Advertisement
E-Paper

একটা ভয় কষ্ট লজ্জা

মে ন রোডের ওপর বাড়ি। সারা ক্ষণ পিলপিল লোক যাতায়াত। বাস-ট্রামের আওয়াজ, ফিরিওয়ালা, কাগজওয়ালার নিত্য হাজিরা। বাড়ির সামনে জমজমাট পুজো। লোকারণ্য, নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা, অ্যাক্সিডেন্ট বা চোর ধরা ঘিরে জনতা— ভাবতাম, ক্রাউড আমার চেনা।

শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৬ ০০:০০

মে ন রোডের ওপর বাড়ি। সারা ক্ষণ পিলপিল লোক যাতায়াত। বাস-ট্রামের আওয়াজ, ফিরিওয়ালা, কাগজওয়ালার নিত্য হাজিরা। বাড়ির সামনে জমজমাট পুজো। লোকারণ্য, নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা, অ্যাক্সিডেন্ট বা চোর ধরা ঘিরে জনতা— ভাবতাম, ক্রাউড আমার চেনা।

সে ধারণা চুরচুর হয়ে গেল গত বছর পুজোয়। ঠাকুর দেখতে চিরকালই বেরিয়েছি। ভিড় আমার অচেনা নয়। সবাই যেমন বিরক্ত হয়ে ওঠে, আমি তত হই না। ভিড়ের বাড়াবাড়ি আনন্দকে একটু ছাড় দিয়ে দিই। কিন্তু গত পুজোর ভিড় দেখে প্রথম থেকেই মন সায় দেয়নি। আপনা থেকে সরে দাঁড়িয়েছি। ঠাকুর দেখতে ঢুকিনি। অচেনা ঠেকে এই ক্রাউড। কেমন যেন মত্ত মতন। মনকে বলি, ওরে তুই বুড়ি হয়ে যাচ্ছিস। দূর হয়ে যাচ্ছিস পরিচিত থেকে। মেনে নে, মেনে নে।

সপ্তমীর দিন। দক্ষিণ কলকাতায় রোশনাই নেমেছে, দিনের আলো ক্রমশ কমিতেছে। বাচ্চা-বুড়ো সবাই মিলে ঠাকুর দেখতে যাচ্ছি। হঠাৎই একটা হইহই রইরই শব্দ। ঘুরে দেখি এক বিরাট গ্যাং। সব উনিশ-কুড়ির ছেলেমেয়ে। দল বেঁধে বেরিয়েছে। এ ওর পেছনে লাগছে, অকারণে হাসছে। আমি ওদের জায়গা দেওয়ার জন্য বাবার হাত ধরে একটু সরিয়ে আনার চেষ্টা করলাম। পাছে বাবার লেগেটেগে যায়।

এবং পরের মুহূর্ত থেকে বিভীষিকা শুরু। বয়স্ক বাবার থতমত সরে আসাটা ওদের কাছে একটা বিরাট মজার জিনিস হয়ে দাঁড়াল। সবাই মিলে এ ওকে ঠেলে, গায়ে পড়ে আমাদের রাস্তা ব্লক করতে লাগল। খামখাই। মজা। আমি আর বাবা বাড়ির বাকি লোকেদের চেয়ে আলাদা হয়ে গেলাম একটা বৃত্তে। একটা উল্লাসের শিকার তখন। ‘ও দিদি এখান দিয়ে দাদুকে নিয়ে যান না’, একটি মেয়ে চেঁচিয়ে উঠল। আমি সেই দিকে যেতে গিয়েই আটকা পড়লাম। তুমুল হাসির রোল। কেমন-বোকা-বানালাম টাইপ। সবাই মিলে রাস্তা ব্লক করে দাঁড়াল। ফের অন্য জায়গা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। ফের আটকে দিল। অট্টহাসি। বাবা কাঁপছে, আমার কান-মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। ভিড়ের বাইরে থেকে দিদি পাগলের মতো ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। আমি বুঝতেই পারছি না, এটা কী হচ্ছে, কেনই বা হচ্ছে?

এ বার ভিড়টা আমাদের রাস্তার এক দিকে ঠেসে ধরেছে। আমি অবশ। গা গুলোচ্ছে, ঘামছি, কাঁপছি। আর ওদের সে কী হাসি! এমন হাসি, অমন আনন্দ, কক্ষনও দেখিনি। প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থায় বলছি, আমাদের যেতে দাও। কী করছ কী? এত ছোট ছিল ওরা, আপনি বেরোয়নি মুখ দিয়ে। ‘যান না যান, এই দিক দিয়ে যান।’ বলেই আবার হাসি, উল্লাস, উন্মাদনা। আমি বুঝতে পারছি না, ওরা কী করবে আমাদের? মারবে? কিন্তু কেন? ভয়ে আমার ভেতর তখন শুকিয়ে কাঠ। কেমন মনে হচ্ছে এটা একটা জন্তু ধরা ফাঁদ, শুয়োর কি বুনো মোষ ধরা পড়েছে, এ বার তাকে এক দিকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে, মারা হবে। ধীরে ধীরে। এখন কেবল ফাঁদে পড়ার আনন্দটা ওরা উপভোগ করছে।

কোল্ড ড্রিংকস-এর দোকান দিয়েছিল দুটো ছেলে, তারা ভিড় ঠেলে আমাদের কাছে এল, চেঁচামেচি করতে লাগল, বাবাকে খানিকটা ঠেলা দিয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে দোকানের চেয়ারে বসাল। বাবা প্রায় অজ্ঞানের মতো। কাঁপছে। খামখা এত বড় একটা অপমান, একটা আচমকা ভয়ের মুখে পড়ে অবিন্যস্ত।

আমার দুচোখ ঠেলে কান্না আসছে। আমি বুঝতেই পারছি না তখনও, কেন এটা হল। এ রকম অপদস্থ করার উদ্দেশ্য কি? শুধুই ‘মজা মারছিল’ ওরা?

সঞ্চারী মুখোপাধ‌্যায়

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy