ওনাম দশ দিনের উৎসব। এ বছর উৎসব শুরু হয়েছে গতকাল— ২২ অগস্ট। চলবে ৩১ অগস্ট অবধি। প্রথম দিন কোচির বামনমূর্তি থিরিকারা মন্দিরে উৎসবের সূচনা। এর নাম আথাম। মন্দির থেকে শোভাযাত্রা বেরোয়। প্রত্যেক বাড়ির সামনে হলুদ ফুলের পাপড়ি দিয়ে আলপনার একটি বৃত্ত আঁকা হয়। এই স্তর প্রত্যেক দিন বৃদ্ধি পায়। নানা রঙের ফুলও যোগ হতে থাকে। ওনামের শেষ দিন এই বৃত্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০। বলিরাজা ও বামন অবতারের মূর্তি উঠোনে বা প্রবেশদ্বারে রাখা থাকে।
দ্বিতীয় দিন সকলে ঘরদোর পরিষ্কার করে, রং করে। আলোর মালা দিয়ে বাড়িঘর সাজানো হয়। এর নাম ‘চিথিরা’।
পরের দিন ‘চোধি’। এই দিনে নতুন জামাকাপড় ও আপনজনদের জন্য উপহার কেনাকাটার দিন। ওনামের ঐতিহ্যবাহী পোশাক মেয়েদের সোনালি-পাড় সাদা রেশম শাড়ি, এর নাম ‘কাসাভু’। পুরুষদের পোশাক সাদা সিল্কের লুঙ্গি, সঙ্গে ঊর্ধ্বাঙ্গের সোনালি বা রঙিন জামা, যার নাম ‘মুন্ডু’। এ বছর করোনাভাইরাসের আতঙ্কে উৎসবের আমেজে মেতে ওঠা প্রায় অসম্ভব। তবু টুইটারে কেরলি উদ্ভাবনী মাস্কের ছবি দেখা গেছে। ওনামের কথা মাথায় রেখে সাদা সিল্কের শাড়ি কেটে সোনালি বর্ডার বসিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই বিশেষ মাস্ক।
চতুর্থ দিন ‘ভিসাকাম’। এ দিন দুপুরে আয়োজিত হয় ওনাম-মহাভোজ। মালয়ালি ভাষায় যার নাম ‘সাদ্যা’। ২৬ রকম পদ থাকে সাদ্যা-র তালিকায়। ১. নোনতা কলাভাজা, ২. গুড়-মাখানো মিষ্টি কলাভাজা, ৩. কাঁচা আমের আচার, ৪. লেবুর আচার, ৫. লাউ, লাল বিন ও নারকেলের তরকারি, ৬. দই ও নারকেলের তরকারি, ৭. কাঁচকলা ও দইয়ের ব্যঞ্জন, ৮. নারকোলের দুধ দিয়ে ছাঁচিকুমড়ো, ৯. আনারস ও দই দিয়ে উচ্ছে, ১০. নারকেল তেলে ভাজা বড় সিম, ১১. আদা, তেঁতুল ও গুড়ের চাটনি, (ওনামের প্রথম দিনই এটা তৈরি হয়), ১২. শুকনো লঙ্কা ও তিল ফোড়ন দেওয়া মুগ ডাল, ১৩. লাল চালের আঠালো ভাত, ১৪. সম্বর, ১৫. রায়তা, ১৬. চালের পাঁপড়ভাজা, ১৭. দুধ ও নারকেল তেলে রাঁধা মিক্সড সবজি, ১৮. মশলাদার তরকারি, ১৯. কাঁচকলা ও নারকোল কোরা দিয়ে রাঁধা খোসাসুদ্ধ ডাল, ২০. রসম, ২১. ঘি, ২২. তরকারি, ২৩. মিহি আদাকুচি দেওয়া মশলাদার চাটনি, ২৪. পায়েসের সঙ্গে মেখে খাওয়ার ছোট কলা, ২৫. দুধ, চালগুঁড়ি, শুকনো ফল দিয়ে তৈরি মিষ্টিজাতীয় খাবার, ২৬. চালগুঁড়ি, কাজুবাদাম, মিহি নারকেলকুচি, গুড় সহযোগে তৈরি মিষ্টান্ন। এহেন ভোজ জীবনে এক বার অন্তত চাখার সুযোগ পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের কথা।
প্রায় বছর বিশেক আগে দক্ষিণ কর্নাটকের মণিপালে থাকার সুবাদে এক বন্ধু পরিবারের আমন্ত্রণে এই ‘সাদ্যা’ ভোজের নিমন্ত্রণ খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। উপরে লেখা এত সব পদের সঙ্গে অতিরিক্ত আরও একটি পদের কথা মনে পড়ে—সে হল ইডলি। পেল্লায় আকারের ডেকচিতে ফুটছে জল আর তার মধ্যে বড় বড় স্টেনলেস স্টিলের গ্লাসে স্টিম হচ্ছে ইডলির ব্যাটার। পরে ওই গ্লাস-আকৃতির ইডলি চাকু দিয়ে কেটে কেটে পরিবেশিত হচ্ছিল! সাদ্যা পরিবেশন ও ভোজনপর্ব চলে সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত। আহার পরিবেশিত হয় কলাপাতায়। প্রায় এক মাস আগে থেকে বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরির প্রক্রিয়া চলতে থাকে। তবে এখন হোটেল ও শপিং মলের কল্যাণে অনেক কিছুই রেডিমেড পাওয়া যায়। ফলে দীর্ঘ দিন ধরে প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। ব্যস্ত জীবনে অবসরও কম।
পঞ্চম দিনের নাম ‘আনিঝাম’। নদীনালার রাজ্য কেরলের প্রাণের আবেগ কেন্দ্রীভূত হয় নৌকো-বাইচের প্রতিযোগিতায়। লবণ-হ্রদ পম্পা সরোবরে ৪০-৫০টা বড় বড় নৌকোর এক-একটিতে ৭০-৮০ জন লোক গান গাইতে গাইতে দ্রুতবেগে নৌকো চালায়। নদীর ধারে ভিড় করে দর্শনার্থীরা নিজের নিজের গ্রামের নৌকাকে উৎসাহ দেয়। নৌকাগুলোর মাথার দিকটা সাপের ফণা বা বল্লমের ফলার মতো উঁচিয়ে থাকে, তাই ইংরেজিতে ‘স্নেক-বোট রেস’ ও স্থানীয় ভাষায় ‘বল্লমকেলি’ বলা হয়। এখানে আরানমুলা উথ্রাত্তাহি-ট্রফি বোট-রেস ও নেহরু-ট্রফি বোট-রেস দুটিই বিখ্যাত। এই নৌকো-বাইচ দেখতে সারা পৃথিবী থেকে ভ্রমণার্থীরা এই সময় কেরলে আসেন।
ষষ্ঠ দিনের উৎসব ‘থিরিকেটা’। এটি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিলনের দিন। অনেকে নিজেদের পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানাতে পুরনো জন্মভিটে পরিদর্শনে যান।
সপ্তম দিনটি নাচগানে মেতে ওঠার দিন। উৎসবের নাম ‘মুলাম’। মেয়েরা কেরলের বিখ্যাত লোকনৃত্য ‘কায়কোট্টিকলি’ পরিবেশন করে নানা অনুষ্ঠানে। এ ছাড়া কেরলের বহু বিখ্যাত নৃত্যশৈলী— থিরুভাতিকলি, পুলিকেলি, খুল্বি খুল্লাল, কথাকলি ইত্যাদির আয়োজনও হয় নানা স্থানে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করেন এই সব অনুষ্ঠানে। পুলিকেলি নাচে শরীরের ক্যানভাসে বাঘের ডোরাকাটা দাগ বা চিতাবাঘের ফুটকি দাগ এঁকে নৃত্যশিল্পীরা নিজেরাই বাঘ সাজেন। এটি শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। আজ থেকে দুশো বছর আগে কোচির রাজাদের উৎসাহেই পুলিকেলি-র সূত্রপাত। কথাকলিতে মুখে এঁকে বিশাল শিরোভূষণ পরে বিচিত্র বেশভূষায় রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক নানা চরিত্রে অভিনয় করেন শিল্পীরা। ভারতের লোকসংস্কৃতির ধারাগুলি এই ভাবে উৎসবকে কেন্দ্র করে বিস্মৃতি থেকে পুনরায় সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে।
অষ্টম দিনের নাম ‘পুরাদম’। দ্বারদেশের বৃত্তাকার আলপনায় এ দিন যুক্ত হয় শেষের বৃত্ত। আলপনার মাঝে বসানো হয় বলিরাজা ও বামন অবতারের ছোট মূর্তি। তাঁদের এই ভাবেই নিজের ঘরে বলিরাজা অর্থাৎ তাঁদের ‘ওনাথাপ্পান’-কে আনুষ্ঠানিক ভাবে আপ্যায়ন করে কেরলবাসী।
নবম দিনটি ওনাম-সন্ধ্যা, নাম ‘উথরাদম’। খাওয়াদাওয়া, আনন্দ-আহ্লাদে কাটে এই দিন। রাজা বলি রাজ্যভ্রমণে বেরিয়ে সমস্ত প্রজাকে আশীর্বাদ করেন এই দিনটিতে।
দশম অর্থাৎ শেষ দিনটি হল ‘থিরুভুনাম’। উৎসবের সমাপ্তির দিন সকাল সকাল স্নান সেরে নতুন বস্ত্র পরে নতুন করে আলপনা দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় রাজ্য জুড়ে আলোকসজ্জা ও আতসবাজির আয়োজন হয়। শহর জুড়ে বেরয় বর্ণময় শোভাযাত্রা। পার্থসারথি মন্দিরের পৌরোহিত্যে সুসজ্জিত হাতির পিঠে বলিরাজা ও বামনদেবের মূর্তি চাপিয়ে এই শোভাযাত্রার সূচনা হয়। শোভাযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে চলে নাচ, গান। রাজ্যের স্থানীয় গ্রামগুলোয় নানা ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলো, যেমন-কায়ানকলি, আত্তাকালাম, কুটুকুটু, কাবাডি, আম্বেয়াল, তালাপ্পনথুকলি প্রভৃতির আয়োজন হয়।
কেরলের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাও মহোৎসাহে উৎসবে শামিল হয়। তাঁরা মোমবাতি জ্বেলে বাইবেলে ফুল বর্ষণ করেন, একে বলে ‘নিলাভিলাক্কু’ (পুষ্প-আরতি), হিন্দুদের সঙ্গে একত্রে আহারও করেন। এই সামাজিক সম্প্রীতি ওনামের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।
থিরুভুনামের পরের দু’দিন ধরে চলে বলিরাজার প্রত্যাবর্তনের পর্ব। শেষ দিনে বৃত্তাকার আলপনার মাঝে বসানো বলিরাজার মূর্তি ‘ওনাথাপ্পান’-এর বিসর্জন পর্ব, তার পর সকলে দ্বারদেশের আলপনা পরিষ্কার করে ফেলেন।
২০১৮ সালে ওনামের আগে ভয়াবহ বন্যায় কেরলের লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘরবাড়ি ভেসে গিয়েছিল, সকলে ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবুও মানুষের হৃদয়ের রুদ্ধ আবেগ কোনও না কোনও উপায়ে আনন্দ প্রকাশের পথ করে নেয়। তাই ত্রাণশিবিরেই ওনামের উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিলেন গৃহহারা মানুষজন। ২৫ অগস্ট ২০১৮ আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘ঘুরে দাঁড়ানোর মরিয়া চেষ্টা, ত্রাণশিবিরেই পালিত হচ্ছে ওনাম উৎসব’—এই শিরোনামে সংবাদও প্রকাশ হয়েছিল। এ বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্কে মানুষ প্রায় গৃহবন্দি। তাই হয়তো নমো-নমো করেই শেষ হবে উৎসব। থাকবে না বাঁধভাঙা আনন্দের প্রকাশ। কিন্তু তবুও উৎসব মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারক। জাতপাত-ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে খুশির জোয়ারে গা-ভাসানোর সুযোগ। তাই নানা দুঃখ-কষ্ট ভুলে বার বার উৎসবে মেতে ওঠে মানুষ। সকলে মিলে বরণ করে নেয় উৎসবের আলোকে, কয়েকটি দিনের জন্য পুরোপুরি ভুলে থাকে অন্ধকারের কথা। এখানেই সার্থক হয় মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধন।