মস্ত একটা দিঘির ধারে পর পর পাঁচটা গাছ। টলটলে জলের ওপর গাছের ছায়া দুলছে, ভাঙছে। ঝিমঝিমে আলস্য-মাখা যে শান্ত-নরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের ওপর এত ক্ষণ টাইটেল পড়ছিল, টাইটেল ফুরোতেই দেখা যায়, সেটা স্টুডিয়োর মধ্যে, ক্যানভাসের গায়ে, তখনও শেষ না হওয়া একটা ল্যান্ডস্কেপ-চিত্র হয়ে টাঙানো আছে। ছবিটা যিনি এঁকেছেন, সেই এইনার ওয়েগনার-এর স্ত্রী গার্দাও চিত্রশিল্পী। তবে, তিনি পোর্ট্রেট আঁকেন। তাঁর অসমাপ্ত একটা ছবির মডেল সে দিন আসতে দেরি করছিল বলে তিনি এইনারকে প্রক্সি দিতে বসিয়ে দিয়েছিলেন। ক্যানভাসে যেমনটা আছে, একেবারে সেই রকম করে, টিপিকাল একটা ঢেউ-তোলা, লীলাময়, মেয়েলি বিভঙ্গে, ডান পা-টা এক দিকে একটু ছড়িয়ে, বসতে হয়েছিল এইনারকে! ঠিকমত মুডটা আসছে না বলে মডেলের পোশাকটাও তিনি গার্দার কাছে চেয়ে নেন। পোশাকটাকে বুকের কাছে, গালের কাছে চেপে ধরে, মেয়েলি পোশাকের গন্ধ, তার রেশমি কোমলতার ছোঁয়াটা যেন শরীর ভরে নিতে চাইছিলেন তিনি!
গার্দা স্বপ্নেও ভাবেননি, ওই মডেল-মডেল খেলা এইনারের শরীর-মনের অন্দরে আজন্ম আদরে-লজ্জায় লুকিয়ে রাখা নারীকে এ ভাবে বের করে আনবে। ছ’বছরের দাম্পত্যে এইনার তাঁর অন্তরমহলের এই গোপন নারী ‘লিলি এলবে’-র অস্তিত্ব টের পেতে দেননি। ছবির শুরুতে আমরা ওঁদের দাম্পত্যের যেটুকু দেখেছি, সেখানেও এইনার আদর্শ স্বামীর মতোই, যিনি পার্টিতে যাওয়ার আগে বউয়ের ঠোঁটের কোণ থেকে বাড়তি লিপস্টিকটুকুও যত্নে মুছে নেন। সেই ছোঁয়ায় কোনও মেয়েলিপনা নিশ্চয়ই গার্দা খুঁজে পাননি। এমনকী, ওই মডেল সাজার পরেও তাঁদের মিলন-রাতে এইনারকে তাঁর পুরুষ বেশের নীচে মেয়েদের রাতপোশাকে দেখেও গার্দার কিছু মনে হয়নি। বরং তিনি সেটাকে অন্য রকম মিলন-খেলা ধরে নিয়েই মেতে ওঠেন। প্রথম ভুল ভাঙে, যখন তিনি এইনারকে লিলি সাজিয়ে একটা পার্টিতে নিয়ে যান ও সেখানে এক অচেনা পুরুষের সঙ্গে তীব্র চুম্বনে লিলিকে রক্তাক্ত দেখেন। এখান থেকেই ছবিটা নারী-পুরুষ সম্পর্ক আর লিঙ্গ পরিচয়ের সংকটের এক গহন ধূসর জগতে ঢুকে পড়ে।
ডেনমার্কের এই বিখ্যাত শিল্পী-দম্পতি আসলে বাস্তব ইতিহাসের চরিত্র। এবং এইনার তথা লিলিই পৃথিবীর প্রথম রূপান্তরকামী পুরুষ, যিনি পরিপূর্ণ নারী হয়ে ওঠার জন্য শরীর থেকে পুরুষের সমস্ত চিহ্ন মুছে, সেখানে নারীত্বের লক্ষণগুলো সাজিয়ে তোলার জন্য শল্যচিকিৎসকের ছুরি-কাঁচির নীচে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। শরীর নিয়ে লিলির সেই পরীক্ষা শেষ অবধি সফল হয়নি। শেষ বারের অস্ত্রোপচারের সময় তাঁর মৃত্যু হয়। সে দিক থেকে তাঁকে এলজিবিটি আন্দোলনের অন্যতম শহিদ বলা যায়।
এখন ছবিতে বা ছবিটা যে উপন্যাসের সিনেমা-রূপান্তর, সেখানেও ইতিহাসের সঙ্গে বেশ খানিকটা কল্পনার মিশেল ঘটেছে। তবে পরিচালক এখানে এইনারের ‘লিলি’ হয়ে ওঠার সফরটাকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই গার্দার সমকামী আইডেন্টিটির ঐতিহাসিক সত্যিটাকেও সন্তর্পণে সরিয়ে রেখেছেন। নারী ও পুরুষ দুই অস্তিত্বের টানাপড়েনে ‘লিলি’ এইনারের ভেঙে খানখান হয়ে যাওয়ার মুহূর্তগুলোই ছবিতে সবচেয়ে যত্নে তৈরি। পোশাক-ঘরের আয়নার সামনে নগ্ন লিলি যখন তাঁর মসৃণ বুকে প্রাণপণে স্তনের আভাস খোঁজেন, পুরুষাঙ্গ লুকিয়ে যোনি-চিহ্ন অনুভব করার চেষ্টায় থাকেন, তখন তাঁর রূপান্তরের আকুলতা যেন পরদা থেকে ছিটকে এসে দর্শকের বুকে লাগে! তুলনায়, ছবির একেবারে শেষে, লিলির মৃত্যুর পর গার্দা আর তাঁর পুরুষসঙ্গী হান্স যখন এইনারের আঁকা ল্যান্ডস্কেপ-এর সেই সরোবর আর পাঁচটা গাছের পাশে এসে দাঁড়ান, আর গার্দার গলায় জড়ানো লিলির দেওয়া স্কার্ফটা দমকা হাওয়ায় উড়ে যায়, দৃশ্যটা একটু বেশি রোম্যান্টিকতা-আক্রান্ত মনে হয়। পরিচালক হয়তো ওই স্কার্ফটাকে লিলির লড়াইয়ের নিশান হিসেবে ভেবেছেন!
sanajkol@gmail.com