মিথ্যার পাহাড় গড়ে তোলা হচ্ছে? নিজের এক বান্ধবী, ইভা লোয়েনথল-এর কথা টেনে আনেন ব্রুনহিল্ড। শৈশবের বান্ধবী। ইহুদি ছিলেন ইভা। হিটলারের জার্মানিতে এক দিন আর ইভার সন্ধান পেলেন না ব্রুনহিল্ড। খোঁজ করতে জানলেন, তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এক অন্য প্রদেশে। সেখানে লোকসংখ্যা কম, তাই দেশের অন্য প্রান্ত থেকে বেছে বেছে মানুষ পাঠিয়ে নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে সেই অঞ্চলকে। বিশ্বাস করেছিলেন ব্রুনহিল্ড।

অবিশ্বাস করবেনই বা কেন? তাঁর বস, জোসেফ গোয়েব্‌লসকে যে তিনি সারা জীবন এক জন কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক হিসেবেই চিনে এসেছেন। দারুণ সব স্যুট পরতেন। ছিমছাম, চটপটে। খুঁড়িয়ে হাঁটতেন, তাতে জোসেফের জন্য একটু খারাপও লাগত ব্রুনহিল্ডের। ভাবতেন, এই খামতি ঢাকতেই বুঝি খানিক উদ্ধত জোসেফ। এমনিতে চমৎকার লোক। হাতের আঙুলগুলো ভারী সুন্দর। ‘বোধ হয় রোজ ম্যানিকিওর করাতেন,’ মনে পড়ে যাওয়ায় হাসির আভা ব্রুনহিল্ডের শতাব্দীপ্রাচীন মুখে। বয়স তাঁর দুটো চোখের দৃষ্টিই কেড়ে নিয়েছে। এখন সবই স্মৃতির দৃশ্য।

সেই স্মৃতিতেই ভেসে আসে গোয়েব্‌লস-এর ছেলেদের কথা। সুভদ্র, বাবার অফিসে আসত মাঝেমধ্যেই। হেসে কথা বলত অফিসের কর্মীদের সঙ্গে। মধুর ব্যবহার ছিল গোয়েব্‌লস-এর স্ত্রী ম্যাগডারও। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। বোমা পড়ে ধূলিসাৎ হয়ে গেল ব্রুনহিল্ডের বাড়ি। তাঁকে সান্ত্বনা দিতে একটা নতুন নীল শেভিয়ট উলের স্যুট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ম্যাগডা। ‘আমি জীবনে কখনও অত দামি স্যুট পরিনি। আগেও না, পরেও না’— হাসেন ব্রুনহিল্ড। তিনি বলেন না, কিন্তু বুঝে নেওয়া যায়, এমন চমৎকার দম্পতিকে সন্দেহ করার কোনও কারণ ছিল না।

ফুয়েরারবাঙ্কারে যে দিন তাঁর কাছে খবর এল, হিটলার আর গোয়েব্‌লস দুজনেই আত্মহত্যা করেছেন, বিস্মিত ব্রুনহিল্ড প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আর ম্যাডাম?’ উত্তর এল, ‘তিনিও’। প্রায় রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করলেন ব্রুনহিল্ড, ‘ছেলেরা?’ উত্তর কী আসবে, সম্ভবত অনুমান করতে পেরেছিলেন ব্রুনহিল্ড। বাঙ্কারে লুকিয়ে থাকার প্রতিটা মুহূর্ত তাঁরা টের পাচ্ছিলেন, জীবন পালটে যাচ্ছে অবিশ্বাস্য গতিতে। সেই বদলে যাওয়ার অনিশ্চয়তাকে ভুলে থাকতেই তাঁরা সারা দিন ডুবে থাকতেন মদে। নেশা কাটতে দিতেন না কখনও।

শুধু কি ওই মাটির নীচের বাঙ্কারেই? তার আগে কি নেশায় চুর ছিলেন না তিনি? নয়তো সোফি শোল নামক নাত্‌সি-বিরোধী আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া চরম রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের ফাইল— যে অভিযোগের ভিত্তিতে প্রাণদণ্ড হয়েছিল সোফির— নিঃসংশয়ে লুকিয়ে রাখলেন কেন ব্রুনহিল্ড? কেন খুলে দেখলেন না, কী আছে সেই ফাইলে? ধীর গলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে কয়েকটা কথা বলেন একশো ছয় বছরের বৃদ্ধা। বলেন, ‘আমার কাছে নিজের কর্তব্য অনেক বেশি জরুরি ছিল। আমি ভেবেছিলাম, আমার বস আমায় বিশ্বাস করে ফাইলটা দিয়েছেন, খুলতে বারণ করেছেন। আমি তাঁর বিশ্বাসের দাম রেখেছিলাম।’

বিনা প্রশ্নে বিশ্বাস করে নেওয়া, মেনে নেওয়ারও কি ইতিহাস নেই? ব্রুনহিল্ডের বাবা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গিয়েছিলেন সৈনিক হিসেবে। যুদ্ধ শেষে যখন ফিরে এলেন, ব্রুনহিল্ডের বয়স তখন সাত। বাবা বিশ্বাস করতেন কঠোর শৃঙ্খলায়। শৃঙ্খলাভঙ্গের শাস্তি ছিল বেত্রাঘাত। বাবার হুকুম ছিল, অতএব রাতে ব্রুনহিল্ডের ঘরে চেম্বারপট রাখা বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকারের ভূত আর দত্যি-দানোর ভয় পেরিয়েই যেতে হত বাথরুমে। বিনা প্রশ্নে আদেশ মেনে নেওয়ার সেই শুরু।

শুধু কি ব্রুনহিল্ডেরই অভ্যেস ছিল প্রশ্নহীন আনুগত্যের? না কি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে যে প্রজন্ম বড় হয়েছিল, তারা সবাই ছিল এই আনুগত্যে অভ্যস্ত? ব্রুনহিল্ড বলে চলেন, ‘আমাকে অনেকেই বলেছেন, তাঁরা আমার জায়গায় থাকলে রুখে দাঁড়াতেন। আমি মানতে রাজি নই। আমরা সবাই হিটলারকে বিশ্বাস করেছিলাম। ভেবেছিলাম, তিনি যা করছেন, গোটা দেশের ভালর জন্যই করছেন। সেই সময়টায় আমরা সবাই যেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।’ আজও কথাগুলো শুনলে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়।

ফুয়েরারবাঙ্কার থেকেই রুশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন ব্রুনহিল্ড। পাঁচ বছর কাটিয়েছেন বিভিন্ন সোভিয়েত জেলে। তার পর, মুক্তি। ফের চাকরি পেয়েছিলেন সেক্রেটারি হিসেবেই। রোজগার করেছেন অনেক। কিন্তু, নিজেকে সন্তর্পণে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছিলেন। আর, ভিতরে পুষে রেখেছিলেন এক দীর্ঘ খোঁজ। তাঁর বন্ধু, ইভা লোয়েনথলের খোঁজ।

সন্ধান মিলল ২০০৫ সালে, যখন আউশউইত্‌জ-এর হলোকস্ট মেমোরিয়াল-এর দরজা খোলা হল সাধারণ মানুষের জন্য। আরও অনেকের মতোই ব্রুনহিল্ড গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন লাইনে, বলেছিলেন, তাঁরও এক প্রিয় জন নিখোঁজ। একটা মেশিন তথ্য উগরে দিয়েছিল— ১৯৪৩ সালের নভেম্বর মাসে ইভাকে আউশউইত্‌জ-এ পাঠিয়ে দেওয়া হয়, আর ১৯৪৫ সালে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

ব্রুনহিল্ড দেখেছিলেন, মেশিনটা চলছে অক্লান্ত গতিতে, আর একের পর এক মানুষের তথ্য প্রকাশ করে চলেছে। সেই সব ইহুদিরা, যারা এক দিন হারিয়ে গিয়েছিল হিটলারের জার্মানি থেকে। যে ক্ষমতাকেন্দ্রে বসে তাদের মৃত্যুদণ্ড স্থির করেছিলেন নাত্‌সি নায়করা, তার ঠিক পাশে বসেও কিচ্ছু টের পাননি ব্রুনহিল্ড।

টের পাওয়ার কথা ভাবেনওনি।

ভুল লোককে বিশ্বাস করলে কী মূল্য চোকাতে হয়, মিউনিখের ১০৭ বছরের বৃদ্ধার চেয়ে বেশি খুব কম লোকই জানে।

তথ্যচিত্রের পোস্টারে ব্রুনহিল্ড পোমসেল

Brunhilde Pomsel Joseph Goebbels A German Life
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy