Advertisement
E-Paper

প্রক্সি কয়েদি

এক জন অপরাধ করেছে, কিন্তু তার হয়ে অপরাধ কবুল করে জেল খাটতে গেল অন্য জন। কলেজের মতো, হাজত খাটার ক্ষেত্রেও এমন প্রক্সির নমুনা পাওয়া যায় বাস্তবে, গল্পে, সিনেমায়।মুরলীপ্রসাদ শর্মার হয়ে মেডিকালের এন্ট্রান্সে যিনি বসেছিলেন, তাঁর নাম আসলে ডক্টর রুস্তম পাভরি। হলে ঢোকার আগে সেই জালি ক্যান্ডিডেটকে মাত্র কয়েক মিনিটের মেক-ওভারে কলার-তোলা রংচঙে শার্টের বোতাম খোলা রেখে আর চুল ব্যাকব্রাশ করে স্রেফ একটু মুন্নাভাই-প্রতিম লুক দিতে হয়েছিল। পরীক্ষায় মুন্নাভাই প্রক্সি পেলেও, টাডা-র কেসে অবশ্য সে পথে হাঁটেননি সঞ্জয় দত্ত।

সুস্নাত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৫ ০১:৪৪

১৯৯৯ সালে, বিজনেস স্কুলের পড়ুয়া বিত্তশালী পরিবারের ছেলে সঞ্জীব নন্দার বিএমডব্লিউ কেড়ে নেয় ছ’জনের জীবন। সে ঘটনার আদলেই বছর দুয়েক আগে নির্মিত হয়েছে ‘জলি এলএলবি’। সে ছবিতে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো ও হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত রাহুল দেওয়ানের হয়ে কেস সাজাতে গিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ যথারীতি বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘যত নষ্টের গোড়া’ ড্রাইভারকে। আদালতে সওয়াল করতে গিয়ে জাঁদরেল আইনজীবী সেই যুক্তিতেই যাবতীয় অভিযোগ নস্যাৎ করে দিতে চাইছেন। শেষমেশ এই মিথ্যাচার ব্যর্থ হচ্ছে দূর গ্রামে পড়ে থাকা এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে। সেই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে তিনিই একমাত্র জীবিত, অথচ পুলিশ রেকর্ড-মতে আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে!

দুর্ঘটনার পর মালিকের হয়ে প্রক্সি দিতে রাজি হয়েছেন এমন ‘সৎ’ ড্রাইভার চলচ্চিত্র আরও দেখেছে। তুরস্কের ছবি ‘থ্রি মাংকিজ’। থমথমে ছবিটি শুরুই হয় একটি গাড়ি দুর্ঘটনা দিয়ে। বিত্তশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতা সার্ভেট ফিরছিলেন নির্বাচনী প্রচার সেরে। ক্লান্ত শরীরে, বুজে আসা চোখে ড্রাইভ করছিলেন নিজেই। সহসা দুর্ঘটনা। এক পথচারীর মৃত্যু। ভয় পেয়ে পালালেন সার্ভেট। ভোটের মুখে এ খবর জানাজানি হলে তাঁর ভরাডুবি নিশ্চিত, অগত্যা মাঝ রাতে ঘুম-ভাঙানিয়া রিং-টোন বেজে উঠল ড্রাইভার এয়ুপ-এর ফোনে। মনিবের কথা মতো ছুটে গেলেন এয়ুপ। সার্ভেট বোঝালেন, মোটে তো মাস ছয়েক, বড়জোর এক বছরের মামলা; তার পর জেল থেকে বেরোলেই মোটা বকশিশ। এই ‘ডিল’ মেনে জেলে ঢুকলেন এয়ুপ। ন’মাসের কারাবাস। তারই মধ্যে সার্ভেটের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন এয়ুপের স্ত্রী। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময়ও ঘরের পরিস্থিতিটা স্পষ্ট ছিল না এয়ুপের কাছে। হঠাৎই তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর ডাক পড়ল থানায়। পুলিশ জানাল, সার্ভেটকে হত্যা করা হয়েছে। অতঃপর ছবির শেষাংশটি এক আশ্চর্য বৃত্ত সম্পূর্ণ করে। ছেলে ইসমাইল মা’কে জানায়, খুনটি সে-ই করেছে। এয়ুপ তখন এক হতদরিদ্র ব্যক্তিকে বেছে নেন, তাঁকে সেই কথা বলেন, এক রাতে তাঁকে যা বলেছিলেন তাঁর মনিব। নিজের ছেলের অপরাধ অন্যের কাঁধে তুলে নেওয়ার প্রস্তাব রাখেন হতভাগ্য এয়ুপ।

শুধুই টাকার লোভ নয়, কখনও আরও বড় কিছুও হয়তো থাকে অন্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অপরাধী সাজার এই খেলায়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে ‘আমি সে ও সখা’ সিনেমাটি হয়েছিল সত্তরের দশকে। সে ছবিতে দেখি, অর্থের মোহে ভুল করে ফেলা বন্ধু প্রশান্তকে (অনিল চট্টোপাধ্যায়) বাঁচাতে পুলিশের হাতে নিজেকে সঁপে দিচ্ছেন নির্দোষ সুধীর (উত্তমকুমার)। সাত বছর সশ্রম কারদণ্ডের আদেশ হাসিমুখে মেনে নিচ্ছেন। এর মূলে কি সুধীরের বড় হয়ে ওঠায় প্রশান্তর পরিবারের যে ভূমিকা, সেই ঋণশোধ; না কি প্রকৃত বন্ধুত্বের চিরন্তন কোনও সংজ্ঞা! কোন পরিতৃপ্তির বশে পারে এক জন মানুষ, অন্যের কালির দাগ নিজের শার্টে লাগাতে? এ ছবিই যখন হিন্দিতে বানান হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, সেই ‘বেমিসাল’-এও এ সব প্রশ্নই জেগে ওঠে। অমিতাভ বচ্চনের লিপে যেখানে কিশোরকুমার গেয়ে ওঠেন— ‘মুঝে দোস্তোঁ সে শিকায়ত হ্যায় শায়দ, মুঝে দুশমনো সে মহব্বত হ্যায় শায়দ’। এমনকী খলনায়কের মতো কাজকর্মে, চোখমুখের তেমনই রিঅ্যাকশনে দর্শককে বোকা বানাতে চান, আর বন্ধুকে বাঁচাতে মিথ্যে কাগজপত্র বানিয়ে নিয়ে থানায় এসে সব দোষ নিজের ঘাড়ে তুলে নেন অমিতাভ। পুলিশ তাঁকে ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট’ বললে, জবাব দেন ‘থ্যাংক ইউ’।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সোনাই আর পরি-র ট্র্যাজিক প্রেমের ছবি ‘মনপুরা’-র কাহিনিও শুরু হয় এমনই এক অপরাধ ও তার দায়ভার গ্রহণে নিরপরাধ কাউকে রাজি করানোর মধ্যে দিয়ে। গাজি সাহেবের মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে গভীর রাতে একটি খুন করে বসে। ছেলেকে বাঁচাতে অপরাধী সাজিয়ে বাড়ির কাজের লোক সোনাই-কে দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সুদূর দ্বীপেও তার সন্ধান পেয়ে যায় পুলিশ। সোনাইয়ের জেল হয়। মনিবের পরিবারকে রক্ষা করতে কয়েক মাসের এই অভিনয় সে মেনে নিয়েছিল, কিন্তু বদলে তার গোটা জীবনটাই ক্রমশ ছারখার হয়ে যায়। ‘অল্প বয়সে পিরিতি করিয়া, হয়ে গেল জীবনেরও শেষ।’ তার মনের মানুষ পরি-র সঙ্গেও ছেলের বিয়ে দিয়ে দেন গাজি সাহেব। জামিনে ছাড়া পেয়ে সোনাই যে দিন ফেরে একটি বার পরিকে দেখার জন্য, জানতে পারে সে আত্মহত্যা করেছে। একই বিয়োগান্ত কাহিনি নিয়ে এই বাংলাতেও ছবি বানিয়েছেন অঞ্জন দাস। ‘অচিন পাখি’।

শুধুই জল-মাটি-বাতাসের নরম আবহে নয়, বিরল হলেও এমন সহজ মানবিক অবস্থানের দেখা মেলে অর্থ, ক্ষমতা আর ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’-এ প্যাঁচানো ঝাঁ-চকচকে কর্পোরেট ড্রয়িংরুমেও। মধুর
ভান্ডারকর-এর ‘কর্পোরেট’-এ নিশিগন্ধা দাশগুপ্ত (বিপাশা বসু) বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন সেহগল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ-কে। কোম্পানিকে ধসের হাত থেকে রক্ষা করতে গেলে সেহগল পরিবারের বাইরের কাউকে বিরাট কেলেঙ্কারির দায় নিতে হত। রাজি হয়ে যান সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট নিশি। টাকার লোভ নয়, সংস্থার স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই এ সিদ্ধান্ত ছিল তাঁর। এর পর এনকোয়ারি কমিশন তাঁকে হেফাজতে নেয়। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও, অন্য রকম বোঝাপড়া হয়ে যায় উপরমহলে। বলির পাঁঠা হন নিশি।

তবে, সবচেয়ে বিস্ময় জাগে যখন ব্যক্তিগত স্বাের্থর কথা না ভেবে দাগি ক্রিমিনালরাই এই মানবিকতার শরিক হন। জরাসন্ধর ‘লৌহকপাট’-এ এমনই এক চরিত্র বদরউদ্দীন মুন্সী। সে এক দুর্ধর্ষ ডাকাত। সে দিন ছিল এক বিত্তশালী সীতানাথ দত্তের মেয়ের বিয়ে। রাতে আক্রমণ করল তার ডাকাত দল। টাকাপয়সা সোনাদানা নিয়ে ফেরার পথে বদরউদ্দীনের চোখে পড়ে গেল তেতলার বন্ধ ঘরে লুকিয়ে রাখা ফুটফুটে কনেটি। গায়ে অন্তত হাজার দশেক টাকার জড়োয়ার গয়না। বদরউদ্দীনের শরীর থেকে তখন লোভ নামক বস্তুটি ক্রমশ উধাও হয়ে যাচ্ছে। বদলে ভেসে উঠছে তার আদরের নূরজাহানের মুখ— আট বছর আগে যে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল সে, তার পর আর যে-মেয়ে ফিরে আসেনি। সেই কনের দামি গয়নায় হাত ছোঁয়াতে না পেরে ছুটে বেরিয়ে আসে বদরউদ্দীন। খানিক পরে আবার ফিরে গিয়ে দেখে তারই দলের এক জন মেয়েটিকে ধর্যণ করেছে। তার সদ্যবিবাহিত স্বামীকে খুন করেছে। বদরউদ্দীনের সব কিছু গুলিয়ে যায়। সে দিনই দুর্বল কিছু বরযাত্রী তাকে ধরে ফেলে। তার পর অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতাল। সেখানেই হাকিম ডেকে স্ব-ইচ্ছায় সে জবানবন্দি দেয়। জানায়, সে-ই এই খুন ও ধর্ষণ করেছে। এর পর জরাসন্ধ বলছেন, ‘একটা কথা শুধু বুঝতে পারছিনে। অপরাধী তার কৃত-অপরাধ স্বীকার করেছে, এটা নতুন নয়, অদ্ভুত কিছুও নয়। কিন্তু যে-অপরাধ সে করেনি, তারই বোঝা স্বেচ্ছায় নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়ে হাকিম ডেকে হলপ করে বলেছে, এটা আমি করেছি— এরকম তো কখনো শুিননি। এর মধ্যে বাহাদুরি থাকতে পারে, কিন্তু একে সৎসাহস বলে না।’

আজকের দুনিয়াতেও এমন প্রক্সি হরবখত ঘটে চলেছে। তা সে কলেজের গার্জেন কলে ভাড়াটে বাপ-মা নিয়ে গিয়ে প্রিন্সিপালের ভর্ৎসনা খাওয়ানোই হোক, বা কলকাতার পাতাখোরদের ভাষায় ‘পাঁচাইন’ কেসে অন্যের হয়ে দু-তিন দিনের জন্য জেল খাটাই হোক। ডেলি তিন-চারশো টাকায় রোজগার তাতে মন্দ না! বিহারেও নাকি কেউকেটাদের হয়ে জেলে ‘দাখিল’ হতে নির্দিষ্ট লোক পাওয়া যায়। জেল খাটাই নাকি তাদের পেশা। শোনা যায়, বাংলাদেশেও নাকি চার-পাঁচ বছর, এমনকী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কেসেও নকল আসামির সন্ধান মিলেছে। এককালীন দু’লক্ষ ও মাসিক পাঁচ হাজার টাকা চুক্তিতে বছর কয়েক আগেই একটি ধর্ষণের মামলায় যাবজ্জীবনের প্রক্সি দেওয়া শুরু করেন ঢাকার এক রিকশাওয়ালা। পরে ধরাও পড়ে যান। আবার দিনাজপুরের যে সব এলাকায় বেআইনি মাদকচক্রের রমরমা, সেখানেও নাকি এমন লোক আছে, কেউ মাদক সংক্রান্ত মামলায় ফাঁসলে, তাঁর হয়ে ‘প্রফেশনালি’ জেল খেটে দেন। বাস্তবের এই দুনিয়াকে বিলক্ষণ চিনত, কাজেই ‘হযবরল’-র ন্যাড়া কোনও দিনই বোকা ছিল না। আসামি নেই দেখে তাকে যখন ভুলিয়ে-ভালিয়ে দাঁড় করানো হয়েছিল, সে যথার্থই ভেবেছিল, ‘আসামীরাও বুঝি পয়সা পাবে, তাই সে কোনো আপত্তি করল না’!

susnatoc@gmail.com

Susnata Chowdhury proxy prisoner Munna Bhai salman khan Hit and run Criminal Susnato chowdhury
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy