মল্লিকবাজারের খ্রিস্টান কবরখানার মেন গেটের সামনে সকাল আটটায় আমাদের সঙ্গে লেসলি ক্লডিয়াসের দেখা হওয়ার কথা। লেসলিকে নিয়ে তথ্যচিত্র, তাঁর উৎসাহের শেষ নেই। আর লেসলি ভীষণই পাংচুয়াল। কিন্তু সে দিন আটটা বেজে গেল। দু-পাঁচ মিনিট চায়ের ভাঁড়ের গড়িমসিতে কেটে গেলেও লেসলির দেখা নেই। আমরা ক্যামেরা-ট্যামেরা নিয়ে কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। ওঁর মোবাইল ফোন নেই। বাড়ির ফোনও বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে বার বার। হঠাৎই ভেতর থেকে এক গেটম্যান বেরিয়ে এসে আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করল, আমরা কি ক্লডিয়াস সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছি? ‘হ্যাঁ’ জানাতে, সে বলল, সকাল ছ’টা থেকে উনি ভেতরেই আছেন। আমাদের ডাকছেন। ইউনিটের সকলে অবাক-অবাক মুখ করে ভেতরে ঢুকতেই দেখি বেশ দূরে একটা কবরের পাশে নীরব-নিঃসঙ্গ ক্লডিয়াস। রঙিন ফুলে সেই কবরটা সাজিয়ে দিচ্ছেন।
আমাদের দেখে লেসলি মাথা নাড়লেন। স্মৃতি-ফলকের দিকে ইশারা করলেন। লেসলির ছোট ছেলে ববির সমাধি। সদ্য যৌবনে পথ-দুর্ঘটনায় মৃত প্রতিশ্রুতিমান ভারতীয় হকি-তারকা রবার্ট ‘ববি’ ক্লডিয়াস। লেসলিকে যত দিন দেখেছি— তাঁর শেষ জীবনের বছর দশেক, ক্যামেরা নিয়ে তাঁর অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলোকে তাড়া করে বেড়িয়েছি। কিন্তু লেসলির চোখে জল ওই এক দিনই দেখেছি।
আর তাঁর দুঃখের কথা শুনেছি দুটো। কাস্টম্স ক্লাবের তাঁবুতে ছোট্ট সবুজ অংশে হেলানো চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে এক লম্বা সাক্ষাৎকারে লেসলি ক্লডিয়াস জানিয়েছিলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে শোকের দুটো মুহূর্তের কথা। প্রথমটি অবশ্যই ববির মৃত্যু। ১৯৭৮ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে খেলেছিলেন ববি। ১৯৮২-র বিশ্বকাপের দল ঘোষণার আগেই ভারতীয় দলে জায়গা নিশ্চিত করে ফেলা ববিকে হঠাৎ কেড়ে নিয়েছিল এক দুর্ঘটনা। সে শুধু লেসলির একার শোকই নয়, নড়ে গিয়েছিল গোটা কলকাতা। কারণ, ববি জন্মগত ভাবে কলকাতার, খেলায় কলকাতারই প্রতিনিধিত্ব করতেন।
আর লেসলির জীবনে দ্বিতীয় দুঃখ হল ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ১-০ গোলে হেরে সোনা হাতছাড়া করা। লেসলি বলেছিলেন, পাকিস্তান ভাল খেলে জেতেনি, ভারত খারাপ খেলে হেরেছিল। অধিনায়ক হিসেবে সেই ব্যর্থতা তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভুলতে পারেননি। তার আগের তিনটে অলিম্পিকেই সোনা জিতেছিল ভারত, রোম অলিম্পিকেও জিতলে লেসলি ক্লডিয়াসের চারটে সোনা হত।
আর তাঁর জীবনের সবচেয়ে ঝকঝকে মুহূর্ত? মুখ ঝকঝক করে উঠেছিল এক ঝলকে। ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিক। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে জাতীয় পতাকা হাতে লেসলি ভারতীয় ক্রীড়া-সদস্যদের সবার আগে। জাতীয় সংগীত বেজে উঠেছিল। সব দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে ভারতীয় হকি দলকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। কারণ, ভারতীয় হকি দল তখন ছিল অপ্রতিরোধ্য। আগের প্রায় সব অলিম্পিকে ধারাবাহিক ভাবে সেরা। ভারতীয় হকি দলের সদস্য হয়ে এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত লেসলি ক্লডিয়াসকে সারা জীবন সুখ দিয়েছে। তাঁর মনে হয়েছিল, সেই মুহূর্তে তিনি যেন স্বর্গে বিচরণ করছিলেন।