Advertisement
E-Paper

ভুট্টা

পৃথিবীতে তখন রাক্ষসদের বাস। বিশাল চেহারার গর্বে তারা বড্ড অসভ্য হয়ে উঠেছিল। চার দিকের ঈশ্বরের উদ্দেশে যে সন্ধেবেলা ধুনো-ধোঁয়া দেওয়ার প্রথা, তা পর্যন্ত অস্বীকার করতে শুরু করেছিল।

পিনাকী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০

পৃথিবীতে তখন রাক্ষসদের বাস। বিশাল চেহারার গর্বে তারা বড্ড অসভ্য হয়ে উঠেছিল। চার দিকের ঈশ্বরের উদ্দেশে যে সন্ধেবেলা ধুনো-ধোঁয়া দেওয়ার প্রথা, তা পর্যন্ত অস্বীকার করতে শুরু করেছিল। দেবতাদের রাজা নেসারু গেলেন ভীষণ রেগে। ঠিক করলেন, পৃথিবীতে এক ভয়ংকর প্লাবন আনবেন আর সমস্ত রাক্ষসকে জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলবেন। মানুষদের রক্ষা করতে তৈরি করলেন প্রকাণ্ড গুহা— পশুপাখিদের দায়িত্ব দিলেন মানুষদের সেই গুহায় নিয়ে যেতে। সবাই সেখানে আশ্রয় নিলে, গুহার মুখ বন্ধ করে দিলেন। তার পর পৃথিবী ভাসিয়ে দিলেন প্রবল বন্যায়। সব রাক্ষস সেই বন্যায় মরে গেল। নেসারু পাছে গুহায় আটকে থাকা মানুষ আর পশুদের কথা ভুলে যান, তাই তিনি আকাশে ভুট্টার গাছ লাগিয়েছিলেন। সেখান থেকে এক কলি ছিঁড়ে এক মহিলা তৈরি করলেন। তাঁর নাম দিলেন ভুট্টার দেবী। মাদার কর্ন। তাঁকে দায়িত্ব দিলেন গুহা থেকে সবাইকে বার করে পশ্চিমে সূর্যাস্তের দেশে নিয়ে যেতে। এর পরে তারা সেখানেই থাকবে।

মাদার কর্ন গুহা থেকে সবাইকে বার করতে গিয়ে পড়লেন ফ্যাসাদে। তিনি গুহায় ঢুকতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বিপন্ন দেবী সবাইকে অনুরোধ করলেন উপর দিকে গর্ত করতে। দেবীর আর্তিতে ছুঁচো, ভোঁদড় আর ইঁদুর সাড়া দিল। তাদের অবিশ্রান্ত পরিশ্রমের ফলে সবাই এক সময় ডাঙায় বেরিয়ে এল। দেবী বললেন, ‘যারা এখানে থাকতে চায়, থেকে যেতে পারে’— সেই শুনে ছুঁচো, ভোঁদড়, ইঁদুর আর বেশ কিছু প্রাণী গর্তের আশেপাশে থেকে গেল, দেবী বাকিদের নিয়ে সূর্যাস্তের দেশের উদ্দেশে রওনা হলেন। রাস্তায় পড়ল বিশাল খাদ, আর দুই পাহাড়ের মধ্যে এক নদী। মাদার কর্ন সাহায্য চাইতে, বিরাট ঠোঁট নিয়ে মাছরাঙা উপস্থিত হল। ঠোঁট দিয়ে দু’পাশের পাহাড় থেকে পাথর ফেলে এক সেতু তৈরি করল। দেবী বললেন, ‘যারা এখানে থাকতে চায়, থেকে যেতে পারে’— অনেকে থেকে গেল সেখানে, পাহাড়ে ওঠার ঝক্কি এড়াতে। দেবী বাকিদের নিয়ে চললেন । এ বার এল এক বিশাল হ্রদ। সাহায্য করতে উড়ে এল কালো মাথার লুন পাখি। সে লেকের মাঝখান দিয়ে পথ করে দিল। দেবী বললেন, ‘যারা এখানে থাকতে চায়, থেকে যেতে পারে’— অনেকে থেকে গেল সেখানে, আরও পথ চলার ঝক্কি এড়াতে। পথ চলতে চলতে এক ঘন জঙ্গল পড়ল। সেখানে পেঁচা পথ দেখাল। দেবী একই কথা বললেন। অনেকে থেকে গেল সেখানে। অবশেষে দেবী পৌঁছলেন সূর্যাস্তের দেশে, অবশিষ্ট দলবল নিয়ে।

নদীর পাশে মাদার কর্ন এক গ্রাম তৈরি করে সবাইকে সেইখানে থাকতে বললেন। পাইপ দিয়ে ধোঁয়া বার করে চার দিকের আকাশে কী ভাবে ছড়িয়ে দিতে হয় দেবতাদের উদ্দেশে, শেখালেন মানুষদের। আর শেখালেন গাইতে ও উৎসব করতে। শেখালেন, কোথায় ওষুধের গাছ পাওয়া যায়, তা থেকে কী ভাবে ওষুধ বানাতে হয়। যাওয়ার আগে গ্রামবাসীদের হাতে ভুট্টা দিলেন আর বললেন, ‘তোমরা এর চাষ করবে। এটা খেলে তোমাদের গায়ে বল হবে আর তোমাদের সংখ্যাও বাড়বে। আমি আর ভগবান নেসারু পরে আবার আসব তোমাদের দেখতে।’

ভুট্টা হল মানুষের চাষ করা শস্যের এক্কেবারে শুরুর দিকের সদস্য। প্রায় ৭৫০০ বছরের সম্পর্ক ভুট্টার সঙ্গে। শুরু হয়েছিল মধ্য আমেরিকার মেক্সিকোতে। ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তরে আর দক্ষিণে। বিভিন্ন রকমের ভুট্টার ফলন করে যে ভুট্টা পড়ে থাকত, তা নিয়ে এক বাণিজ্যরাস্তা অবধি তৈরি হয়ে গিয়েছিল সেই জমানা থেকে। যার জন্য অলমেক, মায়া, ইনকা— সব সভ্যতাতেই ভুট্টা হয়ে ওঠে অপরিহার্য।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

আদা-চা কি চমস্কি মেশানো?

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

ওরা নান্দনিক। কলকাতার নন্দন চত্বর ওদের চারণক্ষেত্র। রবীন্দ্রসদন-নন্দন-বাংলা অকাদেমি নিয়ে গঠিত শ্রীভূমিকেই নন্দন চত্বর বলা হয় এবং বিদগ্ধ মণ্ডলীর সমাগমে জায়গাটা দগ্ধ বা হট প্লেস। বিদগ্ধদের অনেকেই পাঞ্জাবির আমি পা়ঞ্জাবির তুমি। সিল্কের পাঞ্জাবিতে কারুকাজ? যন্ত্রশিল্পী। চকরাবকরা ও পনিটেল? সিনেমা আঁতেল। পাঞ্জাবির গায়ে কবিতার লাইন? বাচিক শিল্পী। জিন্‌স ও মলিন পাঞ্জাবি? পথনাটুকে। ফ্যাব ইন্ডিয়ার ডোরাকাটা? নিশ্চয়ই বাঘা কবি, বিদেশ ঘোরা। এই চত্বরে সদাই দু’-একটি সাদা কাক ওড়ে। দিব্যেন্দু নামের একটি তরুণ চত্বরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা ঘুরে প্রতি দিন বিকেল থেকে টানা চার-পাঁচ ঘণ্টা রবীন্দ্রসংগীত গাইত, ওকে আর দেখি না। এক জনের হাতে থাকত আলপনা আঁকা মলাটের মোটা খাতা। জুলজুল চোখে চত্বরের মানুষদের বিদগ্ধতা জরিপ করত। পছন্দ হলে খাতাটা এগিয়ে ধরত, ‘অটোগ্রাফ প্লিজ।’ এক বার সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সামনে খাতাটা ধরলে, সন্দীপন ‘সলমন রুশদি’ সই করে গদগদ থ্যাংকিউ শুনলেন। কয়েক জন সেমিনারজীবী ওখানে প্রায় প্রত্যহ যান। মার্কসবাদের ভবিষ্যৎ, শ্রুতিনাটক সমারোহ, বাঙালির রন্ধনশিল্প— সব রকম সভাতেই ওঁদের দেখা যায়। এঁদের মধ্যে কেউ অ্যাক্টিভ, কেউ প্যাসিভ সেমিনারজীবী। কোনও শ্রোতার মোবাইল-বাদন শুরু হলে, অ্যাক্টিভরা মুখব্যাদানসহ চিৎকার করবেন ‘যত্ত সব অর্ধনাগরিক!’ সেমিনার শেষের উদ্ভট প্রশ্নাদি ওঁরাই করে থাকেন। প্যাসিভরা চুপচাপ শুনে, বাইরে রাখা চা-বিস্কুট খেয়ে কর্তব্য শেষ করেন।

এ রকম এক জনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার, নাম পালটে বলি, ওঁর নাম অনন্ত জানা। কবি হওয়ার ইচ্ছে গজিয়েছিল স্কুলের মানেবইয়ে থাকা বিশেষণ লোভে। কবিদের সঙ্গে অনেক বিশেষণ থাকে, যথা, কবিগুরু, কবিশেখর ইত্যাদি। লেখাপড়াটা বেশি এগোয়নি কবিতার কারণেই। লসাগু-গসাগু-লগারিদ্‌মে, ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্রে, পাললিক শিলার খাঁজে ঢুকে যাচ্ছিল কবিতা। আবার, বাবার চালু তেলেভাজার দোকানেও বসা গেল না কবিতার কারণে। কবিদের তেলেভাজার দোকান মানায় না। কিন্তু ঠিকঠাক কবি হওয়াই হল না।

নামী পত্রিকায় পাঠিয়েছেন, কিন্তু ছাপেনি। দিবে আর নিবে ধরনের পত্রিকা ওঁর কবিতা ছেপেছিল কয়েকটা। কিন্তু অনন্তর তো নিজের কাগজ ছিল না— দিয়েছিলেন, কিন্তু নিতে পারেননি। ফলে ছাপা হচ্ছিল না বলে অভিমানে কবিতা লেখা ছেড়ে দিলেও, পূর্ব সংক্রামিত সারস্বত সুড়সুড়ির প্রভাবে নন্দন চত্বরের দগ্ধালয়ে ঘৃতপক্ব হতে থাকলেন, এবং কার্নিশের কাকের মতোই ওঁর কথার ফাঁকে বসতে থাকল হেজিমনি, পোস্ট কলোনিয়াল, সাব অল্টার্ন, ডায়াস্পোরা ইত্যাদি শব্দ। বছর দশেক আগে চমকেছিলাম চমস্কি শুনে। চাওয়ালা ‘দাদা, আদা-চা খান’ বলতে অনন্ত বলেছিলেন, ‘চা কি চমস্কি প্রভাবিত?’ অনন্তর ভোকাবুলারিতে অস্থানে-কুস্থানে ঢুকে যেতে থাকল লাকাঁ, ফুকো, স্যসুর। অনন্ত প্যাসিভ থেকে অ্যাক্টিভে প্রমোশনিত হলেন। দাড়ি রাখলেন, পরে ট্রিমিত করলেন। চক্ষু অবস্থা সাপেক্ষে নিমীলিত কিংবা বিগলিত। এক দিন ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞাসা করায় জানালেন, ‘বলতে পারেন গোদারিয়ান স্লো মোশনে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট বেঁচে আছি। আপনি?’ আমি ভ্যাবলার মতো বললাম, আমিও তাই। উনি বললেন, ‘না না, আপনার লাইফ সোলানাস!’ মানে? ‘আরে আর্জেন্টিনার বিখ্যাত ফিল্মমেকার, কালারফুল ছবি করে।’ জিজ্ঞাসা করি, আজ কী সেমিনার ছিল? বলেন, আজ তো সিনে ক্লাবের... এ বার কবিতা ছাপা শুরু হতে লাগল ওঁর। কবিতার মধ্যে ঢুকে গেল ওই সব শব্দাবলি। পাঞ্জাবি চকরাবকরা। দাড়িতেও সাদা ভাব, নুন-মরিচ যাকে বলে। সভাঘরে সামনের দিকে বসতে শুরু করলেন, এবং প্রশ্ন। যথা, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মরণ অনুষ্ঠানে— শ্যামল গাঙ্গুলির প্রকৃতিচেতনা কি স্পিনোজা-প্রাণিত?

দু’-এক বার অনন্ত আমার পাশে বসে ফেলেছেন। কানের কাছে ক্রমাগত ফিসফিস, ‘ইনি এ বার বলবেন পুরস্কার সাধারণত দিক ভুল করে ভুল ঠিকানায় পৌঁছয়, এ বার ঠিক জায়গায় গেল।’ মিলে গেল। অন্য বক্তা এল। অনন্ত বললেন, ‘ইনি এ বার গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক টেনে আনবেন।’ মিলে গেল।

এক বার তুমুল বৃষ্টিতে আটকে পড়েছি সভাগৃহে। ফেস্টুন: সুলেখক রতিবিলাস সাহার সংবর্ধনা। ওঁর পরিবারের লোকজন নিয়ে কুড়ি জন মতো রয়েছেন। অনন্তকেও দেখলাম। দুজন চিন্তিত মুখে ফোন কানে ছুটোছুটি করছে। বক্তারা বৃষ্টিতে আটকে পড়েছেন। জানা গেল, রতিবিলাসবাবুর চিৎপুরে বাসনের ব্যবসা, সাহিত্য ওঁর ভালবাসা। কিন্তু গণ্যমান্য কেউ এল না, অনন্তই ওদের বাঁচালেন। মাইক নিয়ে বললেন, ‘রতিবিলাসবাবুর ব্যসনে বাসনে গোপন মরচের মতো আছে সাহিত্য। ওঁর লেখায় কিসলওস্কির ছবির দমিত আবেগ, কিম কি দুকের ছবির বিষণ্ণ আলপনা। দেকার্তে বলেছিলেন, মানুষের বাইরের জীবনের ভিতরেও অন্য জীবন থাকে। বাসন-ব্যবসার মেটামরফোসিসের ভিতরে বেঁচে আছে ওঁর সাহিত্যজীবন। মিশেল ফুকোর কথায়....’

বক্তৃতা শেষে অটোগ্রাফ দিলেন অনন্ত। আমায় মৃদু করে বললেন, এ আর এমন কী, এক অজানা মানুষের শোকসভায় তো বক্তৃতা দিলাম পরশু দিন।

swapnoc@rediffmail.com

নয়া সংলাপ

ওপরের ছবির দুজন কী বলছে? সাদা পাতায় লিখে পাঠান। প্রতি ডায়লগ
২০ শব্দের মধ্যে। ঠিকানা: নয়া সংলাপ,
রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy