Advertisement
E-Paper

রেলবস্তি

আমার ভাইটা মরে গেল! বাবার সঙ্গে এসে ওরা যখন কোলে করে নিয়ে গেল, চোখটা কীর’ম বেরিয়ে এসছে। পা-টা বাঁকা। রক্ত! কত রক্ত! আমি দেখলাম তো। ও মামি, বিশ্কুট দাও না! খিদা লেগেছে।’

সোমঋতা ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৬ ০০:২০
ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

আমার ভাইটা মরে গেল! বাবার সঙ্গে এসে ওরা যখন কোলে করে নিয়ে গেল, চোখটা কীর’ম বেরিয়ে এসছে। পা-টা বাঁকা। রক্ত! কত রক্ত! আমি দেখলাম তো। ও মামি, বিশ্কুট দাও না! খিদা লেগেছে।’

পদ্মরানির পোলাপান তিনখান। তরুণ, বরুণ, অরুণ। সবচেয়ে বড়টা তরুণ। ওর দিদার সঙ্গে থাকে ঢাকুরিয়ায়। খিচুড়ি ইস্কুলের পাট চুকিয়ে এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। নাচও শেখে। হিপ-হপ আর সালসা। ওগুলো শিখলেই টিভিতে নাচতে যাওয়া বাঁধা। নাচ বাংলা নাচ।

আরও দক্ষিণে, মানে যেখানে শেষ মেট্রো স্টেশন এসে রেল স্টেশনে মিশেছে, সেখানকারই রেলবস্তিতে মা-বাবার সঙ্গে থাকত বছর আড়াইয়ের অরুণ আর বছর চারেকের বরুণ।

‘রোজ তো ছেলে দুটোকে ঘরে রেখে কাজে আসি। ওদের বাপ রিক্শ নিয়ে ঘোরে সারা দিন। বিকেল হতে না হতেই ছাইপাঁশগুলো গিলে কোথায় না কোথায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে। তবু এমন হয়নি। আর আমরা যখন সবাই আছি, তখনই কি না...’

ঘর মুছতে মুছতে পদ্ম হুহু করে একটা আওয়াজ করছিল মুখে। খানিকটা কান্নার মতো। আবার বিড়বিড়িয়ে বলে, সন্ধেয় বাসনকোসন নিয়ে পুকুরে গেছি। ছেলে দুটো ঘুমোচ্ছিল। ঘরে এসে দেখি, বরুণ ঘুমোয় একা। দরজা হাট। কত খুঁজলাম টর্চ নিয়ে। ওদের বাপ এসেও খুঁজল। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় নাকি? ওইটুকু শরীর! আমার মন তখনই কু গাইছিল দিদি। মরণ-লাইনের ধারে বাস! তার পরে হঠাৎ দেখি, হাতে করে কী যেন একটা নিয়ে ওদের বাপ হাঁউমাঁউ করতে করতে আসছে। কাছে এসে বলল, ‘ছেলেটা মরে গেল গো! ছেলেটা মরে গেল!’

পদ্মরা যেখানটায় থাকে, সেখানে আপ-ডাউন পাশাপাশি দুটো লাইনের দু’ধারে সার-সার ঝুপড়ি। কয়েকটার একটু ভাল অবস্থা। টালির এবড়োখেবড়ো চাল-টাল আছে। বেশির ভাগেরই ছাদ প্লাস্টিকের বা ত্রিপলের। বর্ষাকালে ভিজে চুপসে ভেসে একাকার হয় খাট-তোশক, হাঁড়ি-কুড়ি-টিভি-সেট টপ বক্স। এলাকার পার্টির ছেলেরা দিয়ে যায় ট্যালটেলে হলুদ খিচুড়ি, খাওয়ার জল। লাইন দিতে হয় সেই জলের জন্য। তার পরে বর্ষার জল যখন সরে যায়, কেমন আঁশটে আঁশটে গা-গুলোনো গন্ধ লেগে থাকে নোনা ধরা দেওয়ালগুলোয়।

ওই দিকটা বেশ ব্যস্ত লাইন। সমানে ট্রেন যাচ্ছে-আসছে। ডায়মন্ড হারবার, লক্ষ্মীকান্তপুর, ক্যানিং, আর ওই দিকে শিয়ালদা। মরণ-লাইন, বলল পদ্ম। কিন্তু ওই লাইন ধরেই অনায়াস জল ভরে ঘরে ফিরছে ফ্রক-পরা সদ্য ষোলোর মেয়ে। এক কাঁখে কলসি, এক হাতে একটা লেবেল উঠে যাওয়া সফ্‌ট ড্রিংকের বোতল, জলভর্তি। রেললাইনের পাশে কয়েক বিঘত নীচে সার-সার ঘর। দুপুরের খাওয়ার পরই তেল চুকচুকে চুল আলসে কায়দায় শুকোচ্ছে জনাকতক মধ্যবয়স্কা— লাইনের ধার ঘেঁষে বসেই দিব্যি। কোথাও আধভেজানো দরজার বাইরে ভুর করে রাখা এঁটো বাসন। হলদে হলদে ছোপছাপ-সমেত। সামনে হাঁটু-সমান সিমেন্টের কালভার্ট গোছের। চলে গিয়েছে বস্তি বরাবর।

তবে পদ্মর ছোট ছেলের কেসটা নেহাত দুর্ঘটনাই! রোজ রোজ হয় না। এই তো, ‌রেলায় ঘুরছে লাইনের উপর দিয়েই সাইনুর, কোহিনুর, ফিরোজা, তনুজা, নুহিরুল।

মাঝেরহাট লাইনের পাশে বিস্কুটের গোডাউন চলে গিয়েছে রেললাইনের সমান্তরাল খানিকটা। দুইয়ের মাঝেই বাস আবুর আলিদের। বাপ মরেছে কলেরায়। কাছেই একটা চায়ের ঝুপড়ি আম্মিজানের। বিস্কুটের গোডাউনের লোকজনদের টুকটাক ভিড় হয়।

ভাঙাচোরা টালি আর প্লাস্টিক-মাটিতে সাপটে দাঁড়িয়ে থাকা একহারা বাসস্থানের মধ্যে গুটিসুটি দিব্যি চলে যায় পাঁচ বোন-দুই ভাই-মা-এক বোনের বর আর এক ছাগলের। ছাগলের নাম আবার ‘বাটি’, অবশ্য ‘বাত্তি’ও হতে পারে। এ নিয়ে বহুমত দেখা গেল ভাইবোনদের মধ্যেই।

রান্নাবান্নার বন্দোবস্ত বাইরে। চারটে বাঁশের উপরে কোনও মতে একটা ছাউনি খাড়া করে উনুন খোঁড়া। বাসনপত্র বলতে একটা কেলেকিষ্টি কড়াই, দুটো থালা, খানকতক গ্লাস। তস্য অন্ধকার দুটো শোওয়ার ঘরে আবার ট্রেনের মতো আপার বার্থ-লোয়ার বার্থ আছে। সবেধন নীলমণি জামাইটি কিছু মাস ধরেই বার বার ম্যালেরিয়ায় ভুগছে। ছাগলটি যে ঘরে বাঁধা, সেই ঘরেরই আপার বার্থে দিবারাত্র মশারি খাটিয়ে জামাইয়ের শুয়ে থাকার ব্যবস্থা। এই বরটি কোহিনুরের। সাইনুরের বর তো তাকে কবেই তালাক দিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছে।

বৃষ্টির উৎপাত না থাকলে তিনপেয়ে চৌকিটাকে এক চিলতে দালানের বাইরেই বিছিয়ে গড়াগড়ি খায় নুহিরুল, আবুর। ইস্কুল-টিস্কুল নেহাতই নেপচুন গ্রহের বিষয়বস্তু তাদের কাছে। বিস্কুটের গোডাউন থেকে ফেলা বর্জ্য এবং আরও নানা আবর্জনা ঢিপি হয়ে রয়েছে পাশে কবে থেকেই। বিচিত্র সব গন্ধ ভেসে আসে, বর্ষাকালে আরও। তখন তো আম্মির চায়ের দোকানও প্রায় বন্ধই থাকে। কাস্টমার কই? চার দিক থইথই। ঘুপসি ঘরে ভিজে খড়, বাটির শরীরের খুশবু, অনেক দিনের না মাজা বাসন, ভিজে ট্রেনলাইন আর পাশের ওই আবর্জনার স্তূপ থেকে উজিয়ে চলে আসা মিশ্র একটা গন্ধে নেশাগ্রস্তের মতো উবু হয়ে বসে থাকে অতগুলো প্রাণী।

রেলের এই বস্তিগুলোর সব আলাদা আলাদা গন্ধ। পার্ক সার্কাসে প্ল্যাটফর্মের ধারে কিছুটা উপরে সার-সার বস্তি। চামড়ার কারখানার গন্ধে পার্ক সার্কাস পেরোনোর সময়ে ট্রেনচলতি মানুষদের প্রাণান্ত হলেও সেই গন্ধেই নিজেদের চিনতে পারে ওখানকার বাসিন্দারা। পাতিপুকুরে বা রবীন্দ্র সরোবরের কাছেও। সারা রাত মশার ভনভনে, পাশের খোলা নর্দমা থেকে গেঁজিয়ে ওঠা পাঁকের গন্ধে ক্লান্ত চোখগুলো আরামে বুজে আসে। আর চেনা শব্দ বলতে, কোথাও থেকে টিভি সিরিয়াল, আর মাঝে মাঝেই ঝমঝমিয়ে লোকাল! ওটাই তো ওদের জীবনের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক!

somrita87@gmail.com

rail Rabibashariya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy