১৯৮৯-র জুলাই। হেয়ার স্ট্রিট থানায় পোস্টিং হল আমার। আমি তখন কলকাতা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর, কথ্য ভাষায় দারোগা।
এক দিন ডিউটি ছিল সকাল আটটা থেকে। রাতের ডিউটি অফিসারকে সময় মতো বদলি না করলে অনেক সময় রাতের কোনও ঝামেলা সকালের অফিসারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তিনি কেটে পড়তেন। আমি তাই সকালে ডিউটি-শুরুর পাঁচ-দশ মিনিট আগেই যেতাম। সে দিনও মিনিট দশেক আগেই পৌঁছেছি, নাইট ডিউটি অফিসার সিভিল ড্রেসে ইতিউতি ঘুরছেন আর ঘড়ি দেখছেন। থানার সেরেস্তার এ.এস.আই বাবুর কাছে জানলাম, কাল রাতে ডালহৌসি বাস স্ট্যান্ডের কাছে একটা মার্ডার হয়েছে। আমি বেশ বুঝলাম, আমার ঘাড়ে এই মার্ডারের কেসটা ফেলে কেটে পড়বেন বলেই নাইট ডিউটি অফিসার বার বার ঘড়ি দেখছেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে দাদা, অত ছটফট করছেন কেন? উনি বললেন, গত রাতে লালদিঘির পাড়ে এক ভবঘুরে ঘুমোচ্ছিল, কে বা কারা একটা পাথরের চাঁই দিয়ে তার মাথা থেঁতলে মেরে ফেলেছে। মানবিকতার খাতিরে ওঁর সঙ্গে তদন্তের সহায়তা করলাম, যদিও কেসটা ওঁর ডিউটি থাকাকালীন হয়েছে বলে ওঁকেই সব করতে হল।
প্রথম ঘটনাটা এ ভাবেই শুরু হলেও দেখা গেল, মধ্য কলকাতা বিভাগে যে ক’টা থানা আছে, সেই এলাকায় সাত-আট দিন বাদে বাদেই নানান ফুটপাতবাসী ভবঘুরে খুন হতে লাগল। ধর্মতলা, ওয়েলিংটন স্কোয়্যার— এই সব জায়গায়। একই রকম কায়দায়, পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে খুন। অজানা এক আতঙ্ক ছেয়ে ফেলল কলকাতার এই অঞ্চলের গরিব ফুটপাতবাসী আর চালচুলোহীন ভবঘুরেদের। সংবাদমাধ্যম এই ভয়ংকর আততায়ীর নাম দিল ‘স্টোনম্যান’। তখন বৈদ্যুতিন মাধ্যমের এত রবরবা ছিল না, মানুষ খবর যা পেত মূলত খবরকাগজ থেকেই। প্রায় প্রত্যেকটা খবরকাগজেই কলকাতা পুলিশের অপদার্থতার কথা ফলাও করে লেখা শুরু হল। আশ্চর্য ব্যাপার, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগও ‘সোর্স’ মারফত সম্ভাব্য আততায়ীর সম্পর্কে কোনও খবর পেল না!
আমাকে তো বাঁচতে হবে। তাই স্থির করলাম, এমন ভাবে ‘নাইট রাউন্ড’, (মানে রাতে ঘুরে ঘুরে পুলিশি টহল) দেব, যাতে গভীর রাত, মানে রাত একটা থেকে অন্তত ভোর চারটে পর্যন্ত কভার করা যায়। সে জন্য তো গাড়ি চাই। দারোগাদের জন্য যে গাড়ি থানায় থাকত, সেটা বেশ বড় গাড়ি। তার ড্রাইভারবাবুরা আবার অত খাটতে পারবেন না।
সে সময় শুধু হেয়ার স্ট্রিট থানাতেই এক জন অ্যাডিশনাল ও.সি. ছিলেন। তাঁর জন্য একটা উইলিস জিপ বরাদ্দ ছিল। এক জন হেড কনস্টেবল, নাথবাবু, সেই গাড়ি চালাতেন। নাথবাবুকে এটা-ওটা খাইয়ে খুশি করে, ওঁর কাছ থেকে গাড়ির চাবিটা নিজের কাছে রেখে দিতাম। আমার নাইট ডিউটির রাতে, দু-এক জন সাদা পোশাকের কনস্টেবল নিয়ে, নিজেই সারা রাত গাড়ি চালিয়ে এলাকা টহল দেওয়া শুরু করলাম। খেয়াল করলাম, আমার ডিউটিগুলোতে কোনও অঘটন ঘটল না। কিন্তু অন্যত্র, কোথাও না কোথাও, পাথর দিয়ে খুনের ঘটনা ঘটতেই থাকল। এক সন্ধেয় বেশ বৃষ্টি হয়েছিল। শিয়ালদা ফ্লাইওভারের পাশে কোর্টের কাছে এক জন খুন হল। পাশেই একটা পাথরের চাঁই পড়ে আছে, তার পাশে কাদামাটিতে জুতোর ছাপ, যেটা সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা। যথারীতি গুজব রটে গেল শহরে, স্টোনম্যান কোনও সাধারণ মানুষ নয়, অতিমানব। আতঙ্কে ধুয়ো দিল এই রটনা।
একটা কাজের কাজ হল, রাতের ফুটপাতে ভিখিরি বা ভবঘুরে মানুষদের শোওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। এক দিন হঠাৎ আমার কাছে খবর এল, একটা সাদা মারুতি ৮০০ গাড়িকে মাঝে মাঝেই রাতের রাস্তায় দেখা যায়। স্টোনম্যান নাকি সেটা চেপেই আসে। গাড়ির মধ্যেই থাকে বড় পাথরের চাঁই, সুযোগ বুঝে সেই দিয়ে মাথা থেঁতলে মানুষ খুন করে, ঝট করে পালিয়ে যায়। কিন্তু কেন? কী লাভ অসহায়, গরিব, গৃহহীন মানুষগুলোকে মেরে?
গোয়েন্দা বিভাগ থেকে বহু সন্দেহভাজন লোক ধরা হল, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হল না। এক রাতে জিপ চালিয়ে ডালহৌসির গির্জার সামনে দিয়ে ধর্মতলার দিকে যাচ্ছি, গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের সামনের রাস্তায় দেখি, একটা সাদা মারুতি। রাস্তা ফাঁকা থাকায় খুব জোরে চালালাম, কিন্তু হাজার হোক পুরনো গাড়ি, আমি পৌঁছনোর আগেই মারুতিটা বেরিয়ে গেল। প্রমাদ গুনলাম, মারুতি-কাহিনি যদি সত্য হয়, তবে তো একটা ‘অপারেশন’ নির্ঘাত হয়ে গেছে এরই মধ্যে। কিন্তু হোটেলের সামনে অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়ল না।
সব ক’টা খুনের ঘটনাই ঘটেছিল মধ্য কলকাতায়। কিন্তু আসল রহস্যের সমাধান হয়নি। তার পর আচমকাই সে বছরের শেষের দিকে বন্ধ হয়ে গেল স্টোনম্যানের ঘটনা। একটা কানাঘুষো শুনেছিলাম, এটা নাকি ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফল। তখন মধ্য কলকাতার যিনি ডি.সি. ছিলেন, তাঁর আরও উঁচু পোস্টে যাওয়া ঠেকাতে অন্য লবি থেকে নাকি এ ভাবে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছিল। যখন সেই পুলিশকর্তা অন্য জেলায় বদলি হলেন, আর অন্য এক জন সেই ‘উঁচু পোস্ট’ পেলেন, তার পরেই স্টোনম্যান বেমালুম উবে গেল কলকাতা শহর থেকে! কে জানে, গুটিকয় মানুষের স্বার্থ চরিতার্থ করতে অন্য কিছু নিরীহ অসহায় মানুষকে প্রাণ দিতে হল কি না!
আমার একটাই লাভ হয়েছিল। নাইট রাউন্ড দিয়ে দিয়ে গাড়ি চালাবার হাতটা পাকা করে নিয়েছিলাম।
বিমল কুমার চৌধুরী, বাবুরাম শীল লেন, কলকাতা
chowdhury_bimal@yahoo.co.in
আশির দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 80’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in