Advertisement
E-Paper

স্মৃতির রাক্ষস এবং আরব্য রজনী

ঘুম ভাঙতেই বুঝতে পারলাম, সব ভুলে গেছি। এমন আগেও হয়েছে কয়েক বার। হালে একটু বেশি হচ্ছে। কখন, কোথায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেটা ভাবার চেষ্টা করেও লাভ নেই, মনে পড়বে না। ভিডিয়ো টেপ-টা অনেকখানি পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে আবার প্লে করলে ছবি আসার সম্ভাবনা থাকে। এর আগে তাই করেছিলাম। প্রথম দিকে একটু ফ্লিকার করলেও পরে ছবিটা আবার চলতে শুরু করেছিল তরতর করে। এক সময় দেখতাম সব মিলে যাচ্ছে।

শুভময় মিত্র

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৫ ০০:০৩
ছবি: শুভময় মিত্র।

ছবি: শুভময় মিত্র।

ঘুম ভাঙতেই বুঝতে পারলাম, সব ভুলে গেছি। এমন আগেও হয়েছে কয়েক বার। হালে একটু বেশি হচ্ছে। কখন, কোথায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেটা ভাবার চেষ্টা করেও লাভ নেই, মনে পড়বে না। ভিডিয়ো টেপ-টা অনেকখানি পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে আবার প্লে করলে ছবি আসার সম্ভাবনা থাকে। এর আগে তাই করেছিলাম। প্রথম দিকে একটু ফ্লিকার করলেও পরে ছবিটা আবার চলতে শুরু করেছিল তরতর করে। এক সময় দেখতাম সব মিলে যাচ্ছে। এই যে বসে আছি, চার পাশে যা যা দেখতে পাচ্ছি, সেগুলোও দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থায় ভিডিয়োটা বন্ধ করে দিই। কারণ, এর পরে যা হবে সেটা দেখাতে থাকলে মুশকিল হতে পারে। ভবিষ্যৎকে আমি খুবই ভয় পাই। এই অবস্থায় আর একটা ব্যাপার ঘটে। লুজ কানেকশন থাকা বাল্‌ব যেমন অকারণে বারবার জ্বলে ওঠে অল্প সময়ের জন্য, তেমনই টুকরো দৃশ্যের স্মৃতিও ফ্ল্যাশ করে যায় একটুখানি। তাকেই খামচে ধরে নিজেকে টাইমলাইনে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। বিশেষ সুবিধে হয় না। ক্লান্ত হয়ে পড়ি।

পাশেই পড়ে থাকা দেশলাইয়ের বাক্সের লেবেলে অল্প ইংরিজি ছাড়াও অন্য ভাষার নকশা, সঙ্গে এক রাজপুরুষের ছবি। মনে পড়ল, ভাষাটা অ্যারাবিক, ব্যস ওইটুকুই। জানলার বাইরে সারি সারি গাছ। একটু উঠে বসতেই দেখতে পেলাম বহু দূর পর্যন্ত ফাঁকা। একটা পেট্রল পাম্প। তার পাশ দিয়ে হাইওয়ে, সাঁ সাঁ করে গাড়ি, ট্রাক যাচ্ছে। চিনতে পারলাম রাস্তাটা, মনে পড়ে গেল সেটা সিক্স লেন, ব্যস ওইটুকুই। সঙ্গে সঙ্গে ধড়মড় করে উঠে জানলা দিয়ে নীচে তাকালাম। একটা হুন্ডাই ইলানট্রা ব্যাক করে পার্কিং লটে ঢুকছে সাবধানে। আমি জানি, আমাকেই নিতে এসেছে। কোথাও একটা যাব। খাটের পাশে ট্রলি ব্যাগটা গোছানোই আছে। নিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এলাম লিফ্‌টে। লাল আলো জ্বলা সংখ্যা বদলে যাওয়া দেখে মনে হল রিওয়াইন্ড শুরু হয়ে গেছে। শূন্যতে পৌঁছলেই সব মনে পড়ে যাবে। পড়ল না। ড্রাইভারকে চেনা লাগল, সে পাকিস্তানের লোক, হাসল, আমার ব্যাগটা তুলে নিল হাতে। আমি ডুবে গেলাম পিছনের সিটে। হাইওয়েতে পড়ে যেন উড়তে শুরু করলাম। কাঁটা একশো চল্লিশ ছাড়াচ্ছে নির্বিকার স্তব্ধতায়; দেখে বাইরে তাকালাম। রাস্তার পরেও অনেকখানি ফাঁকা জায়গা, এর সামান্য অংশও যদি আমার মাথার মধ্যে থাকত তা হলে বর্তে যেতাম। বাড়ি চোখে পড়ছে না তেমন, শুরু হচ্ছে দুর্গের মতো প্রাচীর। চলেছে তো চলেছেই। কত বড় প্রপার্টি কে জানে। জবরদস্ত সিংহদুয়ার। আবার প্রাচীর। ভেতরে ধারালো পাতার গাছ, আসল বসতবাড়ি দেখার উপায় নেই। ঝড়ের মতো পেরিয়ে যাচ্ছে শপিং মল, ঝলমলিয়ে উঠছে কাচের প্যানেল, নিয়ন সাইন। গত কাল এমন একটায় ঢুকেছিলাম। দোকান তো নয়, যেন এক-একটা অ্যাটমিক রিঅ্যাকটর। স্লো মোশনে হাঁটছেন দীর্ঘদেহী, শক্তিশালী পুরুষরা, অতি শুভ্র সাদা আলখাল্লা পরা, মাথায় লাল বেড় দেওয়া মধ্যপ্রাচ্যের সিম্বল। সঙ্গে একাধিক কালো বোরখা-মোড়া সঙ্গিনীরা। তার মধ্যেও আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে রহস্যময় শরীরের। চোখে গাঢ় কালো কাজলের পাড়, চোখাচোখির প্রশ্নই উঠছে না। আর আছে নীল-গোলাপি পিংপং বলের মতো লাফানো ঝাঁপানো ছোটরা, সারা দুনিয়ায় এরা একই রকম ভাবে হাসে। আরিফ, আমার ড্রাইভার বলছিল, ‘দোকানে ঢুকলে মহিলারা এক শেল‌্ফ কোল্ড ক্রিম কিনে ফেলবে, ভয়ানক খরচ করাই রীতি। কেন? অনেকগুলো বউ। বড় বউয়ের হাতেই সংসারের রাশ। বেশি টাকা, যত ওড়াবে, পরের বউদের হাতে ততই কম থাকবে। এমনই দস্তুর।’ প্রথম বিশ্বের উপচে পড়া কনজিউমারিজম-এর সঙ্গে সামাজিক ঠাটবাট বদলানোর কথা। অন্তত পোশাকটা বদলে যাওয়ার কথা এত দিনে। ‘আমাদের সঙ্গে এদের গুলিয়ে ফেলো না’, হাসল আরিফ। আমাদের, অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান প্রায় একই ব্যাপার। এই আরব দুনিয়ার রূপকথা অন্য ভাষায় লেখা, সে ভাষার বাঁধুনি বড়ই বজ্রকঠিন। খুবই কড়া ঘেরাটোপ, বোঝা সহজ নয়, দরকারও নেই। চওড়া র‌্যাডিয়াল টায়ারগুলো যে রাস্তাকে পিষে চলেছে প্রতি মুহূর্তে তার নীচে শুধু পেট্রলিয়াম নয়, আরও অনেক গরম খনিজের হলকা। সাদা অথবা কালোতে শরীর ঢেকে রাখতেই হয়, উপায় নেই। এক বার খুলে ফেলার চেষ্টা করলেই জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে ছাই করে দেবে আপাত শান্ত অথচ ভয়ংকর শক্তিশালী আরব দুনিয়া। টের পেয়েছে রাশিয়া। ক্ষতবিক্ষত হয়েছে আমেরিকা। ভুলেও ছায়া খোঁজেনি চায়না।

হঠাৎ খেয়াল করলাম গাড়িটা লেফ‌্ট হ্যান্ড ড্রাইভ। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম, আমি কোথাও যাচ্ছি না, আসলে ফিরছি। এটা রিওয়াইন্ড হচ্ছে। একেবারে যে ভাবে এসেছিলাম সে ভাবেই ফিরছি। কিছু ক্ষণের মধ্যেই এয়ারপোর্ট এসে যাবে। অ্যারাইভালের বদলে ঢুকব ডিপার্চারে। কী যেন নামটা?

মাসকাট নামটা চোখে পড়তেই হাই স্পিডে একটা ফাস্ট ফরওয়ার্ড, রিওয়াইন্ড হয়ে গেল মাথার মধ্যে। মনেও পড়ে গেল, আমি এসেছিলাম ওমানের একটা বন্দর শহরে কাজ করতে, কয়েক দিনের জন্য। কিন্তু এইটুকুই। কোথায় আমার দেশ, কী নাম তার কে জানে। প্লেনের টিকিটে নিশ্চয়ই লেখা আছে সব। দেখলাম না। কখন মনে পড়ে, সেটার জন্য অপেক্ষা করব ঠিক করলাম। সিকিয়োরিটি চেক করে প্লেনে উঠে পড়লাম। বোরখা পরা মেয়েরাও উঠল। আমার সিটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সুন্দর গন্ধ পেলাম। মাঝরাতে দিল্লি। ভোরবেলা অন্য প্লেন। আরব দুনিয়া থেকে ফেরা বহু লোক পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে উঠেছে, কলকাতা যাবে, অথবা ঢাকা। বিদেশ ফেরত বলতে সফিস্টিকেশনের যে ছবিটা ভাসে, নামগন্ধ নেই।

বিশাল ড্রিমলাইনার ছাড়ল সময়মত। সিটবেল্ট খোলা যেতে পারে, ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল হইচই। সিট থেকে উঠে পড়েছে কয়েকটা মেয়ে, ঝপাঝপ বোরখা খুলে ফেলেছে, বেরিয়ে পড়েছে টাইট অথচ খোলামেলা জামা। দমাদ্দম ছবি তোলা চলছে মোবাইল দিয়ে, হাহা-হিহি। কারা এরা?

এয়ারহোস্টেসরা এল। ছোট বাদামের প্যাকেট ধরিয়ে দিল হাতে। পেয়েই কটরমটর করে খেতে শুরু করলাম। বুঝতে পারছিলাম হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির কালো পরদা এ বারে সরে যাবে। চা, কফি, সফ্‌ট ড্রিংকস, কী নেব জানতে চায় এয়ারহোস্টেসরা, ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে। থাকে, কিন্তু সরাসরি মদের কথা কেউ বলে না। এখানে অন্য ব্যাপার। ‘হুইস্কি, হুইস্কি’ বলতে বলতে আসছে এয়ারহোস্টেসরা, নির্বিকার মুখ করে। সবাই নিচ্ছে, যদিও সময়টা ব্রেকফাস্টের। প্লেনের ডানায় সোনালি আলো লেগেছে। ছড়িয়ে পড়ছে গলে যাওয়া উত্তাপ, ভীষণ ঠান্ডা রুপোলি মেটালে। আমাকে দেখেই, কোনও কথা না বলেই হুইস্কি সোডা দেওয়া হল, সেখানেও সোনালি রং ধরেছে, বুদ্বুদ উঠে আসছে তলা থেকে।

আমারও স্মৃতি ফিরবে ফিরবে করছে, ঘুমচোখে চোঁ করে মেরে দিয়ে আবার তাকালাম পুকুরে ফিরে যাওয়া হাঁসেদের মতো প্লাস্টিকের তৈরি অপ্সরাদের দিকে। চোখাচোখি হল। কপট বিস্ময়ে, নরম প্রশ্রয়ে, সে আলতো করে নামিয়ে দিল আরও এক গ্লাস স্মৃতিসঞ্জীবনী। ক্লান্ত আমার লোভী জিভটা তাকে স্পর্শ করতেই ছাড়া পেল রক্তের ট্র্যাফিক, নষ্ট মাথার এক্সপ্রেসওয়েতে।

suvolama@gmail.com

travel Subhomoy Mitra video petrol pump
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy