Advertisement
E-Paper

মেসোমশাই এনআরআই

ছো টবেলার বন্ধু। পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আর দেখা হয়নি। ঠেঙিয়ে সল্টলেকে গিয়ে দেখা করা আমার পোষাত না। তখনকার দিনে কালো টেলিফোনের ডায়াল ঘুরিয়ে ‘হ্যালো, কী খবর বলো’ বলার মতো পরিস্থিতিও ছিল না।

শুভময় মিত্র

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
ছবি: শুভময় মিত্র

ছবি: শুভময় মিত্র

ছো টবেলার বন্ধু। পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আর দেখা হয়নি। ঠেঙিয়ে সল্টলেকে গিয়ে দেখা করা আমার পোষাত না। তখনকার দিনে কালো টেলিফোনের ডায়াল ঘুরিয়ে ‘হ্যালো, কী খবর বলো’ বলার মতো পরিস্থিতিও ছিল না। তার অনেক বছর পরে আমাদের সবার ঘরে ঘরে ইন্টারনেট এসে গেল, আমার বন্ধু আমাকে আবার খুঁজে বের করল। তার প্রোফাইল পিকচার দেখে আমি প্রথমে চিনতেই পারিনি। ভারী মুখ। বড় টাক। সেটা বলায় আমায় বলল, ‘তোকে কিন্তু অবিকল এক রকম দেখতে আছে।’ আড্ডা জমে গেল। প্রায়ই এ কথা সে কথা। ও বেশি, আমি কম। কিছু দিন পরে বুঝতে পারলাম, সল্টলেক নয়, ও থাকে ফ্লোরিডা-তে। ভবানীপুরের স্যাঁতসেঁতে বাড়ি থেকে সল্টলেক, তার পর আমেরিকা— এটা কী করে হল, সেটা জানার জন্য খুবই ইচ্ছে হলেও জিজ্ঞেস করে উঠতে পারিনি। তবে, আগে ওদের ছোট ফোর্ড ছিল, এখন মস্ত বড় বিএমডব্লু সিরিজ সেভেন গাড়ি হয়েছে সেটা জানলাম। নিজস্ব সুইমিং পুলওয়ালা বাড়ি হয়েছে, তার ছবিও দেখলাম। আমার এ রকম কিছু বলার মতো ছিল না, তাই ছোটবেলার কথাই বলতাম। মানে, টাইপ করতাম।

কী যেন দরকারে ও দিল্লি আসছে। তাই ক’দিন কলকাতাতেও ঘুরে যাবে। হোটেলেই থাকবে। দেখা করবে আমার সঙ্গে, খুব উৎসাহ করে জানাল। হ্যাঁ হ্যাঁ করলাম, কিন্তু কাজের অজুহাতে দেখাটা আর করলাম না। আসলে হীনম্মন্যতায় ভুগছিলাম বোধ হয়। নির্ঘাত এক কার্টন সিগারেট বা হুইস্কির বোতল এনে রাখত ঠকাস করে। ধুস। এর পর কিছু দিন চুপচাপ, আবার আগের মতো বস্টন-শিকাগো শুরু হয়ে গেল। এই যে দেখা করলাম না, তাতে রেগে গিয়ে চুপ মেরে গেল তা নয়। ও-দেশে থাকলে, বোধহয় লোকজন অনেক উদার হয়ে যায়। থার্ড ওয়ার্ল্ডের আজেবাজে প্যাঁচপ্যাঁচানি নিয়ে সময় নষ্ট করে না। কিন্তু কিছু দিন আগে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল।

ও জানাল যে ওর বাবা কলকাতায় আসবেন। তার পর দুমকা যাবেন, কাজ আছে। আমাকে এয়ারপোর্টে ওঁকে রিসিভ করে উনি যেখানে থাকবেন, সেখানে পৌঁছে দিতে হবে। ভাল এসি গাড়ি হলে ভাল হয়। খরচ উনি দিয়ে দেবেন। হ্যাঁ হ্যাঁ, কোনও ব্যাপার নয়, বলে দিলাম। শুনে সত্যি সত্যি ভীষণ খুশি হয়ে বলল, আমাকে দেখলে ওর বাবাও খুব খুশি হবেন। ওদের পুরনো পাড়ার বাসিন্দা বলে কথা। ওঁকে আমি দেখেছি বলে মনে পড়ল না। ওদের বাড়িতে যেতাম না। পাড়ায় আড্ডা আর একটু ফুটবল খেলা হত। ঠিক কখন, কোন সময়, কাদের ফ্লাইটে আসছেন, জানিয়ে দিল আমাকে। আমিও যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে এয়ারপোর্টের অ্যারাইভালের জায়গায় পৌঁছে গেলাম ঝকঝকে সাদা গাড়ি নিয়ে। কম্পিউটারে বড় বড় অক্ষরে টাইপ করিয়ে ওঁর নাম লেখা একটা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। নির্ধারিত সময়েই বড় এলসিডি টিভিতে ‘ফ্লাইট হ্যাজ ল্যান্ডেড’ দেখে নিশ্চিন্ত হলাম। কাস্টম্স, ইমিগ্রেশনে একটু সময় লাগবে হয়তো।

অনেক রকম লোক বেরতে লাগল। বিদেশ থেকে এলে ভাল জামাকাপড়, চেহারা হবে— এমনই আশা করছিলাম। কিন্তু সবারই দিশি-দিশি হাবভাব। তবে, ট্রলিওয়ালা সুটকেসের চেহারা দেখে আমার হীনম্মন্যতাটা মাথাচাড়া দেবে-দেবে করছিল। একটা চেহারা কল্পনা করে রেখেছিলাম। বয়স্ক লোকদের দেখলেই সেটা মেলানোর চেষ্টা করছিলাম। সকলেই অন্য দিকে চলে যাচ্ছিল। আমি যেন হঠাৎ জেগে ওঠা একটা দ্বীপ— যেখানে একটাই গাছ। উঁচু পাহাড় থেকে নেমে, অনেক শহর-গ্রাম পেরিয়ে, ফুলে-ফেঁপে জল চলেছে সমুদ্রের সঙ্গে দেখা করতে, নামগোত্রহীন দ্বীপকে নিয়ে কারুর মাথাব্যথা নেই। ভায়া দিল্লি-আমেরিকার ফ্লাইটের সঙ্গে ব্যাংককও নেমেছে, উগরে দিয়েছে যাত্রীদের। সব মিলেমিশে একাকার। হুড়মুড় করে লোক বেরচ্ছে। এর মধ্যে কোন বুড়োটা আমার কে জানে! প্ল্যাকার্ডটা একটু উঁচু করে ধরলাম।

নাটকীয় ভাবে নয়। খুব সাধারণ ভাবে, ধীর পদক্ষেপে এক ভদ্রলোক এসে আমাকে বললেন, ‘অ্যাট লাস্ট।’ সঙ্গে বড় সুটকেস নেই, রয়েছে শান্তিনিকেতনি ঝোলাব্যাগ। প্ল্যাকার্ড নামিয়ে নিয়ে ড্রাইভারকে ফোন করে বললাম গেট থ্রি’র সামনে চলে আসতে। মেসোমশাই বললেন, ‘ক্যালকাটা ইজ স্টিল মাচ মাচ বেটার, দেখলাম তো অনেক।’ গাড়িতে উঠে চার পাশ দেখতে দেখতে বললেন, ‘নট ব্যাড অ্যাট অল।’ বাংলায় একেবারেই মরচে পড়েনি। এত দিন আছেন, তা সত্ত্বেও। আমারও মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল অনেক দিন পর। সেই কবে এক বার প্লেনে করে ডিব্রুগড় গিয়েছিলাম, তার পর আবার এলাম কাউকে রিসিভ করতে। সি-অফ করতে যেতে আমার ভাল লাগে না। চলে যায় এক জন, আমাকে একা একা ফিরে আসতে হয়। এ বারে তার উলটোটাই। আমি বিশেষ কিছু বলছিলাম না। আমার বন্ধু কেমন আছে-টাছে— এ সবও নয়। গত কালই কথা হয়েছে। সঙ্গে আর কোনও লাগেজ নেই, সেই ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করায় উনি হেসে বললেন, ‘দেশ ছাড়ার পর থেকে সারা দুনিয়াই ঘরবাড়ি হয়ে গেছে। ভদ্র ভাবে টিকে থাকার জন্য কিছুই লাগে না। শুধু খেয়াল রাখতে হয়, নিজের আইডেন্টিটিটা যেন হারিয়ে না যায়।’ রাস্তার ধারে বিগ-বেনের মডেল, নতুন ফ্লাইওভার, দেখতে দেখতে উনি খুবই খুশি হচ্ছিলেন। বললেন, ‘ডেভলপমেন্ট হোক, কিন্তু শহরের মূল আইডেন্টিটিগুলো যেন না চাপা পড়ে যায়।’ উনি যাবেন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের পাশের গলিতে, ড্রাইভারকে বলে দিলাম। রাস্তায় এক বারও জ্যামে পড়তে হল না। খুব স্মুদ ভাবে পৌঁছেও গেলাম। ‘অ্যালেন এখনও সেই চিংড়ির কাটলেটটা করে?’ ‘হ্যাঁ’ বলতেই বললেন, ‘লাহৌরের ফু়ড স্ট্রিটটা দেখেছ?’ ‘না’ বলার সঙ্গে সঙ্গে স্বগতোক্তি, ‘ফুড কিপ্‌স দ্য ওয়র্ল্ড টুগেদার।’ পৌঁছে, গাড়ি থেকে নেমে চার পাশটা দেখে বললেন, ‘সেই কাবাবের দোকানগুলো আছে নিশ্চয়ই, চলো খাওয়া যাক। এখানে একটা দোকান ছিল, বিফ ভুনা করত, একেবারে ড্রাই।’ সদ্য আমেরিকা থেকে কলকাতায় নামা বয়স্ক লোককে এ সব খাওয়ানোটা ঠিক হবে না। সস্তার দোকান, প্রচুর তেল-মশলা। ‘আর এক দিন হবে না হয়, আজ রেস্ট নিন বরং’ বলতেই, আমার কাঁধে একটু চাপ দিয়ে হালকা ঠেলা মারলেন। তার মানে, উনি যাবেনই। মুশকিল তো, আমাকে গাড়ি ছাড়তে হবে টাকা মিটিয়ে। সেকেন্ডে সেকেন্ডে মিটার উঠছে। ‘আরে, বাড়ি গিয়ে করবেটা কী? আমাকে দেখো, এই যে এলাম, আবার চলেও যাব, কোনও লাভ নেই কিন্তু। জাস্ট এলাম। জাস্ট যাব। যাক গে, ছেড়ে দাও ওটাকে।’ বাধ্য হয়ে পেমেন্ট মিটিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলাম। বাস ধরে ফিরতে হবে।

গাড়ির টাকাটা এখনও দেননি, আমিও কিছু বলিনি। হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের মাথায় এসে গেছি। খাবার দোকানে হাঁকডাক চলছে। বেঞ্চের ওপর পা তুলে বসে লোকজন খাচ্ছে। কাঠকয়লার ওপর পর পর কাবাবের শিক। মাংস-পোড়া ধোঁয়ায় চার পাশ ম-ম। ‘আমার মেয়ে থাকলে এ সব খেতেই দিত না। অথচ দেখো, কী না খেয়েছি আমি! অস্ট্রেলিয়ায় ক্যাঙারু, বেজিং-এ অক্টোপাস তো সবাই খায়।’ বিশাল থালায় মাংসের ঝোলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘নরওয়েতে এই রকম সিল মাছের ঝোল বানায়, বুঝলে?’ দোকানের লোক অপ্রসন্ন মুখে দেখছে, শুনছে। ওঁকে থামানো যাচ্ছে না। বেলজিয়ামে পর্ক রিব্স খাওয়ার গল্পটা শুরু করতেই বুঝলাম এ বারে গোলমাল শুরু হবে। এটা আমার অচেনা পাড়া। ‘এক মিনিট আসছি’ বলেই কেটে পড়লাম। বুড়ো যা খুশি করুক।

গাড়ির টাকাটা মার গেছে। আমার বন্ধুর কোনও বোন আছে জীবনে শুনিনি। নিশ্চিত ভাবে জানি, এ লোক দুমকা যাবে না। ভুল হয়ে গেছে। বিরাট বোকামো করে ফেলেছি আমি। দৌড়ে একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়লাম। বসার সিটও পেয়ে গেলাম, আর ফোনটা অফ করে দিলাম।

suvolama@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy