আর্য নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ক্লাস ফাইভে। স্কুলের নাম পালসীট বিদ্যাপীঠ। এর আগে আর্য চিত্তরঞ্জনে একটা নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ত। কিন্তু বাবার ট্রান্সফার হয়েছে বর্ধমানের পালসীটে। এখানে কাছাকাছি কোনও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল নেই। তাই আর্য এক রকম বাধ্য হয়েই এই স্কুলে ভর্তি হয়েছে।
আর্যর বাবা সুকান্তবাবু বিডিও অফিসে চাকরি করেন। বদলির চাকরি। কিন্তু এর আগে এমন গ্রামে কখনও বদলি হননি। আর্যর মা তমসাদেবী রাগ করে বলেন, তোমার এই চাকরির জন্য আমার ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেল।
সুকান্তবাবু শুনে বলেন, তা কেন? বাংলা মিডিয়ামের ছেলেরা কী লেখাপড়া শিখে দাঁড়াচ্ছে না? তা ছাড়া আমি তো বাংলা মিডিয়ামে পড়াশোনা করেছি। তা বলে ইংরেজি শিখিনি না জীবনে দাঁড়াইনি!
তমসাদেবী ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেন, থামো তো। যুগটা এগিয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে এগোতে হয়। তখন তো এত কম্পিটিশন ছিল না। আমাদের যুগের সঙ্গে তুলনা কোরো না। আমাদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেই দেখো না, কার ছেলেমেয়ে বেঙ্গলি মিডিয়ামে পড়ছে। আর্য বেচারা ওদের সামনে মুখ শুকিয়ে থাকবে।
সুকান্তবাবু বলেন, কেন, আর্য অন্যায়টা কী করেছে শুনি যে ওকে মুখ শুকিয়ে ঘুরতে হবে? মাধ্যমটা বড় কথা নয়। লক্ষ্যটাই বড় কথা। আমাদের দেশের জ্ঞানীগুণী মানুষদের মধ্যে বেশির ভাগই জানবে গ্রামের পাঠশালায় পড়ে বড় হয়েছেন। তাতে তাঁরা কম কিছু শেখেননি।
আর্য জানে এ নিয়ে বাবা-মায়ের তর্ক-বিতর্ক চলতেই থাকবে। সব শেষে বাবা বললেন, দেখো, ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানোর জন্য আমি নিশ্চয়ই চাকরি ছেড়ে দেব না। তুমি বরং বর্ধমান টাউনে গিয়ে থাকো। কলকাতাতেও থাকতে পারো। রাজি থাকো তো বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় কি না খোঁজখবর করে দেখব। শনিবার করে আমি যাব।
কিন্তু তমসাদেবী এই রকম প্রস্তাবে রাজি হন না। কারণ, তিনি জানেন সুকান্তবাবু আলসারের রোগী। বাইরের খাবার সহ্য হয় না। এ ছাড়া তিনি মনে করেন, বাচ্চাকে বড় করে তোলার জন্য বাবা-মা দু’জনেরই সান্নিধ্য প্রয়োজন। অবশ্য তমসাদেবী নিজেও একা থাকতে ভরসা পান না। তাই এই প্রসঙ্গে আর কোনও কথা হয় না।
পালসীট বিদ্যাপীঠ স্কুলটা বেশ বড়। কিন্তু আশেপাশের গ্রামের মানুষজন গরিব। তাই স্টুডেন্টদের বেশভূষা পরিচ্ছন্ন নয়। পায়ে বেশির ভাগেরই চটি। মিড-ডে মিলের সময় হুড়মুড় করে এমন ভাবে খেতে বসে, দেখে মনে হয় বাড়িতে ভাল কিছু খায় না। এক-এক জন টিচারের চোখ এড়িয়ে টিফিনবক্সে ডিমটা তুলে নিয়ে যায়। ধরা পড়লে উত্তর দেয়, বোনকে দেব। কেউ বা বলে, ভাইকে দেব।
আর্য প্রথম প্রথম সঙ্কোচে কিছুই খেতে পারত না। বার বার ওর পুরনো স্কুলের কথা মনে পড়ত। ওখানে মিড-ডে মিল ছিল না। ওরা বন্ধুরা মিলে টিফিন শেয়ার করে খেত। এদের মতো খেয়েদেয়ে প্যান্টে হাত মোছার কথা কেউ ভাবতেই পারত না। প্রত্যেকের পকেটেই হ্যাঙ্কি থাকত। আস্তে আস্তে আর্যর চোখে এগুলো সয়ে গেছে।
ইংলিশ ক্লাসে ওর প্রোনানসিয়েশন শুনে স্যর সবার সামনে প্রশংসা করেছেন। আর্য বুঝতে পারে, ওর আয়রন করা ড্রেস আর পালিশ করা শু দেখে অনেকেই ওর ধারে কাছে আসে না। আর সেটা আর্য মনে মনে বেশ এনজয় করে। সবার প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন অবজ্ঞাও আছে।
তবে সে দিন বাংলা ক্লাসে প্রবীর বলে একটা ছেলে ‘সান্ত্বনা’ আর ‘শশীভূষণ’ বানান দুটো ঠিক বলতে পারল দেখে আর্য চমকে গিয়েছিল। এমনকী ‘যামিনী’ মানে যে রাত্রি, সেটাও বলতে পেরেছিল!
আশিস বলে এক জন আছে। আর্যর ঠিক পিছনের বেঞ্চিতেই বসে। ম্যাথসে দারুণ মাথা। বোর্ডে যে অঙ্কই দেওয়া হোক না কেন, সবার আগে হাত তুলবে। বিপ্লব বলে আর এক জন আছে। বাপ রে, হিস্ট্রির সাল এমনকী তারিখ পর্যন্ত এক্কেবারে নির্ভুল বলে দেয়!
আর্য মনে মনে ভাবে, ছেলেগুলোকে দেখে বোঝার উপয় নেই ওরা পড়াশোনায় এত ভাল। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ওরা বড় কোঁচকানো জামা পরে আসে। বেশ নোংরাও। আর্যর গা ঘিনঘিন করে। যদিও মুখে প্রকাশ করে না। তবে খুব প্রয়োজন না পড়লে কথাও বলে না। কে জানে কেন এই স্কুলটাকে আর্য মোটেও আপন ভাবতে পারছে না। তাই ক্লাসে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়নি।
এক-এক দিন রাতে ওর আগের স্কুলের বন্ধু রণসূর্য, দেবর্ষি বা প্রদীপ ফোন করে। বা কোনও কারণে মনখারাপ লাগলে আর্য ওদের সঙ্গে কথা বলে। অন্যান্য বন্ধুদের খবর নেয়। স্কুলের খবর নেয়। কথা বলার সময় আর্যর চোখ ছলছল করে ওঠে।
ক’দিন পরেই আর্যর বার্থডে। প্রতি বছর ও ওর বার্থডেতে বন্ধুদের ডাকে। সেলিব্রেট করে। এ বারেও তমসাদেবী বলেছেন, তোর স্কুলের বন্ধুদের ডাকবি তো?
আর্য মাথা নেড়ে বলেছে, না এখানে আমার কোনও বন্ধু নেই। তাই আমি বার্থডে সেলিব্রেট করব না।
সুকান্তবাবু বুঝিয়ে বলেছেন, দেখ আর্য, এখন ছোট আছিস তাই বুঝবি না। সব সময় তোর পছন্দমত সব কিছু হবে, তা কিন্তু নয়। সিচুয়েশন বুঝে তোকে মানিয়ে নিতে হবে। তা ছাড়া তোর স্কুলের বোর্ডের রেজাল্ট বেশ ভাল হয়। যারা পড়ে তাদের মধ্যে বেশির ভাগ স্টুডেন্ট গরিব ঘরের। সেটা তাদের দোষ নয়। তা ছাড়া, তুই বাড়িতে যা যা সুবিধে পাস অনেকেই তা পায় না। তবুও পড়াশোনায় ওরা বেশ ভাল। এই ধর, তোদের স্কুলে বিপিন বলে একটা ছেলে আছে, এইটে পড়ে। ওর মা বাড়িতে ঠোঙা বানান। আর ওর বাবা একটা মুদির দোকানে কাজ করেন। সেই বিপিন বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছে। তা হলেই ভাব, কোন লেভেলে রয়েছে ওর মেরিট।
কিন্তু আর্য বোঝাতে পারে না ওর অবস্থাটা। ক্লাসে ও দু’এক জনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা যে করেনি, তা নয়। ও যেমন মন থেকে ওদের বন্ধু বলে মেনে নেয়নি, তেমনি ওরাও ওর সঙ্গে মেশে না। না হলে মিড-ডে মিল খাবার সময় যে যার বন্ধুদের সিট পাশে রাখে। ওর সিট কেউ রাখে না। তা হলে ওদের বার্থডে পার্টিতে ডাকবে কেন!
আর্যর মন খুব খারাপ। সারাটা বছর ও বার্থডে পার্টিটা কেমন হবে, এ সব নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে আলোচনা করে। আর এ বছরে সেলিব্রেট করারই ইচ্ছে নেই।
পরের দিন স্কুলে গিয়ে গেমস পিরিয়ডেও খেলতে ইচ্ছে করল না। পেটব্যথার অজুহাতে ক্লাসে চুপ করে বসে রইল। যেহেতু ও কারও সঙ্গে মেশে না তাই ওকে কেউ জোরাজুরিও করল না। ওর পুরনো স্কুলের বন্ধুদের কথা মনে পড়ছিল।
হঠাৎ গেমস টিচার ক্লাসে এসে ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, আর্য, মাঠে যাওনি কেন?
স্যরের সামনে আর্য মিথ্যে কথা বলতে পারল না। তাই বলল, এমনি স্যর। আজ খেলতে ভাল লাগছে না।
স্যর মাথা নেড়ে বললেন, এটাও একটা পিরিয়ড।
তাই প্রত্যেককেই খেলতে হবে। চলো, আজ তুমি ফরোয়ার্ডে খেলবে।
অগত্যা আর্য স্যরের সঙ্গে সঙ্গে মাঠে গেল। কে জানে, অন্যমনস্ক ছিল বলেই হয়তো বল নিয়ে পাস করার সময় হোঁচট খেয়ে দুম করে মাঠের মধ্যে পড়ে গেল।
যন্ত্রণায় ‘উঃ মাগো’ বলে আর্য ককিয়ে উঠল। আর্য অবাক হয়ে গেল, সব ছেলেরা ওর কাছে চলে এল। কে কোথা থেকে জল নিয়ে এল, কারা ওকে ধরাধরি করে স্কুলের বারান্দায় নিয়ে এল, তা বুঝতেই পারল না। হাতের কনুইতে একটু ছড়ে গেছিল। কেউ এক জন জল দিয়ে সেই জায়গাটা ধুয়ে দিল। প্রত্যেকের চোখে মুখেই আন্তরিকতার ছোঁয়া। এমনকী স্কুল থেকে ফেরার পথে ওকে ধরে ধরে চিরঞ্জিৎ আর শরৎ বলে দু’জন ছেলে বিপ্লবের সাইকেলেও তুলে দিল। আর্য ভাবছিল, ইস এদের সঙ্গেই ও এত দিন বন্ধুত্ব করেনি! এদেরই জন্মদিনে ও ডাকবে না বলে মা-বাবার সঙ্গে তর্ক করেছিল! আজ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, ভাল জামাকাপড় পরলেই ভাল মানুষ হওয়া যায় না। নাঃ, মাকে গিয়েই বলতে হবে, ওর জন্মদিনটা এ বার নতুন বন্ধুদের নিয়েই সেলিব্রেট করবে।