Advertisement
E-Paper

হরিপুরের হরিবাবু

হরিপুরের হরিরাম চক্রবর্তী সুবিখ্যাত কৃপণ ছিলেন। আশপাশের পাঁচটা গ্রামের মানুষ তা জানত, তাই তারা তাঁর নাম মুখে আনত না। বলত, যা কিপটে লোক ওর নাম করলে আজ হয়তো খাওয়াই জুটবে না!

শৈবাল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৬ ০০:০০
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

হরিপুরের হরিরাম চক্রবর্তী সুবিখ্যাত কৃপণ ছিলেন। আশপাশের পাঁচটা গ্রামের মানুষ তা জানত, তাই তারা তাঁর নাম মুখে আনত না। বলত, যা কিপটে লোক ওর নাম করলে আজ হয়তো খাওয়াই জুটবে না!

হরিরাম পূজারি ব্রাহ্মণ ছিলেন। লোকের বাড়ি পূজাআর্চা করে মন্দ রোজগার হত না তাঁর। নগদ দক্ষিণা ছাড়া যজমানরা চালডাল ইত্যাদি দিত, সেটা ছিল উপরি লাভ।

এ ছাড়া হরিবাবু সন্ধেবেলায় তাঁর বাড়িতে পাঠশালার ছেলেদের অঙ্ক শেখাতেন। খুব হিসেব করে চলতেন বলে যোগ বিয়োগে পোক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর কাছে অঙ্ক শিখে ছাত্ররা দুর্দান্ত ফল করত পরীক্ষায়। সে বাবদও দু’পয়সা আয় হত তাঁর।

আয় যতই করুন হরিবাবু ব্যয়ের ব্যাপারে তাঁর ছিল কড়া নজর। একটা গোটা দিনে কোনও পয়সা খরচ না হলে বেজায় খুশি হতেন তিনি। রাতে শোওয়ার সময় বলতেন, ‘আজ একটি পয়সাও খরচ হয়নি সারা দিনে, রাতে সুনিদ্রা হবে।’

স্ত্রী বলতেন, ‘দেখো, আবার জোরে নাক ডেকো না, তা হলে দেওয়ালের চুনবালি খসে পড়বে। মেরামত করতে খরচ হবে বিস্তর।’

হেসে হরিরাম বলতেন, ‘পাগল, এই দেখো না কী ব্যবস্থা করি!’ নাকের ওপর একটা মোটা বালিশ চাপা দিয়ে দেন তিনি, যাতে নাক ডাকলেও বাইরে সে আওয়াজ না বেরোয়।

বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স হবে হরিবাবুর। রোগাপাতলা গড়ন, মাথায় কাঁচাপাকা চুল। খরচ বাঁচাতে মাসে এক বার দাড়ি কামান।

হরিবাবুর এমন ধারা স্বভাব হলেও তাঁর বাবা কিন্তু অন্য রকম মানুষ ছিলেন। বাউল গান করে যা রোজগার করতেন কিপটেমি না করে তা সব সংসারে খরচ করতেন। সাধ্যমত দানধ্যানও করতেন। ছেলের যে হাত দিয়ে জল গলে না, তা সে একটু বড় হতেই বুঝেছিলেন বাবা। ছেলেকে বলতেন, ‘অত হিসেব করে চলা কিন্তু ঠিক না। বেহিসেবি হওয়া ঠিক না কিন্তু নিজেকে কষ্ট দিয়ে পয়সার পাহাড় তৈরি করতে গেলে আখেরে লোকসানই হয়।’

স্বভাবে কৃপণ হলেও নিজের মেয়েকে খুব ভালবাসতেন হরিবাবু। মেয়ে আর তার তিন বছরের ছেলে মানিকও ছিল তাঁর ভারী প্রিয়। টানা এক মাস সেই মেয়ের কোনও খবর পাচ্ছিলেন না হরিবাবু, তাই ভারী উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন তিনি।

তখন গ্রামে টেলিফোন ছিল না, ডাকে চিঠি দিলে তা পৌঁছতে এক-দেড় মাস লেগে যেত। এর মধ্যে এক দিন মেয়ের গ্রামের এক জন এসে বলল তাঁর মেয়ে ময়নার জটিল অসুখ, তার ছেলেটিও জ্বরে ভুগছে।

শুনে হরিবাবু খুব মুষড়ে পড়লেন। তাঁর স্ত্রী বললেন, ‘তুমি এক দিন নিজে চলে যাও না বাপু, চার ক্রোশ তো মোটে পথ, গিয়ে দেখে এসো না এক বার। তাতে তোমারও বুক জুড়োবে, মেয়েটাও শান্তি পাবে।’

হরিবাবু বললেন, ‘ঠিক বলেছ, কালই এক বার ঘুরে আসব মৌড়িগ্রাম থেকে।’

পর দিন সকালে এক যজমানের বাড়ি তার মায়ের শ্রাদ্ধ করে ভাল দক্ষিণা পেলেন হরিরাম। নগদ টাকা ছাড়া চাল, ডাল, ফলমূলের বড়সড় সিধে। মনে দারুণ ফুর্তি তাঁর। বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে বললেন, ‘এখনই এক বার ঘুরে আসি ময়নার বাড়ি থেকে। দেখে আসি কেমন আছে মেয়ে আর নাতি।’

চৌকির ওপর চালডালের রাশ গুছিয়ে রাখতে রাখতে স্ত্রী বললেন, ‘যেতে গেলে তো মিষ্টি নিতে হয়। সে তো এক খরচ।’

একগাল হেসে হরিরাম বলেন, ‘মিষ্টি নিতে যাব কোন দুঃখে। ওই যে শিষ্যবাড়ি থেকে পাকা তাল দিয়েছে একটা ওটাই নিয়ে যাই হাতে করে। আমি তো আর মেয়ের বাড়ি ঢুকব না, জানলা দিয়ে ওদের দেখে দুটো কথা বলে চলে আসব।’

স্ত্রী বললেন, ‘তুমি আবার বাসে চাপতে যেয়ো না যেন। শুনেছি নাকি এক টাকা করে ভাড়া নেয় ওরা।’

‘পাগল নাকি’ হরিরাম হাসেন, ‘আমি কী করে কোথাও যাই বলো তো? বোসেদের একটা পাগলা কুকুর আছে না, আমি সেটাকে একটা ঢিল ছুড়ে মারি— ও তাড়া করে আমায়, আমি পৌঁছে যাই যেখানে যাওয়ার।’

স্ত্রী বললেন, ‘সত্যি, তোমার তুলনা নেই।’

ভাঁড়ার ঘরের চৌকির ওপর শ্রাদ্ধবাড়ি থেকে পাওয়া জিনিসপত্রের দিকে তাকিয়ে গদগদ হয়ে স্ত্রী বলেন, ‘সত্যি জিনিস দিয়েছে বটে, তোমাকে আর দু’সপ্তাহ বাজার করতে হবে না।’

খুশিতে ডগমগ হরিরাম বলেন, ‘সেই আনন্দের জোয়ারে ভাসতে ভাসতেই তো আমি পাড়ি দেব এতটা পথ, চলি।’

কিন্তু হরিবাবুর কপাল মন্দ। বোসেদের কুকুরটার সে দিন মেজাজ খুব খারাপ ছিল। হরিবাবু তাকে একটা আধলা ছুড়ে মারতেই সে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তাড়া করল তাঁকে। হরিরাম ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিলেন। এক বার তার খপ্পর থেকে বাঁচবার জন্যে একটা বাবলা গাছে চড়ে বসলেন, তাতে তাঁর হাত-পা ছড়ে যেতে ওপর থেকে দিলেন লাফ একটা গর্তে। তাতে ডান হাঁটুতে পেলেন বেজায় চোট। সেখানে আবার ছিল বিছুটির জঙ্গল। হরিবাবু গা হাত চুলকোতে চুলকোতে যখন পৌঁছলেন মেয়ের বাড়ি তখন দেখলেন তার সদর দরজায় পেল্লায় এক তালা ঝুলছে। পাড়ার লোককে জিজ্ঞেস করতে এক জন বলল, ‘ওরা কুটুমবাড়ি গেছে।’

খিদে তেষ্টায় আধমরা হরিরাম যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তাঁকে দোর খুলে দিয়ে একটা হাই তুলে স্ত্রী বললেন, ‘এই তো ওরা গেল, মেয়ে জামাই, বেয়াই, বেয়ান আর দুটো কাজের লোক। বাবা, লোক দুটো কী খায়! আমায় দু’বার ভাত বসাতে হল।’

থতমত খেয়ে হরিরাম বললেন, ‘মানে?’

মানে আবার কী! শ্রাদ্ধবাড়ি থেকে পাঠানো অত জিনিসের রাশ দেখে বেয়ান বললেন, ‘বাব্বা, এত ভাল ভাল জিনিস! আজ না খেয়ে যাচ্ছি না আমরা।’

আর্তস্বরে হরিবাবু বললেন: তা হঠাৎ এখানেই বা এল কেন ওরা?

‘মেয়ের শক্ত অসুখ হয়েছিল’ স্ত্রী বলেন, ‘সেরে যেতে বড়কালীতলায় পুজো দিতে এসেছিল রাতভর উপোস করে, তা সে মন্দির থেকে আমাদের বাড়ি আর কতটুকু, তাই ঘুরে যাওয়া।’

‘সব সাফ!’ ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ভেতরে নজর ফেলে হরিবাবু বললেন।

‘সব’, স্ত্রী বলেন, ‘তোমাকে যে একটা বাতাসা দিয়ে এক গ্লাস জল দেব তা-ও নেই?’

পরক্ষণে তাঁর হাতের দিকে তাকিয়ে স্ত্রী বলেন, ‘তা তুমি যে পাকা তালটা হাতে করে নিয়ে গেলে সেটা কোথায়?’

‘আর তাল’, মাথায় হাত দিয়ে হরিরাম বলেন, ‘কুকুরটা আজ বেজায় খেপে ছিল। ওকে ওটা ছুড়ে মেরেছিলাম প্রাণে বাঁচতে। তাকও ফসকালো, আর তালটা সোজা গিয়ে পড়ল মিত্তিরদের পানাপুকুরে। এখন এই হাঁটুর ঘা সারাতে কত খরচা হয় কে জানে!’

কথা শেষ করে ধপ করে বসে পড়েন তিনি ফাঁকা চৌকিটার ওপর। বসে হঠাৎই চোখ পড়ে সামনের দেওয়ালে টাঙানো বাবার ছবির ওপর, মনে পড়ে বাবার কথা, ‘খুব বেশি হিসেব করে চললে কিন্তু লাভের গুড় পিঁপড়েয় খায়, তার চেয়ে কিছু দিয়েথুয়ে নিজে আর অপরকে আনন্দ দিয়ে বেঁচে থাকাই বোধ হয় বুদ্ধিমানের কাজ।’

হরিবাবুর মনে হয় বাবা যে হক কথা বলতেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy