Advertisement
E-Paper

টাইম মেশিন

সংসদে পাশ হয়ে গেল ‘স্টাডি ফ্রম হোম’ বিলটি। ইতিমধ্যেই সব অফিসে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ অর্থাৎ বাড়ি থেকে কাজ করার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে। এ বার বাড়ি থেকেই সর্বস্তরে ভিডিয়ো কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে লেখাপড়াও করা যাবে।

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০

সংসদে পাশ হয়ে গেল ‘স্টাডি ফ্রম হোম’ বিলটি। ইতিমধ্যেই সব অফিসে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ অর্থাৎ বাড়ি থেকে কাজ করার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে। এ বার বাড়ি থেকেই সর্বস্তরে ভিডিয়ো কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে লেখাপড়াও করা যাবে। সম্প্রতি ইন্টারনেট পুরোপুরি ফ্রি হয়ে যাওয়ায় এতে বাড়তি কোনও আর্থিক চাপও অভিভাবকদের ওপর পড়বে না। কেন্দ্রীয় সরকার হিসেব করে দেখেছে, এর ফলে শিক্ষা খাতে খরচ অন্তত ৮০% কমানো যাবে। স্কুলবাড়িগুলো ভাঙার প্রশ্ন নেই, ওগুলো রাজনৈতিক দলের অফিস করে দেওয়া হবে। সব ছাত্রছাত্রীকে একটিই ‘বোর্ড’-এর আওতায় নিয়ে আসা হবে, সারা দেশ থেকে বাছাই শিক্ষকদের নিয়ে একটি ‘কোর কমিটি’ তৈরি করা হবে, সেই কমিটিই বোর্ডের নীতি ঠিক করবে, পরীক্ষা পদ্ধতিও নিয়ন্ত্রণ করবে। এই ডিজিটাল পদ্ধতি চালু হলে কাগজের ব্যবহারও অনেকটাই কমে যাবে, তাতে ভারতের ‘গো গ্রিন’ প্রকল্পটিতেও অনেক সুবিধা হবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, এই ব্যবস্থায় টোকাটুকির সমস্যা একেবারে নির্মূল হবে। অনেকে হাসাহাসি করে বলছেন, ছাত্রের পাশে বসে বাবা বা ছোড়দা যদি উত্তর বলে দেন, তা হলে টোকাটুকি নির্মূল হল কোথায়? তা ছাড়া, কেউ অফিস যায় না, কেউ স্কুল যায় না, সবাই সর্ব ক্ষণ বাড়িতে থাকে— এই ব্যবস্থায় পারিবারিক জীবনও অস্বাভাবিক হয়ে উঠবে বলে কয়েক জন মনস্তত্ত্ববিদ জানিয়েছেন। এতে নাকি ঝগড়াঝাঁটি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব। ‘স্কুল স্টাফ সমিতি’ ও স্কুলবাস ইউনিয়নগুলি এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে বলেছে, শিক্ষাক্ষেত্রে যুক্ত কয়েক লক্ষ কর্মচারী বেকার হয়ে পড়বে, তার দায় কে নেবে? এ প্রশ্নও উঠছে, স্কুল-কলেজে কি শুধু লেখাপড়াই শেখানো হয়? নিয়মানুবর্তিতা, শরীরশিক্ষা, ঘরের বাইরের জগৎটাকে চেনা, সবার সঙ্গে মেলামেশা করা— এ সব কিছু ‘স্টাডি ফ্রম হোম’-এর মাধ্যমে অর্জন করা যাবে?

শুভাশিস চক্রবর্তীƒ কৈখালি, কলকাতা

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

গাঁট্টা

বল, উচ্চারণের ভুল ধরবি আর?

তখন ছেলেমেয়েরা পড়ত বেশি, পাশ করত কম। আমি রেলের স্কুলে পড়তাম। বন্ধু ছিল অমরেশ। পাশাপাশি বসতাম। অর্থকৌলীন্যে আমার চেয়ে কয়েক কদম এগিয়ে ছিল ও। অমরেশের বাবা ছিলেন রেলের চিফ মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারের স্টেনোগ্রাফার, আর আমি পাতি কেরানির ছেলে। কিন্তু তাতে সখ্যে কোনও পাঁচিল ওঠেনি। অমরেশ লেখাপড়ায় বরাবরই ভাল। বিজ্ঞান ও অঙ্কে আগ্রহ বেশি। আর আমার আগ্রহ সাহিত্যে। ক্লাসের এই বিপরীতমুখী বিষয়ের আদান-প্রদানে আমরা একে অন্যের সাহায্যকারী হিসেবে বেশ চালিয়ে যেতাম। অমরেশ একগুঁয়ে, আবার দৃঢ়চেতাও। ভাল-কে ভাল, কালো-কে কালো বলতে দু’বার ভাবত না। তার পরিণামও প্রায়শই সুখের হত না।

আমাদের ইংরাজি পড়াতেন ভোলাবাবু। সৌম্যদর্শন, মধুর ব্যবহার, ছাত্র-অন্ত-প্রাণ। ইংরাজি ভাষা-সাহিত্যের জাহাজ। সাহিত্যের পাশাপাশি ইংরাজি শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণে আমাদের খুবই উৎসাহিত করতেন।

স্কুলে এক দিন হঠাৎ শোরগোল। নতুন গেম্স টিচার জয়েন করেছেন। অ্যাসেম্বলি-র লাইনে প্রিন্সিপাল পরিচয় করিয়ে দিলেন ছাত্রদের সঙ্গে। উত্তরপ্রদেশের প্রবাসী বাঙালি। তাই উচ্চারণে সামান্য অবাঙালি। গাঁট্টাগোঁট্টা সুঠাম চেহারা। অল্প দিনের মধ্যেই জানা গেল, নতুন গেম্স টিচার ব্যানার্জি স্যর অসম্ভব বদরাগী ও মারকুটে।

অসুস্থতার কারণে ইংরাজির ভোলা স্যর এক দিন আসেননি। তাঁর জায়গায় ব্যানার্জি স্যর এলেন। তাঁর ইংরাজি পড়ানোর ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ তুঙ্গে। গলা ঝেড়ে গম্ভীর স্বরে তিনি বই-হাতে পড়িয়ে যাচ্ছেন। তিন ভাগ অশুদ্ধ উচ্চারণ শুনে ক্লাসে মৃদু গুঞ্জন ক্রমে ঘনীভূত হচ্ছে। অমরেশ উসখুস করে বলল, হচ্ছেটা কী? আমি চিমটি কেটে বললাম, চুপ কর, স্যর যা উচ্চারণ করে, করুক। দৃঢ়চেতা অমরেশ সবাইকে চমকে দিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। স্যর, আপনার উচ্চারণ ঠিক হচ্ছে না। নিমেষে ক্লাসে শ্মশানের স্তব্ধতা। স্যরের বই-ধরা হাত অপমানে থরথর করছে। চোখে আগুনে
দৃষ্টি। ‘কী বললি? বেরিয়ে আয়।’ অমরেশ অকুতোভয়ে এগিয়ে গেল। আমরা প্রমাদ গুনছি। এমন সময়ে, ঢং-ঢং-ঢং... পরের ক্লাসের ঘণ্টা। আপাতত যুদ্ধবিরতি। স্যর চোখে আগুন হেনে বেরিয়ে গেলেন।

মাস দুয়েক পর। স্কুলের স্পোর্টসের তোড়জোড় চলছে। গেম্স টিচার ব্যানার্জি স্যর সর্বেসর্বা। মাঠের চার ধারে চুন দিয়ে দাগানো। মুখে বাঁশি নিয়ে সারা মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন স্যর। আমরা শীতের মিঠে রোদ গায়ে মেখে ঘুরছি। ছুটির ঘণ্টা পড়ল। অমনি চুনের দাগের লক্ষ্মণরেখার বাধানিষেধ না মেনে সবাই ছুটছি বাড়ির দিকে। আমার পিছনে অমরেশ। হঠাৎ কোথা থেকে মূর্তিমান বিভীষিকার মতো হাজির হলেন ব্যানার্জি স্যর। সবাইকে ছেড়ে অমরেশকে ধরে সপাটে গালে চড় কষালেন। মাটিতে পড়ে গিয়ে অমরেশ বলল, ‘মারলেন কেন?’ ‘চুনের দাগের ওপর দৌড়চ্ছিলি বলে।’ ‘সবাই তো দৌড়াচ্ছিল স্যর।’ ‘শুধু তোকেই মারব। তুই আমার ইংরাজি উচ্চারণের ভুল ধরেছিলি, তোকে আমি ছাড়ব না’ বলে এলোপাথাড়ি চড় আর লাথি। উনি চলে যেতে ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল অমরেশ। চোখে জল। বললাম, তোর বাবাকে বল প্রিন্সিপালের কাছে রিপোর্ট করতে। জবাব না দিয়ে মুচকি হেসে ও বলল, মারার সময় স্যর ‘বাস্টার্ড’ কথাটাও ভুল উচ্চারণ করলেন। ওর কথা শুনে আমি থ!

প্রিয়বন্ধু চট্টোপাধ্যায়ƒ আসানসোল

স্কুলের শিক্ষক/শিক্ষিকা কি নিষ্ঠুর বা উদ্ভট ছিলেন? বিবরণ লিখে পাঠান ৪০০ শব্দে এই ঠিকানায়: গাঁট্টা, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।

শ্বশুরবাড়ি

বউ রাঁধে না, গাছে চড়ে

বাবা আমার বিয়ের সম্বন্ধ করতে লাগলেন। এক দিন এক আত্মীয় জানালেন, বাথুয়াড়ি গ্রামের তারাপদবাবুর বড় মেয়ে খুবই সুন্দরী। বিএ পড়ে। কিন্তু মেয়েটির এক শিক্ষক সুপাত্রর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। বললাম, ওই বিয়ে ভেঙে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। উনি বললেন, শুনেছি মেয়ে ওই শিক্ষক বর ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না ঠিক করেছে।

আমি কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে মডার্ন হিস্ট্রিতে প্রথম শ্রেণিতে এমএ। আবার প্রথম শ্রেণিতে আইনও পাশ করেছি ওখান থেকে। ক’দিন একটা স্কুলে পড়ালাম, তার পর ক’দিন একটা কলেজে। তার পর মেদিনীপুর জেলা আদালতে প্র্যাকটিস শুরু করলাম। তখন আবার ভাবতে লাগলাম, মাস্টারির চাকরিই ভাল ছিল, ছেড়ে ভুল করেছি।

এই সময় হঠাৎ এক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ হল, সে আবার ওই সুন্দরী মেয়েটিরই খোঁজ দিল। এও বলল, সেই শিক্ষক পাত্রের সঙ্গে তার সম্বন্ধটি ভেস্তে গেছে। তাই এগনো যেতে পারে।

কিছু দিন পর ওই বন্ধুর সঙ্গে পাত্রীর বাড়ি হাজির হলাম। সত্যিই খুব সুন্দরী। আলাপ হল। জিজ্ঞেস করলাম, রান্না করতে পারেন? উত্তর এল, ‘আমার দাদারা খুব ভাল রান্না করতে পারে।’ মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলল। বললাম, ‘আমার সঙ্গে বিয়ে হলে আপনার দাদারা কি আমার বাড়িতে রান্না করার জন্য থাকবেন? যান, দাদাদের জিজ্ঞাসা করে আসুন।’

পাত্রী উঠে গেল দাদাদের জিজ্ঞেস করতে। কানে এল হাসির হর্‌রা। তার পর একটু জোর জোর বাক্যবাণ, ‘রান্না করতে রাখবেন! কত টাকা রোজগার করে মাসে? জুনিয়র উকিল, করে তো পেটি ফগারি। বলোগে যাও, না দাদারা কেউ রান্না করতে থাকবে না। সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করবেন আর তাকে দিয়ে রান্না করাবেন? ওকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে হবে!’ পাত্রী এসে বলে গেলেন, ‘না, দাদারা কেউ রান্না করতে থাকবে না বলছে। আমার দুই দাদা তো স্কুলের শিক্ষক, আর এক দাদা ডাক্তার। ওরা তো সব শখের রান্না করে। বরং আপনিই শিখে নেবেন রান্না ওদের কাছ থেকে, কারণ আমাকে বিয়ে করলে আপনাকেই রান্না করতে হতে পারে।’ এই বলে অপাঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন। পরে আমার সঙ্গী বন্ধুটি বলল, ‘এঁরা বলছেন, পাত্রী পছন্দ না অপছন্দ, এক্ষুনি বলতে হবে।’ কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ‘পছন্দ!’

পরের দিন চলে আসার সময় পাত্রীর ঠাকুমা এসে আমাকে বললেন, ‘দেখো নাতজামাই, আমার নাতনি তো অতি আদরের মেয়ে। বাড়িতে রান্নার ঠাকুর আছে। তা ছাড়া ও তো কলেজে পড়ে। সারা দিন হেসেখেলে বেড়ায়, নাচগান করে আর পেয়ারা গাছে চড়ে। রান্না শিখবে কখন? তুমি বরং ওকে রান্না করে খাইও।’

বিয়ে হয়ে গেল। কর্মস্থলে পৌঁছলাম, রান্না না জানা, পেয়ারাগাছে চড়়া বউ নিয়ে। আমার ব্যাচেলর সংসারে থাকা ছেলেটি রান্না করতে লাগল।

কিছু দিন পরে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছি। আমার শ্যালিকা খুবই দুষ্টু। ইংরেজিতে এমএ। ইংরেজির শিক্ষিকা। এক দিন আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘জামাইবাবু, আমাদের বাড়ির রাঁধুনিরা সব সময় ব্রাহ্মণ হয়। আপনিও তো শুনেছি এক জন সৎ ব্রাহ্মণ। এই নিন আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। কাল থেকে এই বাড়িতে প্রতি দিন দু’বেলা রান্না করবেন। আপনার ওকালতিতে যা রোজগার, আমার দাদারা আপনাকে তার দশ গুণ বেতন দেবে। কি, রাজি?’ বলেই খিলখিল করে হাসি।

ইন্দু ভূষণ মিশ্রƒ বক্সিবাজার, মেদিনীপুর

আপনার শ্বশুরবাড়ি ভাল? খারাপ? ভাল-খারাপ মিশিয়ে? শ্বশুরবাড়ির টকঝালমিষ্টি ঘটনা লিখে পাঠান ৪০০ শব্দে। ঠিকানা: শ্বশুরবাড়ি, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।

হ্যালো 80’s

রাত জেগে টিকিট কাটার লাইনে

১৯৮২। বছরের শুরুতেই ৩ থেকে ১৭ জানুয়ারি কলকাতায় অনুষ্ঠিত হল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব— ‘ফিল্মোৎসব- ৮২’। কেন্দ্রীয় সরকারের আয়োজনে এ দেশে প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হয়েছিল ’৫২ সালে, তখনকার বোম্বেতে। ষাট আর সত্তরের দশকে কয়েকটি অনিয়মিত উৎসবের পর, ১৯৭৫ সাল থেকে প্রতি বছর এই উৎসব হয়ে আসছে। তখন উৎসবের মূল কেন্দ্র ছিল দিল্লি, পোশাকি নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়া’। প্রতি দু’বছর অন্তর দিল্লির প্রতিযোগিতামূলক উৎসবের মাঝের বছরগুলোয়, ‘আউট অব কম্পিটিশন’ ছবিগুলো নিয়ে করা উৎসবের নাম দেওয়া হয় ‘ফিল্মোৎসব’। সিদ্ধান্ত হয়, ভারতের নানা শহরে ঘুরেফিরে অনুষ্ঠিত হবে এই উৎসব। সেই সূত্রেই সে বছর উৎসব কলকাতায়।

ছবির পরব ঘিরে সবার তুমুল আগ্রহ উত্তেজনা। সাজো সাজো রব প্রশাসনের অন্দরেও। উৎসবের মূল কেন্দ্র রবীন্দ্রসদন (‘নন্দন’ তৈরি হয়নি তখনও), উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছাড়াও প্রেস, ডেলিগেট, অতিথি, অভিনেতাদের ওখানেই ছবি দেখার ব্যবস্থা। শিশির মঞ্চও সেজেগুজে রেডি। সাধারণ দর্শকদের জন্য উত্তর কলকাতায় মিত্রা, দক্ষিণে প্রিয়া, নবীনা সহ ধর্মতলার প্যারাডাইস, মেট্রো, এলিট, গ্লোব সিনেমাহল। ‘সোসাইটি’তে দেখানো হয়েছিল ‘রেট্রোস্পেক্টিভ’ বিভাগের ছবি, আর ‘নিউ এম্পায়ার’-এ ‘ইন্ডিয়ান প্যানোরামা’।

তখন সিনে ক্লাবের নব্য সদস্য আমি। সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিকের ছবির পাশাপাশি দেখছি বুনুয়েল, বার্গম্যান, কুরোসাওয়া, ফেলিনি, ত্রুফো, আন্তনিয়োনি, গোদার-এর ছবি। টগবগ করে ফুটছি, ফিল্মোৎসবে ছবি দেখব বলে। একসঙ্গে পৃথিবীর এতগুলো দেশের নামী ও নবীন পরিচালকদের ছবি, বহু চলচ্চিত্র-উৎসবে পুরস্কৃত-প্রশংসিত ছবি দেখার সুযোগ হাতছাড়া করা যায়! ‘রেট্রোস্পেক্টিভ’ বিভাগের আলাদা আকর্ষণ, হাঙ্গেরির পরিচালক মিকলস ইয়াঞ্চো আর তুরস্কের ইলমাজ গুনে-র (তখনও নাম শুনিনি) সঙ্গে, আছেন জাঁ লুক গোদার-ও!

অ্যাডভান্স টিকিট দেওয়ার আগের দিন সন্ধে থেকেই কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে সোসাইটি হল-এ লাইন দিলাম। তখনই বেশ ভিড়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে লাগল লাইনও। ভিড়ের মধ্যেই কোথা থেকে জুটে গেল কিছু তরুণ। লাইন যাতে বেলাইন না হয়, তারা কাগজ কেটে কেটে ছোট ছোট স্লিপ বানিয়ে, তাতে নম্বর লিখে ধরিয়ে দিল হাতে হাতে। গম্ভীর ঘোষণা: এক ঘণ্টা অন্তর অন্তর ‘রোল কল’ হবে। তাই প্রত্যেককে এখানেই থাকতে হবে। স্লিপ নিয়ে বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে সকালে এসে লাইনে দাঁড়াবেন, তা হবে না। কিছু ‘ছাড়’ আছে। সামনের বা পেছনের লোককে বলে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে, বা চা খাওয়ার জন্যে কিছু ক্ষণ ঘুরে আসা যাবে। জানুয়ারির শীতের রাতে মাফলার-চাদর জড়িয়ে সিনেমা হলের গেটে বসে আছি। পকেটে নম্বর-লেখা স্লিপ। সত্যি সত্যি রোল কলও হল বার কয়েক। ভোর হল। টিকিট দেওয়া শুরু দশটায়, কিন্তু কাউন্টার খোলার ঢের আগেই শুরু হল ঠেলাঠেলি। কোথায় লাইন, কোথায় স্লিপ। যে যেখানে পারল দাঁড়িয়ে পড়ল। লাইন তখন পুলিশের দায়িত্বে। একটাই চিন্তা, টিকিট পাব তো! যখন টিকিটের গোছা হাতে পেলাম, মনে হল, বিশ্ব জয় করেছি! টিকিটের দাম ৫, ৭, ১০ টাকা। আমি সব ৫ টাকার টিকিট কেটেছিলাম।

ছবি দেখা চলছে। নাইট শো দেখে গভীর রাতে বাড়ি ফিরে পর দিন ভোরে উঠেই ফের দৌড়। খিদে-তেষ্টা ভুলে গেছি, শুধু চা-বিস্কুট। গোদারের ছবিগুলো মাথার ওপর দিয়ে গেল। চমকে দিলেন গুনে, ওঁর ‘হোপ’, ‘দ্য হার্ড’, ‘দি এনিমি’, ‘এলিজি’, চারটে ছবিই দারুণ লাগল। স্পেনের কার্লোস সাউরা-র ছবি ‘ব্লাড ওয়েডিং’ (ওটা উদ্বোধনী ছবিও ছিল), সেনেগালের ওসমান সেমবেন-এর ‘সেড্ডো’ (যমুনা হল-এ একটাই রাতের শো ছিল), আফ্রিকার খুদে দেশ বুরকিনা ফাসো’র ছবি ‘গ্র্যান্ডমাদার’ (এই ছবিটাকে তুলনা করা হয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’র সঙ্গে), বাংলাদেশের ছবি ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ নিয়ে খুব হইচই। আর কিছু দর্শক এসেছেন ‘আনসেন্সরড ছবি’র লোভে, কোন দেশ, কে পরিচালক, থোড়াই কেয়ার। রটেও যেত, অমুক ছবিটা ‘হট’! এ ভাবেই বাজার গরম করেছিল ফিনল্যান্ডের ছবি ‘মিলকা’, ব্রাজিলের ‘পিক্সোতে’, নিউজিল্যান্ডের ‘চেঞ্জিং হর্সেস’। এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল, তিনি ধর্মতলার হলগুলোতে ঘুরে বেড়ান, ‘খবর’ পেলে তার পর লাইনে দাঁড়ান। তখন ভিডিয়োর কল্যাণে কলকাতায় নীল ছবি দেখার বেশ চল। বললাম, এত কষ্ট না করে ভিডিয়ো দেখতে পারেন তো! তিনি বললেন, ‘ধুর, ওগুলো বোরিং। সিনেমায় একটা জমাট গল্প থাকবে, তার সঙ্গে ওই, তবে তো জমবে!’

সে বছর ‘ইন্ডিয়ান প্যানোরামা’ বিভাগে চাঁদের হাট। সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক, তপন সিংহ, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের পাশে শ্যাম বেনেগাল, জি অরবিন্দন, গৌতম ঘোষ, কে বালচন্দ্র, কে এস সেতুমাধবন। ছিল অপর্ণা সেনের ছবি ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গি লেন’, ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইংরেজি ছবি ‘অ্যান অগাস্ট রিক্যুয়েম’, অমল পালেকরের মরাঠি ছবি ‘আক্রেয়িত’। মনে আছে, ‘পক্কুভেইল’ দেখে বেরিয়ে নিউ এম্পায়ারের লবিতে কিছু দর্শক পরিচালক জি অরবিন্দনকে ঘিরে ধরেছিল। উত্তেজিত কণ্ঠে যাচ্ছেতাই গালমন্দ, অপরাধ: ছবি স্লো, বোরিং! হতভম্ব, স্তম্ভিত অরবিন্দন কিচ্ছু বলেননি, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন শুধু। উৎসব চলতে চলতে এক দিন শোনা গেল, সত্যজিতের ‘পিকু’ আর ‘সদ্গতি’ কী কারণে দেখানো হবে না। আমরা দশ-বারো জন হইহই করে চলে গেলাম গ্র্যান্ড হোটেলে। খবর পেয়েছিলাম, ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর ওখানেই আছেন। আশ্চর্য, উনি দেখাও করলেন! কলকাতার দর্শকের খুব প্রশংসা করলেন, বললেন, চেষ্টা করবেন যাতে ছবিদুটো দেখানো যায়। পরে ‘সদ্গতি’ দেখানো হয়েছিল, আর ‘পিকু’র বদলে ‘টু’।

সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, রথতলা, কল্যাণী

আশির দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 80’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy