১৯৬৩ সালে বেরিয়েছিল বব ডিলান-এর দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘দ্য ফ্রিহুইলিন বব ডিলান’। ‘ব্লোইং ইন দ্য উইন্ড’, ‘হার্ড রেন’, ‘মাস্টার্স অব ওয়ার’— যে সব গান সারা পৃথিবীকে জুগিয়েছিল বিপ্লবের ভাষা, ছিল এই অ্যালবামে। কলম্বিয়া রেকর্ডস-এর স্টাফ ফোটোগ্রাফার জন হানস্টেইন-এর তোলা একটি ছবি অ্যালবামের কভারে ব্যবহার করা হয়েছিল। ছবিটিতে গ্রিনিচ ভিলেজে জোন্স স্ট্রিট দিয়ে হাঁটছেন বব ডিলান, আর তাঁর বাহুলগ্ন সোনালি চুলের একটি মেয়ে, ডিলানের কাঁধের কাছটা স্পর্শ করে আছে তার নরম গাল। ছবিটির মধ্যে এমন একটা ক্যাজুয়াল ও স্বতঃস্ফূর্ত লুক ছিল, যা সেই সময়ে অ্যালবাম কভারে প্রায় কখনওই থাকত না।
ডিলানের সঙ্গের এই মেয়েটি কোনও ভাড়া করা মডেল নন, বব ডিলানের এক সময়ের প্রেমিকা। সুজি রোটোলো। সুজি এই বিখ্যাত অ্যালবাম কভার সম্পর্কে বলেছিলেন— ‘আমাদের কিছু বলার ছিল, বিক্রি করার কিছু ছিল না।’
যখন নিউ ইয়র্কে নতুন এসেছেন বব ডিলান, স্টার নন, হোটেলে রাতের আসরে গান করেন, গ্রিনিচ ভিলেজের গার্দ-এর ফোক সিটিতে সুজি প্রথম দেখেন তাঁকে। রিভারসাইড চার্চের অনুষ্ঠানের শেষে দুজনের প্রথম বার মোলাকাত হয়। শুরু থেকেই ডিলান চোখ সরাতে পারছিলেন না। যত কথা এগোচ্ছিল, মাথা ঘুরে যাচ্ছিল ডিলানের। মেয়েটির হাসির মধ্যে এক অদ্ভুত প্রাণ ছিল, যেন ভিড়-রাস্তায় হঠাৎ জ্বলে ওঠা আলো! স্মৃতিচারণায় ডিলান এই কথাগুলি লিখেছিলেন। ডিলানের মজার ব্যক্তিত্ব আকৃষ্ট করেছিল সুজিকে। অনুষ্ঠানের শেষে ডিলান অদ্ভুত ভাবে শ্রোতাদের সঙ্গে মিশে যেতেন। সুজির তখন সতেরো বছর বয়স। বিভিন্ন জায়গায় ছবি আঁকার, গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করতেন তিনি। ডিলানকে দেখে সুজির মার্কিন আমেরিকান কমেডিয়ান হারপো মার্ক্স-এর কথা মনে পড়েছিল। ডিলানের মধ্যে এক দামালপনা লক্ষ করলেন তিনি। ভীষণ আকর্ষণীয়, হেঁয়ালি-ভরা এক ব্যক্তিত্ব; কিন্তু গভীরতায় আপস নেই। অপ্রত্যাশিত হিউমারের ফুলকি দিয়ে মানুষকে সহজেই বন্ধু করে নিতেন তিনি, আবার এক মুহূর্তের নোটিস না দিয়েই দূরে সরে যেতেন। ডিলান আর সুজি পরস্পরকে ভালবাসলেন।
সুজান এলিজাবেথ রোটোলো-র মা-বাবা ছিলেন আমেরিকান কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার। ডিলান যখন প্রথম নিউ ইয়র্কে আসেন, তাঁর সম্বল ছিল বেশ কিছু পুরনো ফোক গান। তখনও তাঁর গানে সে ভাবে রাজনীতির কথা উঠে আসেনি। সুজির সঙ্গে তৈরি হওয়া সম্পর্ক ডিলানের গান-লেখায় বিরাট প্রভাব ফেলে। ১৯৫৫ সালে দুজন সাদা চামড়ার আমেরিকান নৃশংস ভাবে খুন করে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান এমেট টিল-কে। এই ঘটনার কথা ডিলানকে বলেছিলেন সুজি। ডিলান তার পর লেখেন ‘ডেথ অব এমেট টিল’ গানটি। সুজি ‘কোর’ (কংগ্রেস অব রেশিয়াল ইক্যুয়ালিটি) এবং অ্যান্টি নিউক্লিয়ার গ্রুপ-এর রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। বামপন্থী রাজনীতির, আধুনিক কবিতার জগৎ ডিলানের সামনে খুলে দিলেন সুজি। তিনি ‘কোর’-এর মিটিংয়ে নিয়ে যেতেন ডিলানকে। সিভিল রাইটস মুভমেন্ট সম্পর্কে ডিলানের ধারণা স্পষ্ট হতে শুরু করে। ব্রেখ্ট, ফরাসি কবি র্যাঁবো— এঁদের কাজগুলির সঙ্গে ডিলানের পরিচয় করান সুজি, যা পরে ডিলানের উপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল। সুজির হাত ধরে বহু নতুন জায়গায় যেতেন ডিলান। মডার্ন আর্ট এগজিবিশন, এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার, ইউরোপিয়ান ফিল্ম শো। ডিলানের মাথায় চিন্তার নতুন রাস্তাগুলি খুলতে থাকে। ডিলান একটা অতিকায় স্পঞ্জের মতো এই নতুন অভিজ্ঞতাগুলি শুষে নিতেন, পরে সেগুলোর সঙ্গে মিশে যেত তাঁর মেধার অবয়ব। কখনও রাত জেগে গান লিখতেন, সুজিকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘ঠিক আছে?’ ডিলান সুজিকে বলেছিলেন, ‘তোমাকে না জানলে কিছু গান কখনওই লিখতে পারতাম না।’ ’৬১-র শেষের দিকে ডিলানের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে চলে আসেন সুজি। শুরু হয় একসঙ্গে থাকা।
শুরুর দিনগুলোতে ডিলানের চারিদিকে বহু তারকা ছিলেন। ডিলান খুব তাড়াতাড়ি সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যান। ভয়ংকর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর মধ্যে। ডিলান আভাস পেয়েছিলেন, একটা বড় কিছু হতে চলেছেন তিনি। ১৯৬১-র সেপ্টেম্বরে রবার্ট শেলটন নিউ ইয়র্ক টাইমসে ডিলানের প্রশংসা করে অনবদ্য রিভিউ লিখলেন। তাঁকে নিয়ে শুরু হল মাতামাতি। প্রচার-প্রশংসার নেশায় বুঁদ হয়ে গেলেন তিনি। কিছু দিন পরেই হল কলম্বিয়া রেকর্ডস-এর সঙ্গে চুক্তি। সুজির খুব দমবন্ধ লাগত সেই সময়। ডিলান গান ছাড়া কিছু বুঝতে চাইতেন না, এবং সুজিকেও তাঁর এই সংগীতসর্বস্ব চিন্তার ফাঁস যেন জড়িয়ে ফেলেছিল। সুজি খুঁজছিলেন মুক্ত বাতাস।
সুজির এই ডিলানের সঙ্গে থাকাটা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি সুজির মা। ডিলান সুজির মা’কে সম্মান করতেন না। তা ছাড়া ডিলান নিজেকে নিয়ে গল্প বানাতে ভালবাসতেন। এটা ছিল তাঁর ইমেজ বানানোর কৌশল। সুজির মা ডিলানের এই গল্প বানানোটা ধরে ফেলেছিলেন। ডিলান বলতেন, ভ্রাম্যমাণ সার্কাসের দল থেকে পালিয়ে এসেছেন। হিবিং-এ নিজের পরিবারের কথা লুকিয়ে রাখতেন।
১৯৬২ সালে মা আর সৎবাবার সঙ্গে ইতালি পাড়ি দিলেন সুজি। খুঁজে পেলেন মুক্ত বাতাস-আলো। ইতালির পেরুজিয়াতে তিনি ছ’মাসেরও বেশি সময় ছিলেন। পড়াশোনা করলেন আর্ট নিয়ে। সুজির হঠাৎ এ ভাবে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি ডিলান। আঘাত পেয়েছিলেন। কিন্তু সুজি তাঁকে আঘাত দিতে ইতালি যাননি, কিংবা সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার কোনও ইচ্ছেও তাঁর ছিল না। তিনি অনেক দিন ধরেই নিজে কিছু একটা করার রাস্তা খুঁজছিলেন। শুধুমাত্র বব ডিলানের প্রেমিকার পরিচয়ে বাঁচতে চাইছিলেন না। ডিলান এ-সব কিছুই বুঝতে চাননি। তিনি সেই সময় লিখে চলেছেন ‘ডোন্ট থিংক টোয়াইস’, ‘বুটস অব স্প্যানিশ লেদার’-এর মতো গান। ১৯৬৩-র গোড়ার দিকে নিউ ইয়র্কে ফিরে এলেন সুজি। দেখলেন, চার পাশটা পালটে গেছে। ডিলান তত দিনে বিরাট আইকন, তাঁকে ঘিরে অসংখ্য মানুষ। ডিলানকে কষ্ট দিয়ে সুজি তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন— এমন খবরে চারিদিক সরগরম! যে দিকেই সুজি তাকান, তিরস্কার, অপমান। এক দিন ক্লাবে গেছেন তিনি, ডিলান একের পর এক গেয়ে চলেছেন ‘ডোন্ট থিংক টোয়াইস’, ‘টুমরো ইজ আ লং টাইম’। গানগুলি ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে সুজিকে। ডিলান এক প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকের মূর্তি তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে তৈরি করে রেখেছিলেন।
সুজি ভীষণ ক্লান্ত, একা হয়ে যাচ্ছিলেন। ডিলান চারিদিকে তাঁর হৃদয় ভাঙার গল্প ফেঁদে রেখেছিলেন। সুজির মনে হয়েছিল, ডিলান আদৌ অতটা খারাপ নেই, দিব্যি কাটছে তাঁর জীবন। তা ছাড়া সুজি দেখলেন, তাঁর একমাত্র পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিলানের প্রেমিকা। সেই ইমেজের জন্যই অনেকে তাঁর কাছে আসতে চাইত। নিজের সত্তা বলে কিছু অবশিষ্ট ছিল না। ’৬৩-র অগস্ট থেকে দিদির অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে শুরু করেন সুজি। নিজের জমি খুঁজতে বার বার অসফল হচ্ছিলেন তিনি, হারিয়ে যাচ্ছিলেন চোরাবালিতে। ডিলানের সন্তান সুজির গর্ভে এলেও গর্ভপাত করান তিনি। সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। সম্পর্কের শেষের দিনগুলোয় জোন বায়েজ-এর সঙ্গে ডিলানের নতুন সম্পর্কের কানাঘুষো ছড়াতে থাকে। বায়েজের সঙ্গে পরিচয়ের পর সুজির চোখে ডিলান আরও পালটে যান। গানে ডিলান সুজির দিকে আঙুল তুলে বলেছেন— তাকে হৃদয় দেওয়া সত্ত্বেও আমার আত্মা দাবি করেছে সে। যদিও তিনি নিজেই সুজির সবটা দাবি করেছেন বাস্তবে। সুজির যেন ছেড়ে যাওয়ার কোনও অধিকার নেই, কারণ ডিলানের তাঁকে দরকার। তিনি যেন পুরোপুরি ডিলানের সম্পত্তি! সুজি এ সব থেকে নিজেকে মুক্ত করেন। সুজি ও তাঁর দিদির সঙ্গে কুৎসিত ঝগড়ার কথা ডিলান লেখেন তাঁর ‘ব্যালাড ইন প্লেন ডি’ গানে। যদিও ১৯৮৫ সালের একটি ইন্টারভিউতে ডিলান বলেন, এই গানটি রেকর্ড করা ঠিক হয়নি।
সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবার পরও ডিলান-বিশেষজ্ঞরা সুজিকে ধাওয়া করেছেন অনেক দিন ধরে। ডিলান সম্পর্কে সুজি বলতেন, ‘আমার জীবনের ঘরে যেন একটা হাতি ঢুকে আছে।’ ডিলানের শুরুর দিনগুলোর উপর তৈরি ‘নো ডিরেকশন হোম’ (২০০৫) নামের একটি তথ্যচিত্রে সুজি ডিলান সম্পর্কে দু’-চার কথা বলেছিলেন। যদিও ডিলান নিজেই লিখেছেন ‘ডোন্ট থিংক টোয়াইস, ইটস অল রাইট’, কিন্তু শোনা যায়, সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সুজিকে ফোন করেন ডিলান, সঙ্গে ছিলেন ওঁদের বন্ধু লিলিয়ান আর বেইলি। ১৯৬২-র ইতালি সফরে সুজির সঙ্গে ফিল্ম এডিটর এনজো বার্তোসিয়োলি-র পরিচয় হয়, ১৯৭০-এ বিয়ে করেন ওঁরা। ২০১১ সালে লাং ক্যান্সারে ৬৭ বছর বয়সে মারা যান সুজি রোটোলো।
sumansarkar21@gmail.com