Advertisement
০৬ ডিসেম্বর ২০২৪
Tampering With Nature

জলবায়ু যখন যুদ্ধাস্ত্র

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে উৎসবের সময় বৃষ্টি আটকে রাখা কিংবা খরাকবলিত জায়গায় জলভরা মেঘ পাঠানোতেই থেমে থাকেনি ব্যাপারটা। যুদ্ধে বোমা, রকেট বা বন্দুক সরিয়ে রেখে অঝোর বৃষ্টি ঝরিয়ে শত্রুকে বিপর্যস্ত করে দেওয়াটাও ‘মানবিক’ মনে করা হচ্ছে। শত্রুদেশের বিস্তীর্ণ এলাকার পরিবেশ বরবাদ করে দিলেই বা এমন কী ক্ষতি! কিন্তু প্রকৃতিকে বার বার ইচ্ছেমতো ব্যবহার করলে, রুষ্ট প্রকৃতি যদি আরও বড় বিপর্যয় তৈরি করে, তার মোকাবিলা করা যাবে তো?

মেঘের ঘনঘটা কিংবা মুষলধারে বৃষ্টির অধিকার প্রকৃতির কাছ থেকে ধীরে ধীরে নিজের হাতে মিয়ে নিচ্ছে মানুষ।

মেঘের ঘনঘটা কিংবা মুষলধারে বৃষ্টির অধিকার প্রকৃতির কাছ থেকে ধীরে ধীরে নিজের হাতে মিয়ে নিচ্ছে মানুষ।

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:৪৬
Share: Save:

কয়েক দিন আগেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রক মিশন শুরু করার অনুমোদন চেয়ে পাঠিয়েছে। এখনও পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা যা হয়েছে, তাতে ফলাফল সব ঠিকই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ঠিক থাকাই সব নয়, বাস্তবে পুরোদমে মিশন শুরু হলে বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা মাত্রা পাবে। তখন কূটনৈতিক সম্পর্ক, বহির্বিশ্বের চাপ, বিরোধী-সমালোচকদের প্রশ্ন— এ সব তো থাকবেই। তার থেকেও বড় বিষয় হল, একটু এ দিক-ও দিক হলে শুধু তো কমিউনিস্ট দেশগুলো নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা যে ক’টা শত্রু রয়েছে, তারাও তখন রাষ্ট্রপুঞ্জের কানে টুক করে তুলে দেবে কথাটা। তখন আবার আলাদা ঝামেলা। তাই চট করে কিছু করা যাবে না। সব দিক ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ করতে হবে। এ সব চিন্তা করতে-করতেই দফতরের কর্তা একটা নথি পাঠিয়ে দিলেন অন্য এক কর্তার কাছে। নথির তারিখ, ১৩ জানুয়ারি, ১৯৬৭, এবং ‘সাবজেক্ট’-এর জায়গায়, ‘ওয়েদার মডিফিকেশন ইন নর্থ ভিয়েতনাম অ্যান্ড লাওস (Project Popeye)—প্রজেক্ট পপ্যায়’। পরিপ্রেক্ষিত ছিল, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ‘প্রজেক্ট পপ্যায়’-এর জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের আমেরিকান সরকারের প্রশাসনিক অনুমোদন চাওয়া। আর সেই অনুমোদনের বিষয় নিয়ে আমেরিকান সরকারের দুই শীর্ষকর্তার নথি চালাচালি। আমেরিকান সরকারের ১৯৬৪-’৬৮ সালের বিদেশনীতির গুরুত্বপূর্ণ দলিলগুলির মধ্যে এটি অন্যতম।

উত্তর ভিয়েতনামের গেরিলা বাহিনী অরণ্য-প্রান্তর-পর্বতচূড়া-সমতলে তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অরণ্যে প্রায় গাছ হয়ে থেকে চলাচল তাদের। আলো-ছায়াময় পথ তাদের সঙ্গী। ‘পদচিহ্ন না রেখে চলাচল, ধোঁয়া ছাড়া রান্না আর শব্দ ছাড়া যোগাযোগ’—এই তিন মূল মন্ত্রে দীক্ষিত গেরিলা বাহিনীর হদিস পেতে ভিয়েতনাম যুদ্ধে কালঘাম ছুটেছিল আমেরিকান প্রশাসনের। এমন পরিস্থিতিতেই আমেরিকান সামরিক বাহিনী আবহাওয়া আর প্রকৃতিকে হাতিয়ার করে গেরিলা বাহিনী দমন করার পরিকল্পনা করেছিল। আমেরিকান বাহিনী ঠিক করে, অরণ্যের যে সবুজকে বর্ম করেছে গেরিলা বাহিনী, সেই সবুজকেই বিনাশ করা হবে। তার জন্য ঢালা হবে রাসায়নিক। অর্থাৎ, ছলে-বলে-কৌশলে আটকাতেই হবে, দমাতেই হবে শত্রুপক্ষকে।

আবার গেরিলা বাহিনীর সরবরাহের প্রধান সংযোগপথ (হো চি মিন ট্রেল) বিপর্যস্ত করে দিতে হবে। আর সেই সূত্রেই চলে আসে ‘প্রজেক্ট পপ্যায়’-এর প্রসঙ্গ, যে অপারেশনে গেরিলা বাহিনীর যোগাযোগ, সরবরাহ ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কী ভাবে? ‘বিতর্কিত’ নথি জানাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে ‘ক্লাউড সিডিং’ বা মেঘে বীজ বপনের মাধ্যমে কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের মতো সহজ পদ্ধতিকেই হাতিয়ার করেছিল‌ আমেরিকান প্রশাসন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ধস নামানো, অতিবৃষ্টির মাধ্যমে বন্যা ঘটিয়ে উত্তর ভিয়েতনাম বাহিনীকে বাধাপ্রাপ্ত করা, অর্থাৎ সামরিক সুবিধার্থে আবহাওয়ার পরিবর্তন করার যত রকম পদ্ধতি রয়েছে, সবই গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের ১৩ জানুয়ারির নথিতে লেখা ছিল, “এই প্রজেক্টের মাধ্যমে উত্তর ভিয়েতনামীদের চলাফেরার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা যাবে। চলাফেরা করতে গেলে বড় মূল্য চোকাতে হবে তাঁদের।... সবচেয়ে বড় কথা, এই প্রজেক্টের মাধ্যমে বড়সড় মানসিক আঘাত হানা সম্ভব হবে।” বহির্বিশ্ব এই প্রজেক্টের কথা জানতে পারলে কী করা হবে, আগাম সে পদক্ষেপের কথাও আলোচিত হয়েছিল নথিতে। বলা হয়েছিল, সামরিক সুবিধার্থে আমেরিকা আবহাওয়ার পরিবর্তন (ওয়েদার মডিফিকেশন) ঘটিয়েছে, এই অভিযোগ ওঠা আটকাতে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে হবে। তার পরও কোনও ভাবে প্রজেক্টের কথা রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে পৌঁছলে তখন না-হয় বলা যাবে, বোমাবর্ষণ না করে, রকেট বা বন্দুক ব্যবহার না করে ‘ক্লাউড সিডিং’-এর মাধ্যমে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে শত্রুশিবিরে আঘাত হানাটা যথেষ্ট ‘মানবিক’।

যদিও এত কাঠখড় পুড়িয়েও ‘প্রজেক্ট পপ্যায়’-এর সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। একই সঙ্গে ভিয়েতনাম যুদ্ধ একটা কর্কশ সত্যকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিল‌ যে, ভবিষ্যতে আবহাওয়াই যুদ্ধের ফলাফলের অন্যতম নির্ণায়ক শক্তি হতে পারে। যেখানে শক্তিশালী পক্ষ নিজেদের সামরিক সুবিধার্থে ইচ্ছেমতো আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটিয়ে কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে শত্রুপক্ষে আঘাত হানতে পারে। যেমনটা প্রায় দু’দশক বাদে যুদ্ধ থামার পরে দেখা গিয়েছিল— ভিয়েতনাম এমন এক ধ্বংসস্তূপের নাম, পৃথিবীর মধ্যে যেখানে সবচেয়ে বেশি বোমা ফেলা হয়েছে, মাইলের পর মাইল জঙ্গল ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, অধিকাংশ চাষজমি হয়ে গিয়েছে অনাবাদি, প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩০ লক্ষ সাধারণ মানুষ। এই যুদ্ধের সূত্রেই অভিধানে যোগ হয়েছিল নতুন এক শব্দ—‘ইকোসাইড’। যার অর্থ হল, পরিবেশ ধ্বংসের মাধ্যমে করা সংগঠিত অপরাধ। শত্রুপক্ষের অধীনস্থ নির্দিষ্ট এলাকার আবহাওয়ার তারতম্য ঘটিয়ে বিপর্যয় তৈরি বা পরিবেশগত বৃহৎ এলাকা ধ্বংস করাই যেখানে লক্ষ্য।

*****

অর্থনৈতিক, সামরিক, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে শক্তিধর দেশগুলি সে সময় এই চর্চায় মশগুল ছিল, তা হলে কি সত্যিই আবহাওয়াকে অস্ত্র বানানো সম্ভব? প্রায় সমস্ত দেশের পুরাণেই আবহাওয়ার দেবদেবীরা রয়েছেন, তাঁদের নিক্ষিপ্ত অস্ত্রে ধ্বংস হয় শত্রুবাহিনী। অজেয়, অমর হয়ে থাকেন শুধু দেবদেবীরা। তেমন ভাবে গোটা আবহাওয়াকেই অস্ত্র বানিয়ে ফেলতে পারলে আলাদা করে আর অস্ত্রের কী দরকার? সব পক্ষের মাথাতেই কিলবিল করতে থাকল এ চিন্তা। ঠান্ডা-যুদ্ধের যুযুধান দুই পক্ষ, আমেরিকা ও সোভিয়েট রাশিয়া পরিস্থিতি দেখে বুঝল যে, অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দেশ হয়তো পরিবেশের পরিবর্তন ঘটিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক সুবিধে নিতে পারবে না। কিন্তু তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে, বা তাদের মতো সামরিক বলে বলীয়ান কোনও দেশ ভবিষ্যতে প্রত্যাঘাতের কৌশল হিসেবে, আবহাওয়া ও প্রকৃতিকে নিজের ‘মিলিটারি অ্যাডভান্টেজ’-এর কারণে ব্যবহার করতেই পারে। তাই সে আশঙ্কা সমূল বিনাশের প্রয়োজন। ঘটনাক্রম জানাচ্ছে, পরিবেশকে সামরিক সুবিধার্থে ব্যবহার করা যাবে না, এই ব্যাপারে সহমত হতে ১৯৭৪-’৭৬ সালের মধ্যে আমেরিকা ও সোভিয়েট রাশিয়া একাধিক বার বৈঠকে বসে। ওই বৈঠকই শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের সামরিক সুবিধা বা শত্রুতার মনোভাব নিয়ে পরিবেশের পরিবর্তন ঘটানোর কৌশল নিষিদ্ধ করার চুক্তির (‘কনভেনশন অন দ্য প্রহিবিশন অব মিলিটারি অর এনি আদার হস্টাইল ইউজ় অব এনভায়রনমেন্টাল মডিফিকেশন টেকনিকস’ (ইএনএমওডি)) ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। ওই চুক্তির নির্যাস, সামরিক সুবিধা বা শত্রুপক্ষের ক্ষতির জন্য কোনও দেশ, অপর কোনও দেশের বিরুদ্ধে পরিবেশকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। আবহাওয়া-যুদ্ধ বা ‘ওয়েদার ওয়ারফেয়ার’-এর আশঙ্কা দূর করতে ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় এটি পাশ হয়।

চুক্তি পাশ তো হল। কিন্তু কাজ হল কী? ঘটনাক্রম বলছে, না! যে উদ্দেশ্য নিয়ে চুক্তির অবতারণা, তা প্রথমেই ধাক্কা খেল। কারণ, সব দেশ তাতে স্বাক্ষর করল না। যার মধ্যে অন্যতম ছিল চিন। ১৯৫৮ সাল থেকে নিজেদের খরাদীর্ণ এলাকায় কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে জলের সমস্যা দূর করলেও সব ব্যাপারেই তাদের যেন একটা গোপন-গোপন ভাব। ২০০৫ সালে তারা ইএনএমওডি চুক্তিতে সই করল বটে, কিন্তু শর্তসাপেক্ষে। ভারত-সহ অনেক দেশেরই অনুমান, ‘ক্লাউড সিডিং’-এর নিরীহ বর্মের আড়ালে আবহাওয়া নিয়ে অন্য কোনও মতলব রয়েছে চিনের। কিন্তু সেটা কী, তা স্পষ্ট নয় কারও কাছেই। আবহাওয়ার উপরে চিনা ‘খবরদারি’র একটা আভাস মিলল ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিক্সের সময়ে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে বৃষ্টিমুক্ত করতে মেঘের দিকে তাক করে রাসায়নিক-ভর্তি রকেট ছুড়েছিল চিন। যাতে স্টেডিয়ামে পৌঁছনোর আগেই মেঘগুলি থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ে। এমন নয় যে, সে বারই প্রথম ‘ক্লাউড সিডিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল তারা। সরকারি বিশেষ দিনগুলোয় বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তারা। তবে সময়, স্থানমাহাত্ম্যের নিরিখে ২০০৮ সালের অলিম্পিক্সের বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ সবার থেকে আলাদা ছিল। চিনের ‘ওয়েদার মডিফিকেশন সিস্টেম’ বা প্রয়োজনমতো আবহাওয়ার পরিবর্তন বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর সমীহ আদায়ের পাশাপাশি একই সঙ্গে চিন্তারও উদ্রেক করেছিল। কিন্তু তখনও কেউ জানতে পারেনি, ২০০৮ সালের বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণের ঘটনা ছিল আসলে হিমশৈলের চূড়ামাত্র।

*****

শুধু চিন কেন, চল্লিশের দশকে আমেরিকার রসায়নবিদ, আবহবিজ্ঞানী ভিনসেন্ট জোসেফ শেফারের পরীক্ষার মাধ্যমে যে ক্লাউড সিডিং-এর সূত্রপাত হয়েছিল, তার দিকে ভারত, রাশিয়া, ইজ়রায়েল, ইন্দোনেশিয়া, কুয়েত, ইরান, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, মালয়েশিয়া, মেক্সিকোর মতো অনেক দেশই ঝুঁকেছে। এখানে জেনে নেওয়া যাক, ‘ক্লাউড সিডিং’ বিষয়টি আসলে কী? ভারতের কেন্দ্রীয় ভূবিজ্ঞান মন্ত্রণালয় অধীনস্থ ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিডিয়াম রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্টিং’-এর বিজ্ঞানী উপল সাহা বলছেন, “ক্লাউড সিডিং-এর মাধ্যমে কৃত্রিম ভাবে বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়।

এই প্রক্রিয়ায় মেঘের ভিতরে রাসায়নিক পদার্থ যেমন, সিলভার আয়োডাইড বা সোডিয়াম ক্লোরাইড বা ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড ইত্যাদি প্রয়োগ করে বৃষ্টিপাতকে ত্বরান্বিত করা হয়।” অর্থাৎ, ক্লাউড সিডিং এমন এক প্রযুক্তিগত পদ্ধতি, যেখানে মেঘকে বৃষ্টি উৎপাদনের জন্য প্রভাবিত করা হয়। আকাশে ভাসমান মেঘের মধ্যে বিমান, রকেট বা ড্রোনের মাধ্যমে এই সব রাসায়নিক প্রয়োগ করে মেঘকে বর্ষণক্ষম করা হয়। কারণ, মেঘ হলেই বৃষ্টি হবে, এমন কোনও কথা নেই। বৃষ্টি হতে গেলে বেশ কয়েকটি সহায়ক পরিস্থিতি দরকার। আবহবিজ্ঞানের অধ্যাপক সুব্রতকুমার মিদ্যা পুরো প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে বলছেন, মেঘে জলীয় বাষ্প থাকলেই বৃষ্টি হয় না। এমনকি, জলীয় বাষ্প বিন্দু আকার ধারণ করলেও তা ভূপৃষ্ঠে গিয়ে পড়বে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। সে কারণে আকাশে মেঘ জমলে বা ঘন করে এলেও প্রায়শই দেখা যায় যে বৃষ্টি হচ্ছে না। তাঁর কথায়, “বৃষ্টি হতে গেলে মেঘের মধ্যে থাকতে হবে নির্দিষ্ট ঘনত্বের ও আকারের কণা যাকে বলা হয় ‘ক্লাউড কনডেনশেসন নিউক্লিয়াই’ (সিসিএন)। ‘ক্লাউড সিডিং’ বা মেঘের বীজবপন প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম ভাবে মেঘের মাঝে সিসিএন প্রয়োগ করে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বৃষ্টিপাত করানো যেতে পারে।’’

তবে শুধু বৃষ্টি নয়, বৃষ্টি না হওয়ার জন্যও এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। যেমন রাশিয়ায়। অবিভক্ত সোভিয়েট রাশিয়ার সময় থেকেই সে দেশে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়ে এসেছে। সরকারি বিশেষ ছুটির দিনগুলোয় তারা এটা করে থাকে। মে দিবসে কমপক্ষে মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয় ‘ভাল আবহাওয়া’ নিশ্চিত করতে।

ভারতেও ১৯৮৩, ১৯৮৪-৮৭ এবং ১৯৯৩-৯৪ সালে তামিলনাড়ু সরকার তীব্র খরা মোকাবিলায় ক্লাউড সিডিং শুরু করেছিল। ২০০৩ এবং ২০০৪ সালে কর্নাটক সরকার ক্লাউড সিডিং শুরু করে। আবার মহারাষ্ট্রের ক্লাউড সিডিং কার্যক্রমও উল্লেখযোগ্য। ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারি মাসে কর্নাটক বিধানসভা সর্বসম্মতিক্রমে কর্নাটক ক্লাউড সিডিং বিল, ২০২৪ অনুমোদন করেছে। গত বছর দিল্লি সরকারও এই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

‘ক্লাউড সিডিং’-এর বিপদ নিয়ে বার বার সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের বক্তব্য, এই পদ্ধতির মাধ্যমে কোনও এলাকায় সাময়িক বৃষ্টিপাত হলেও তার আশপাশের এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেতে পারে। সে কারণে অনেকে একে ‘ক্লাউড সিডিং’-এর পরিবর্তে ‘ক্লাউড স্টিলিং’ বা মেঘ চুরিও বলছেন! তা ছাড়া এই প্রক্রিয়া জলচক্রের ভারসাম্য নষ্ট করে জলাশয়ে জলের ঘাটতি তৈরি করতে পারে। অন্য দিকে, যে পরিমাণ বৃষ্টির কথা ভাবা হয়েছিল, তার থেকেও বেশি পরিমাণ বৃষ্টি হয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে।

তুমুল বিতর্কও হয়েছে এই পদ্ধতি নিয়ে। যেমন গত এপ্রিলে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির রাজধানী দুবাই-সহ অন্যান্য শহরের জনজীবন তুমুল ঝড়বৃষ্টি ও বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিল। অতিবর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওমান-ও। জলের সমস্যা কাটানোর জন্য নব্বইয়ের দশক থেকে সে দেশে মেঘে বীজ বপনের পদ্ধতি চালু ছিল। এপ্রিলে বন্যার আগেও এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছিল। সে ঘটনার জন্য ‘ক্লাউড সিডিং’কেই কাঠগড়ায় দাঁড় করান অনেকে। যদিও বিশেষজ্ঞেরা সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে, ওই বন্যার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নকেই দায়ী করেছিলেন।

*****

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হল, মেঘে বীজ বপনের আড়ালে অনেক দেশ ‘ওয়েদার মডিফিকেশন’ বা আবহাওয়া পরিবর্তনের বিপজ্জনক খেলায় নেমেছে। অনেকে এক ধাপ এগিয়ে আবহাওয়ার অস্ত্রীকরণ করতে চাইছে। যাতে শত্রু বা বিরোধীপক্ষকে আবহাওয়া দিয়েই ঘায়েল করা যায়। আবহাওয়াকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সুবিধাও রয়েছে। কোনও এলাকায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নেপথ্যে আসলে যে অন্য শত্রু দেশের হস্তক্ষেপ রয়েছে, সেটা সরাসরি প্রমাণ করাটা একটু মুশকিল। নিশ্চিত না হয়ে এ ব্যাপারে কোনও দাবি করা যাবে না। কারণ, দু’দেশের সীমান্তে কাঁটাতার থাকলেও আকাশে কোনও কাঁটাতার নেই। তাই মেঘের চলন অবাধ। ফলে ঝড়বৃষ্টি, বন্যা, খরা দিয়ে শত্রুদেশকে কাবু করলেও তা চট করে অন্যের চোখে ধরা পড়বে না। বড়জোর অভিযোগের আঙুল উঠতে পারে। এই সমস্ত দিক বিবেচনা করেই ‘ওয়ার্ল্ড মিটিয়োরোলজিক্যাল অর্গানাইজ়েশন’ আবহাওয়া পরিবর্তনের পক্ষে মত দেয়নি। কারণ, এর সঙ্গে শুধু যে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জড়িত রয়েছে তা নয়। বরং প্রতিবেশী দেশগুলির, এমনকি এক বিস্তীর্ণ অংশের জনজীবন ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিপন্ন হতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটের নিরিখে ২০১৮ সালে অসমের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার অভিযোগ নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। হিমন্তের দাবি ছিল, তিব্বতের বাস্তুতন্ত্রকে বিঘ্নিত করা হচ্ছে। যার জেরে অসম, অরুণাচল প্রদেশে অস্বাভাবিক বৃষ্টি, বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। তিব্বতের আবহাওয়া নিয়ে ছিনিমিনি খেলার জন্য হিমন্ত সরাসরি দায়ী করেন চিনকে। এমনিতে চিনের আবহাওয়া সম্পর্কিত কার্যক্রম আগেই সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি করেছিল। তার কারণ, আবহাওয়া নিয়ে চিনা সরকারের গৃহীত একের পর এক কার্যক্রম।

ঘটনাপ্রবাহ বলছে, ১৯৫৮ সালে খরাদীর্ণ অঞ্চলে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে আবহাওয়া পরিবর্তন প্রকল্পে হাতেখড়ি হয়েছিল চিনের। ২০০২ সালে সে দেশে আবহাওয়া পরিবর্তন আইন পাশ হয়। বর্তমানে চিন বিশ্বের মধ্যে সর্ববৃহৎ আবহাওয়া পরিবর্তনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ২০২৫ সালের লক্ষ্যমাত্রা ধরে চিনের এই কর্মসূচি প্রায় ৫৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটার জুড়ে কৃত্রিম বৃষ্টি বা তুষারপাত এবং ৫.৮ লক্ষ বর্গকিলোমিটার জুড়ে শিলাবৃষ্টি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এহ বাহ্য। চিনের আবহাওয়া পরিবর্তনের কর্মসূচি আসলে অন্য ‘অভিসন্ধি’র সঙ্গে যুক্ত। কারণ, বেজিং-এর লক্ষ্য হল, ২০৩৫ সালের মধ্যে মোট জাতীয় শক্তি এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবের ক্ষেত্রে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়া। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য চিন আবহাওয়াকেও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে কি না, সেটাই এই মূহূর্তের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোরালো হয়ে উঠছে আবহাওয়া কর্মসূচি নিয়ে চিনের গোপনীয়তার কারণেও। যেমন ২০১৩ সালে ভারত-চিনের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত নদী সম্পর্কিত হাইড্রোলজিক্যাল তথ্য বিনিময়ের জন্য ‘মউ’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্ত তা সত্ত্বেও ২০১৭ সালে ডোকলাম-বিতর্কের সময়ে ভারতের সঙ্গে সে তথ্য বিনিময় করেনি চিন। অজুহাত দিয়েছিল যান্ত্রিক ত্রুটির। অথচ সেই সময়েই তারা বাংলাদেশের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করে।

*****

তবে ভারতও যে চুপ করে বসে নেই, পুরো পরিস্থিতির উপরে কেন্দ্রের নজর রয়েছে, তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। বলেছেন, দেশের জলবায়ু পরিবর্তন শুধু আবহাওয়া সম্পর্কিত ঘটনা নয়। বরং জাতীয় সুরক্ষার সঙ্গে বিষয়টি ওতপ্রোত জড়িত। উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, সিকিম, লাদাখের মতো সীমান্তবর্তী রাজ্য ও অঞ্চলগুলিতে ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনার উপরে তাঁর মন্ত্রক কড়া নজর রাখছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

চরম আবহাওয়াজনিত অবস্থা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সংক্রান্ত বিষয়ে আরও নিখুঁত ও সময়নির্দিষ্ট পূর্বাভাসের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকার ২০০০ কোটি টাকার ‘মিশন মৌসম’ গ্রহণ করেছে। এই প্রোগ্রামের অধীনে পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মিটিয়োরোলজি-তে একটি ক্লাউড চেম্বার তৈরি করা হয়েছে। বিজ্ঞানী উপল সাহা জানাচ্ছেন, ক্লাউড চেম্বার হল এমন একটি বৈজ্ঞানিক যন্ত্র, যা দিয়ে মেঘ গঠনের প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি তৈরি করে তা পর্যবেক্ষণ করা যায়। ‘মিশন মৌসম’-এর এই ক্লাউড চেম্বার বিজ্ঞানীদের মেঘের গঠন ও আচরণ, বিশেষ করে ভারতীয় বর্ষার উপর তাদের প্রভাব পর্যবেক্ষণে সাহায্য করবে। এটি আবহাওয়ার পূর্বাভাস আরও নিখুঁত করতে এবং বৃষ্টি, শিলা, কুয়াশা ও বজ্রপাতের মতো আবহাওয়া পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাহায্য করবে।

এই প্রকল্প গ্রহণের একটা অন্যতম কারণ চিনকে একটি বার্তা দেওয়া— মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তবে চিন্তা থাকছে এর ফলাফল নিয়েও। ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মিটিয়োরোলজি’-র অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, আবহাওয়াকে কৃত্রিম ভাবে পরিবর্তন করলে তার একটা প্রভাব থাকে। সেটা ভাল না মন্দ, সেটা স্পষ্ট জানা নেই। তবে একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “এই প্রকল্প দেশের স্বার্থেই গ্রহণ করা হয়েছে। সব দিক ভেবেই কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্প গ্রহণ করেছে।”

*****

কূটনৈতিক ক্ষেত্রে যতগুলি ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, তার অন্যতম হল আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটিয়ে শত্রুদেশের বাস্তুতন্ত্রে অস্থিরতা তৈরি করা। আমেরিকা, রাশিয়া সেই কবে থেকে ‘ক্লাইমেট ওয়েপনস’ বা ‘জলবায়ু অস্ত্র’ ব্যবহারের জন্য একে অপরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। ঘটনাচক্রে সেই একই প্রবণতা বর্তমানে লক্ষ করা যাচ্ছে চিন-ভারত সম্পর্কেও। পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে চিনের কর্মকাণ্ডের কারণে। যেমন তিব্বতি মালভূমি অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির লক্ষ্যে চিন সর্ববৃহৎ আবহাওয়া-নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। যা স্বাভাবিক ভাবেই ভারত তো বটেই, এমনকি সামগ্রিক এশিয়া মহাদেশের জলবায়ুর ক্ষেত্রেও একটা বড়সড় বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে অনুমান অনেকের। এক আবহাওয়াবিদের কথায়, “চিন নিজের অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক সমস্যা সমাধান করে নাগরিকদের জীবনের মানোন্নয়ন করলে কারও কিছু বলার ছিল না। কিন্তু পার্শ্ববর্তী এলাকায় আবহাওয়ার পরিবর্তন কর্মসূচির উপকার বা অপকার নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্য এখনও নেই। সেই অবস্থায় বৃহৎ পরিসরে গৃহীত প্রকল্পের জেরে কোনও বিপর্যয় তৈরি হলে তা শুধুই চিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং ভারত-সহ অন্যান্য দেশের উপরেও তার প্রভাব পড়বে।” আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক বিশেষজ্ঞের কথায়, “চিন-ভারত সম্পর্কের নিরিখে যে কোনও ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিশেষ করে আবহাওয়ার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে পরীক্ষা করা হলে তাতে সমস্যা আরও বাড়বে।”

জানা যাচ্ছে, ওই প্রকল্পের মাধ্যমে তিব্বতি মালভূমি অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের মাত্রা বার্ষিক ১০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেছে চিন। যা ভারতের পক্ষে সমস্যার হতে পারে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। আবহাওয়াবিজ্ঞানের অধ্যাপক সুব্রতকুমার মিদ্যা জানাচ্ছেন, ভৌগোলিক ভাবে সুবিধাজনক অবস্থানের জন্য দক্ষিণ-পশ্চিমি মৌসুমি বায়ু ভারতের উপর থেকে প্রবাহিত হয়। তাই এ দেশে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়। হাওয়ার গতিবেগ, অভিমুখ, সবই প্রকৃতি ঠিক করে। কিন্তু তাঁর কথায়, “ভারতের কোনও প্রতিবেশী দেশ নিজেদের এলাকায় কৃত্রিম ভাবে বৃষ্টিপাত ঘটানোর পরিকল্পনা করলে তার ফল ভুগতে হতে পারে ভারতকে। কারণ, সে ক্ষেত্রে ভারত থেকে বৃষ্টি চুরি হতে পারে।”

এ ছাড়াও ব্রহ্মপুত্র, মেকং নদীর উপরে চিনের বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা নিয়েও চর্চা শুরু হয়েছে। এই বাঁধ নির্মাণের ফলে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশে কী পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তা যথেষ্ট চিন্তার বিষয় বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। গালওয়ান সংঘর্ষের সময়েই শোনা গিয়েছিল যে, আকস্মিক বন্যার মাধ্যমে ভারতের পরিকাঠামো ও সামরিক বাহিনীর ক্ষতি করতে চিন গালওয়ান নদীর প্রবাহকে পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিল। যা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারত বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, নদীর প্রবাহ পরিবর্তন বিতর্কিত বিষয়। দেশের ভিতরে, বাইরেও। বিজ্ঞানী উপল সাহা জানাচ্ছেন, গঙ্গার ক্ষেত্রে এমনই এক পরিবর্তনের নজির রয়েছে। তেহরি বাঁধ প্রকল্পের মাধ্যমে গঙ্গা নদীর গতিপথ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। মধ্যপ্রদেশের কেন-বেতওয়া নদীবাঁধ প্রকল্পের ফলেও সেখানকার বাস্তুতন্ত্রে প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। নদী-গবেষক সুপ্রতিম কর্মকারের বক্তব্য, পরিবেশ বিজ্ঞানের প্রথম পাঠ প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের কথা বলে। প্রকৃতিকে মানুষ যত বার জয় করতে গেছে, তত বার সে পরাজিত হয়েছে। উত্তরাখণ্ডের হড়পা বান, সিকিমের বাঁধভাঙা বিপর্যয়ের মতো এ রকম অনেক উদাহরণ রয়েছে। তাঁর বক্তব্য, “নদীর গতিপথ পাল্টে ফেললে আমাদের দেশের বুকে আরও বড় বিপর্যয় নেমে আসবে। যার মোকাবিলার জন্য এই দেশের পরিকাঠামো প্রস্তুত নয়। তবে এটাও ঠিক, চিনের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্র যদি আবহাওয়াকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, তা হলে ভারতও নিশ্চয়ই হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। প্রয়োজনে ন্যায়বিচারের জন্য আমাদেরও আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হবে।”

*****

কিন্তু আদালতে যাওয়ার উপায় কোথায়? যাবতীয় বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই তো বিশ্বের একাধিক দেশ জলবায়ুকে অস্ত্র করে তোলার এক ভয়ঙ্কর, সর্বনাশী প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। যার ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, সে ব্যাপারে কারও কোনও চিন্তা নেই। আশঙ্কা আরও গভীর হচ্ছে, আবহাওয়া সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় লাগাম টানার ব্যাপারে সব দেশের ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারার ঘটনাও। ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’-এর তথ্য বলছে, ২০২১ সালে বিশ্বের মাত্র ১১টি দেশ ‘ইকোসাইড’কে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছিল। আরও ২৭টি দেশে তা আলোচনার স্তরে ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের মার্চের তথ্য বলছে, ইকোসাইডকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার দেশের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১২-য়। অর্থাৎ, গত তিন বছরে মাত্র একটি দেশ বিষয়টিকে অপরাধযোগ্য হিসেবে গণ্য করেছে। এই পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট যে, পরিবেশ, আবহাওয়া সম্পর্কিত চিন্তা ঠিক কী পর্যায়ে রয়েছে।

আবহাওয়া নিয়ে ছেলেখেলা করার যে বিপজ্জনক রাস্তায় বিশ্বের একাধিক দেশ হাঁটছে, বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, সেই রাস্তা একরৈখিক। শুধু তা সামনের দিকেই এগোয়। এগোতে এগোতে এক সময়ে তা কোথাও যেন হারিয়ে যায়। যেমন এই মুহূর্তে প্রাণী ও উদ্ভিদ মিলিয়ে প্রায় ১০ লক্ষেরও বেশি প্রজাতির পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। কারণ, যা কিছু স্বাভাবিক, যা কিছু প্রাকৃতিক, যা কিছু সহজাত, মানুষ বরাবরই তাকে ধ্বংস বা তার পরিবর্তন করতে চেয়েছে। আসলে বরাবর প্রকৃতির প্রতিস্পর্ধী হতে চেয়েছে মানুষ। কিন্তু প্রতিস্পর্ধী বা বিরোধী হওয়ার পরিবর্তে সে যদি প্রকৃতির বন্ধু হতে পারত, তা হলে হয়তো জ‌লবায়ু সঙ্কট অতিক্রম করে এক অন্য পৃথিবী রেখে যেত পারত ভবিষ্যতের জন্য।

অন্য বিষয়গুলি:

Cyclone Thunderstorm Nature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy